কথার জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ

রেজাউল করিম | বুধবার , ২০ জুলাই, ২০২২ at ৬:২৫ পূর্বাহ্ণ

জোছনা, বৃষ্টি তাঁর খুবই প্রিয়। প্রবল জোছনা তাঁর মধ্যে প্রচণ্ড হাহাকার সৃষ্টি করে। সেই হাহাকারের সন্ধান করে জীবন পার করে দিল। হুমায়ূন আহমেদ একটা বইয়ে লিখেছিলেন, ‘চাঁদনি পসর রাতে যেন আমার মরণ হয়।’ আর, তিনি প্রবল জোছনার তোড়ে ভেসে যাওয়া কোনো রাতে দুনিয়া ছেড়ে যেতে চান। জোছনাকে তিনি সবার কাছে একটা ক্রেজে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর বেশিরভাগ জোছনার বিবরণ শেষ হয় প্রচণ্ড না পাওয়া, শূণ্যতার ভেতর দিয়ে। পাঠককে শব্দের স্বপ্নজালে জড়িয়ে রেখে জোছনার চিত্রকল্প থেকে বেরিয়ে আসেন হুমায়ূন, কিন্তু সেই ঘোর পাঠকের মন থেকে আর যায় না। পরের জোছনায় পাঠককে দেখা যায় পথে, ছাদে অথবা বনে, চন্দ্রাহত হয়ে চেয়ে আছে জোছনার রূপদর্শনে। বিভূতিভূষণের পর এত তীব্রভাবে জোছনাকে আর কেউ এঁকেছেন বলে মনে হয় না।

‘চাঁদনী পসরে কে আমারে স্মরণ করে/ কে আইসা দাড়াইছে গো আমার দুয়ারে/ তাহারে চিনিনা আমি সে আমারে চিনে/ বাহিরে চাঁন্দের আলো, ঘর অন্ধকার/ খুলিয়া দিয়াছি ঘরের সকল দুয়ার/ তবু কেন সে আমার ঘরে আসেনা…।’

হুমায়ূনের অবিনশ্বর কীর্তি, সাহিত্য, ছবি, শিল্পকর্ম তাঁকে আমাদের মাঝে বাঁচিয়ে রাখবে বহুকাল। তাঁর মতো প্রাণপ্রচুর্যভরা সৃষ্টিশীল প্রতিভার মৃত্যু হয় না। আকাশ ভেঙে জোছনা আসবে। উথালপাতাল বৃষ্টি নামবে নীপবনে। সেই সব জোছনায়, সেই কদম ফুলের রেণুতে আমরা তাঁকে পাব। তিনি আমাদের চৈতন্য এবং নিসর্গের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশে থাকবেন।

তাঁর সৃষ্টিশীলতা সহজবোধ্য। গল্প লিখেছেন মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য। তাই তার গল্পের নায়কের নাম, আলতাফ, রফিক, আনিস নায়ীকার নাম নীতু, পারুল, তিথি। চেনাজানা চারপাশ, বাড়ির উঠোন তাঁর উপন্যাসের গণ্ডি।

বর্ষা ও বৃষ্টি তাঁর প্রায় সৃষ্টিকর্মে রয়েছে। লিখেছেন অপূর্ব হৃদয় ছোঁয়া গান -‘যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো/ চলে এসো এক বরষায়/ এসো ঝরঝর বৃষ্টিতে/
জল ভরা দৃষ্টিতে/ এসো কোমলো শ্যামলো ছায়/ চলে এসো তুমি চলে এসো এক বরষায়/ যদিও তখন আকাশ থাকবে বৈরী/ কদমগুচ্ছ হাতে নিয়ে আমি তৈরি/ উতলা আকাশ মেঘে মেঘে হবে কাল/ ঝলকে ঝলকে নাচিবে বিজলি আলো/ তুমি চলে এসো এক বরষায়…।’

হুমায়ূন সাহিত্যকর্মে হিমু অদ্ভূত চরিত্রের নাম। সে কখনো রহস্যময়ী, কল্পনা তার নিত্যসঙ্গী, বৃষ্টি খুব ভালো লাগে। মাঝে-মধ্যে মাথা ন্যাড়া করে, দিনে কখনো রাতে বেলায় উদাসী হয়ে ঘুরে বেড়ায়। হিমু মূলত একজন বেকার যুবক যার আচরণ অনেকটা অস্বাভাবিক। চাকরির সুযোগ থাকলেও সে চাকরি কখনো করে না বলেই সে বেকার। সে হলুদ পাঞ্জাবি পরে। আবার মাঝে মাঝে ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারে। নব্বই দশকে হিমুর প্রথম উপন্যাস ময়ূরাক্ষী প্রকাশিত হয়।

হলুদ বৈরাগের রঙ বলেই পোশাকের রং হলুদ নির্বাচিত করা হয়েছিল। ঢাকা শহরের পথে-পথে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ানো তার কর্মকাণ্ডের মধ্যে অন্যতম। উপন্যাসে প্রায়ই তার মধ্যে আধ্যাত্মিক ক্ষমতার প্রকাশ দেখা যায়। যদিও হিমু নিজে তার কোনো আধ্যাত্মিক ক্ষমতার কথা স্বীকার করে না। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তার প্রতিক্রিয়া অন্যদের বিভ্রান্ত করে, আর এই বিভ্রান্ত সৃষ্টি করা হিমুর অত্যন্ত প্রিয় কাজ। কোনো উপন্যাসেই কোনো মায়া তাকে কাবু করতে পারে নি। মায়াজালে আটকা পড়তে গেলেই সে উধাও হয়ে যায়।

হিমু উপন্যাসে সাধারণত কিছু ভক্তশ্রেণীর মানুষ থাকে যারা তাকে মহাপুরুষ মনে করে। এদের মধ্যে হিমুর খালাতো ভাই বাদল অন্যতম। মেস ম্যানেজার বা হোটেল মালিক-এরকম আরও কিছু ভক্ত চরিত্র প্রায় সব উপন্যাসেই দেখা যায়। এছাড়াও কিছু উপন্যাসে দুবৃর্ত্তের সাথেও তার সুসম্পর্ক দেখা যায়। হিমুকে পাওয়া যায়-ময়ূরাক্ষী, দরজার ওপাশে, হিমু, পারাপার, এবং হিমু…,হিমুর হাতে কয়েকটি নীল পদ্ম, হিমুর দ্বিতীয় প্রহর, হিমুর রূপালী রাত্রি,একজন হিমু কয়েকটি ঝিঁ ঝিঁ পোকা, তোমাদের এই নগরে, চলে যায় বসন্তের দিন, সে আসে ধীরে,আঙ্গুল কাটা জগলু, হলুদ হিমু কালো র‌্যাব, আজ হিমুর বিয়ে, হিমু রিমান্ডে, হিমুর মধ্যদুপুর, হিমুর নীল জোছনা, হিমুর আছে জল, হিমু এবং একটি রাশিয়ান পরী, হিমু এবং হার্ভার্ড পিএইচডি বল্টু ভাই, হিমু মামা, হিমুর একান্ত সাক্ষাৎকার ও অন্যান্য, হিমুর বাবার কথামালা, মযূরাক্ষীর তীরে।

তাঁর আরেকটি ব্যতিক্রমী চরিত্র মিসির আলী শুভ্র। মিসির আলীকে নিয়ে উপন্যাস হচ্ছে-দেবী, নিশিথিনী, অন্যভুবন, নিষাদ, বৃহন্নলা, ভয়, বিপদ, অনীশ, মিসির আলীর অমিমাংসিত রহস্য, তন্দ্রাবিলাস, আমিই মিসির আলী, বাঘবন্দী মিসির আলী, হরতন ইশকাপন, মিসির আলীর চশমা, কহেন কবি কালিদাস, মিসির আলী! আপনি কোথায়? মিসির আলী আনসলভ, যখন নামিবে আঁধার। শুভ্র নিয়ে উপন্যাস হচ্ছে-দারুচিনি দ্বীপ, রূপালী দ্বীপ, শুভ্র, এই শুভ্র! এই, শুভ্র গেছে বনে।

হিমু চরিত্রের স্রষ্টা নাটক, সিনেমা, গান, শিশুতোষ বলতে গেলে যেখানে বিচরণ করেছেন, সেখানে স্বকীয়তার স্বাক্ষর রেখেছেন। পাঠককে বইমুখী করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন।

একজন সন্ত্রাসীকে তিনি মানবিকভাবে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন, যাকে কমবেশি সবাই ভালোবেসেছেন। বিটিভিতে প্রচারিত ধারাবাহিত নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’ তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি। বাকের ভাইকে ফাঁসি দেয়া চলবে না, কিংবা বাকের ভাইয়ের কিছু হলে সারা বাংলা আগুন জ্বলবে – এ ধরনের কতো স্লোগান উঠেছিল। কিন্তু নাট্যকার সন্ত্রাসীর পরিণতি টেনেছেন ফাঁসির মাধ্যমে। মুনার পথ চলতে থাকে অন্তহীনভাবে।

চলচ্চিত্রেও হুমায়ূন আহমেদ স্বকীয় মহিমায় উজ্জ্বল। ১৯৯২ সালে ‘শঙ্খনীল কারাগার’ দিয়ে শুরু, আর পেছনে তাকাতে হয়নি। ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘চন্দ্রকথা’, ‘শ্যামলছায়া’, ‘দূরত্ব’, ‘নন্দিত নরকে’, ‘নিরন্তর’, ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’, ‘দারুচিনি দ্বীপ’, ‘সাজঘর’, ‘আমার আছে জল’, ‘প্রিয়তমেষু’, ‘ঘেটু পুত্র কমলা’ প্রভৃতি তাঁর অনন্য সৃষ্টি। হলবিমুখ মানুষকে পরিবার নিয়ে হলমুখী করেছেন। পুরষ্কার কিংবা প্রাপ্তির আশায় কোনো কিছু নির্মাণ করেননি। নিজের ছবি ও নাটকের জন্য গানও লিখেছেন।

শিশুদের জন্য তাঁর ভালোবাসা প্রগাঢ়। ‘নীল হাতী’, ‘রূপকথা’, ‘পুতুল’, ‘বোতল ভূত’, ‘নুহাশ এবং আলাদীনের আশ্চর্য চেরাগ’, মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা ‘সূর্যের দিন’ এবং রহস্য উপন্যাস ‘অন্যভুবন’ অন্যতম। বাংলাসাহিত্যে এমন প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব তেমন নেই। তবে হুমায়ূন আহমেদের ধারা একেবারে ভিন্ন। অত্যন্ত সহজ সরল। যা লালন করতেন, অন্তরে ধারণ করতেন- সেটাই সৃষ্টিকর্মে ছন্দোময় করে ফুটিয়ে তুলেছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবন্ধুত্বের দ্বীপ
পরবর্তী নিবন্ধমেঘের বাড়ির কন্যা