একুশের আয়োজন

জোবায়ের রাজু | বুধবার , ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ at ৮:৫১ পূর্বাহ্ণ

এবার অমর একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে আমিশাপাড়া হাইস্কুলে বর্ণাঢ্য এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অনাগত এই আয়োজনে প্রবল আনন্দ ভর করল রাকিব ও সোহানের মনে। একুশের আয়োজনে কবিতা আবৃত্তি প্রতিযোগীতারও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যে আবৃত্তিতে প্রথম হবে, তার জন্য আছে বিশেষ পুরস্কার।

রাকিব ও সোহান দুজনেই ক্লাস এইটে পড়ে। সোহানের কবিতা লেখার প্রতিভা আছে। তার রচিত অনেক কবিতা খবরের কাগজেও প্রকাশ হয়৷ পুরো স্কুল জুড়ে কবি হিসেবে সোহানের আলাদা পরিচয় আছে। অন্যদিকে রাকিব কবিতা না লিখলেও সে একজন উঁচু পর্যায়ের পাঠক। প্রচুর বই পড়ার অভ্যাস থাকলেও বাংলা বই রাকিবকে খুব একটা টানে না। তবে সে এই বয়সে ইংরেজি সাহিত্যে দারুণ অভিজ্ঞ। ব্রাজিলে জন্ম নেয়া কবি পাওলো লেমিনস্কি তার প্রিয় কবিদের একজন। ইংরেজ কবি রজার ম্যাকগ্রের সিংহভাগ গ্রন্থ তার পড়া। অবসরে রাকিব বই পড়তেই ভালোবাসে। বই পড়ার এই বিপুল নেশা সে বড়ভাই শাকিলের কাছ থেকেই পেয়েছে। দুভাই মিলে ভাগাভাগি করে ইংরেজি বই পড়ে। কথাবার্তায়ও রাকিব প্রচুর ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে। ক্লাসের অধিকাংশ বন্ধুরা তার এই ইংরেজি শব্দ ব্যবহারে বিরক্ত। এতে অবশ্য রাকিবের কিছু যায় আসে না। সে মনে করে কথা বলার সময় যত বেশি ইংরেজি ব্যবহার করবে, ততবেশী সে আধুনিক বা শিক্ষিত হিসেবে অন্যের কাছে গণ্য হবে। সুযোগ পেলেই সে ক্লাসের বন্ধুদেরকে তার পড়ে আসা ইংরেজি গল্পের বর্ণনা শোনায়। অনেকের কাছে জানতে চায় তাদের প্রিয় ইংরেজি কবি কে! কিন্তু ক্লাসের বেশীর ভাগ বন্ধুই ইংরেজি কবির নাম বলতে না পারলেও সবাই ঘুরেফিরে কাজী নজরুল বা রবীন্দ্রনাথের নাম বলে দেয়। সুযোগ পেয়ে রাকিবও তাচ্ছিল্যে বলে, ‘সেকি! তোরা কেউ ইংরেজী কবির নামও বলতে পারিস না!’

রাকিবের উপর তার দাদু ভাই গোলাম রহমানও চরম অসন্তুষ্ট। রাকিবের এই মাত্রাতিরিক্ত ইংরেজি প্রীতি তিনি পছন্দ না করার অন্যতম কারণ হল গোলাম রহমান একজন ভাষা সৈনিক। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের সেই ইতিহাস কাঁপানো মিছিলে বুলেটের হত্যাযজ্ঞ থেকে যারা যারা প্রাণে বেঁচে গেছেন, গোলাম রহমানও তাদের মধ্যে একজন। সেই মানুষের নাতি রাকিব কিনা বাংলাকে খুব একটা পরোয়া না করে ইংরেজি নিয়ে এত দম্ভ দেখায়।

.

আজ একুশে ফেব্রুয়ারি। স্কুল প্রাঙ্গনে জনসমাগম। আবৃত্তি প্রতিযোগীতা শুরু হয়ে গেছে। সোহান তার ভরাট গলায় নিজের লেখা কবিতা পাঠ করা শেষ হলে বিপুল করতালি পড়ে। টিপু স্যারতো মুগ্ধ হয়ে সোহানের কবিতার প্রশংসা করে বললেন, ‘তুমি এত দারুণ কবিতা লিখো। শব্দ চয়নও ভালো।

রাকিবও আবৃত্তিতে নাম দিয়েছে। সবার শেষে এলো রাকিবের আবৃত্তির পালা। মাইকের সামনে এসে সে ইংরেজি কবি আলেকজান্ডার পোপের একটি কবিতা আবৃত্তি করার জন্য গলা ছাড়তেই জাহাঙ্গীর স্যার বাধা দিলেন। কিছুটা রাগান্বিত গলায় বললেন, ‘এসব কি রাকিব? একুশের আয়োজনে এবং ভাষার মাসে তুমি বাংলা কবিতার বদলে ইংরেজি কবিতা নিয়ে প্রতিযোগীতা করতে চাইছো কেন?’ রাকিব কোনো কথা না বলে মাইকের সামনে চুপটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকে। রাকিবকে চুপ থাকতে দেখে জাহাঙ্গীর স্যার বললেন, ‘ইংরেজি নয়, তুমি বরং বাংলা কোনো কবিতা আবৃত্তি করো!’ নিরস কণ্ঠে রাকিব বলল, ‘বাংলা কবিতা আমার সেভাবে মুখস্থ নেই স্যার! চর্চাও নেই।লজ্জায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে রাকিব। বেলাল স্যার এগিয়ে এসে বললেন, ‘ইংরেজি নিয়ে তোমার মধ্যে অনেক নীরিক্ষা দেখতে পাই। ভিনদেশী ভাষা প্রীতি ভালো, তবে সেটা যেন মাতৃভাষার ঊর্ধ্বে না যায়।রাকিব কি বলবে বুঝতে পারছে না। মাথা নত করে মাইকের সামনে থেকে সরে আসে।

আবৃত্তির প্রথম পুরষ্কারটা সোহানের হাতে আসে। রাকিব কোনো পুরষ্কার পায়নি। তার মন খারাপ দেখে সোহান এগিয়ে এসে বলল, ‘তুমি ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা সাহিত্য নিয়েও পর্যবেক্ষণ করো। এক তরফা ইংরেজিকে গুরুত্ব দিয়ে তুমি কিন্তু মাতৃভাষাকে খাটো করছো। এ ভাষা আমাদের প্রাণের ভাষা। এ ভাষার জন্য ১৯৫২ সালে সংগ্রাম হয়েছে। রফিক, সফিক, সালাম, জব্বারেরা প্রাণ দিয়েছেন। তুমি বাংলা সংস্কৃতির ইতিহাসকে ভালো করে জানো।রাকিবের মুখে কোনো জবাব নেই। নিজের ভুল সে বুঝতে পেরেছে। স্কুলের মাইকে উচ্চস্বরে বাজছে একুশের গানআমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি

পূর্ববর্তী নিবন্ধআন্তর্জাতিক সম্মেলনে উপস্থাপন হবে ১০৪টি গবেষণাপত্র
পরবর্তী নিবন্ধএকুশ