খাল-নালায় গৃহস্থালী বর্জ্য নাগরিক দায় কতটুকু?

কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে চসিক

মোরশেদ তালুকদার | রবিবার , ৫ মে, ২০২৪ at ১০:০১ পূর্বাহ্ণ

নগরের কোনো খালনালা আবর্জনায় ভরাট হয়ে থাকলে নগরবাসী দোষারোপ করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে (চসিক)। তাদের দাবি, এসব পরিষ্কারের দায়িত্ব চসিকের। অথচ চসিকের পরিচ্ছন্নকর্মীরা পরিষ্কারের সময় খালে বিভিন্ন গৃহস্থালী পণ্য দেখতে পায়। এর মধ্যে থাকে লেপতোষক, বাথরুমের ভাঙা কমোড থেকে শুরু করে ভাঙা চেয়ারটেবিলও। অর্থাৎ খালনালাকে ‘ডাস্টবিন’ বানিয়ে সেখানে সবকিছু ফেলে কোনো কোনো নাগরিক। তাই চসিকের দায়িত্বশীলরা নাগরিক অসচেতনতাকে দায়ী করেন। কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন, সব দোষ কি কেবল চসিকের? এক্ষেত্রে নাগরিকের কোনো দায় নেই?

এ অবস্থায় খালনালায় যারা ময়লাআবর্জনা ফেলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে চসিক। এর অংশ হিসেবে চলতি সপ্তাহে সংস্থাটির একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে, যার নেতৃত্বে চলবে ভ্রাম্যমাণ আদালত। একইসঙ্গে খালনালায় যারা ময়লাআবর্জনা ফেলবে তাদের শাস্তির আওতায় আনবেন। এছাড়া সাধারণ মানুষ যদি খালনালায় ময়লা ফেলা কোনো ব্যক্তির তথ্যপ্রমাণ দেয় সেক্ষেত্রেও অভিযান চালিয়ে শাস্তির আওতায় আনা হবে।

চসিকের পরিচ্ছন্ন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বাসাবাড়ি থেকে ডোর টু ডোর প্রকল্পের আওতায় ময়লাআবর্জনা সংগ্রহ করে নিয়ে যাওয়া হয়। তাই যেখানেসেখানে ময়লাআবর্জনা না ফেলতে বিভিন্ন সময়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এর অংশ হিসেবে লিফলেট বিতরণ ও মাইকিং করা হয়। ‘আমরা সকলে মিলেই চট্টগ্রামকে করব পরিষ্কার’ স্লোগানে গত ফেব্রুয়ারি মাসে ‘ক্লিন সিটি ক্যাম্পেইন’ করে চসিক। এতে অতিথি হয়ে আসেন চিত্রনায়ক ফেরদৌস। এরপরও খালনালায় গৃহস্থালী বর্জ্য ফেলা থেকে বিরত নেই লোকজন। তাই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ বিষয়ে গত ১৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত চসিকের সাধারণ সভায়ও সিদ্ধান্ত হয়েছে। চসিক সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি নগরের প্রবর্তক মোড়ে হিজরা খাল ও তৎসংলগ্ন নালা পরিষ্কার করা হয়। এ সময় সেখানে বাথরুমের ভাঙা কমোড ও পুরনো লেপতোষকের সঙ্গে মেডিকেল বর্জ্য মিলে। এছাড়া অন্যান্য খালনালা পরিষ্কারের সময় প্লাস্টিক, পলিথিনসহ নানা অপচনশীল বর্জ্য পায়। চিপসের প্যাকেট, ভাঙা স্যুটকেস, ঘরের নষ্ট হওয়া আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন বর্জ্যে ভরাট থাকে সেগুলো।

প্রসঙ্গত, নগরে ৯৭২ কিলোমিটার নালা রয়েছে। এছাড়া ৫৭টি (১৬১ কিলোমিটার দীর্ঘ) খাল আছে। ৫৭টি খালের মধ্যে ৩৬টি সিডিএ মেগা প্রকল্পের আওতায় সংস্কার ও সম্প্রসারণ কাজ করছে।

কী বলছেন মেয়র : সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী আজাদীকে বলেন, এমন কোনো জিনিস নেই নালানর্দমায় ফেলা হচ্ছে না। এতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়, মানুষের দুর্ভোগ হয়। তাই জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন সময়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করি।

তিনি বলেন, বাসাবাড়ি থেকে তো পরিচ্ছন্নকর্মীরা ময়লা সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। এরপরও যেখানেসেখানে কেন ময়লা ফেলবে? অনেকে আছে যারা বাসার পাশ দিয়ে যাওয়া খালনালায় ঘরের যাবতীয় পণ্য ফেলে দেয়। এটা তো উচিত না। ফুটপাত দখলমুক্ত করতে যেভাবে কড়া অবস্থানে আছি একইভাবে খালনালায় যারা ময়লাআবর্জনা ফেলে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর অবস্থান থাকবে আমার। এজন্য একজন ম্যাজিস্ট্রেট নির্দিষ্ট করে দেব। খালে ময়লা না ফেলতে মানুষকে অনেক সচেতন করেছি। এখন আইনের প্রয়োগ করা হবে। আমরা পরিষ্কার করতে থাকব, আর মানুষ ফেলতে থাকবে সেটা হবে না। খালে ময়লা ফেলার সময় কেউ যদি ভিডিও করে আমাদের দেয় সাথে সাথে ম্যাজিস্ট্রেট পাঠাব।

এক প্রশ্নের জবাবে মেয়র বলেন, শহরটা তো শুধু মেয়রের একার না। এই শহরে যারা বাস করে সবার শহর এটা। তাই শহরকে সুন্দর রাখা সবার দায়িত্ব। সবাই যদি দায়িত্বশীল আচরণ করে, সচেতন হয়, তাহলে আমাদের শহর এগিয়ে যাবে। মানুষকে সচেতন করতে আমরা অনেক কর্মসূচি পরিচালনা করেছি। বিভিন্ন সময়ে মাইকিং করা হয়েছে। ঢাকা থেকে চিত্রনায়ক ফেরদৌসকে এনে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন করেছি। মানুষকে সচেতন করতে আমাদের উদ্যোগ ও চেষ্টার কমতি ছিল না। এখনো আমরা সচেতন করছি। তারপরও অনেকের অভ্যাসের পরিবর্তন আসছে না। তাই এবার আমরা কঠোর হব।

তিনি বলেন, শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখতে আমরা বছরব্যাপী বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়েছি। কিন্তু কিছু মানুষের অসচেতন আচরণ নগরকে পরিচ্ছন্ন রাখার পেছনে বড় বাধা হয়ে আছে। এজন্য আমরা সচেতনতা বাড়াতে জোর দিয়েছি। তবে মানুষ সচেতন না হলে আমরা কখনোই এ শহর পরিষ্কার রাখতে পারব না। জনগণ যদি সচেতন হয় ভৌগোলিক কারণে বর্ষায় পানি উঠলেও দ্রুত নেমে যাবে। এরপরও কেউ অযথা নালায় ময়লা ফেললে যার প্রতিষ্ঠানবাসার সামনে ময়লা পাব তাকে আইনের আওতায় আনব, জরিমানা করব।

কী বলছেন নাগরিকরা : সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চট্টগ্রামের সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার আজাদীকে বলেন, খালনালায় গৃহস্থালী বর্জ্যসহ অন্যান্য ময়লাআবর্জনা না ফেলতে নাগরিকদের সচেতন করার ক্ষেত্রে দুটো বিষয় আছে। একটি উদ্বুদ্ধ করা এবং অপরটি হচ্ছে আইনের প্রয়োগ। দীর্ঘদিন আইনের প্রয়োগ না করলে মানুষ অন্যায়কে নিয়ম মনে করে। নালানর্দমায় আমরা সবকিছু ফেলতে ফেলতে সেটাই নিয়মে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশনের কোনো দায়িত্ব নেই সেটা ঠিক না। সিটি কর্পোরেশন এবং অন্যান্য সরকারি সংস্থার দায়িত্ব জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা। একইসঙ্গে জনগণের মাঝে যারা অগ্রগামী, সুশীল সমাজ, জনগণের প্রতিনিধি তারা জনগণের মাঝে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। কোনো ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধকরণের পর সচেতন না হলে সতর্ক করবে। এতে কাজ না হলে আইনের প্রয়োগ করবে।

তিনি বলেন, বিদেশে গেলে আমরা সব মানি, দেশে মানি না; এটাও ঠিক না। বিদেশে আইন কার্যকর করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট ব্যবস্থা আছে। আর এখানে আইনের আওতায়ও আনি না। যার কারণে এখানে উদ্বুদ্ধকরণ, সতর্কীকরণ ও আইনের প্রয়োগ নেই। তিনটার অনুপস্থিতিতে জনগণ বদঅভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সে বুঝেই না যে অন্যায় করছে। তার বোধটাও নষ্ট হয়ে গেছে। এদিক দিয়ে সিটি কর্পোরেশন, সুধী সমাজ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, কাউন্সিলরের দায়িত্ব আছে। পাড়ামহল্লার যেসব সামাজিক সংগঠন আছে তাদেরও দায়িত্ব আছে। পাড়ামহল্লার সিনিয়র সিটিজেনদের সচেতন করার জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগ, জেলা প্রশাসন ও সরকারের অন্যান্য সংস্থাকেও দায়িত্ব পালন করতে হবে।

চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, এ সপ্তাহে আমরা ম্যাজিস্ট্রেট নির্দিষ্ট করে দেব। পাশাপাশি আমাদের সচেতনতামূলক কার্যক্রম চলবে। আসলে জনগণ তাদের জায়গা থেকে সচেতন না হলে কাজ হবে না।

চসিকের উপপ্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মোরশেদুল আলম চৌধুরী আজাদীকে বলেন, খালের পাড়ে যেসব ঘরবাড়ি আছে তারা গৃহস্থালী বিভিন্ন পণ্য খালেই ফেলে দেয়। এক্ষেত্রে সচেতনতা দরকার। পাশাপাশি আইনের প্রয়োগ দরকার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআরও একদিনের সতর্কবার্তা
পরবর্তী নিবন্ধখননের অভাবে মৃত ১০ বড় খাল