নতুন বছর মানেই নতুন ক্লাস, আর নতুন বইয়ের উৎসব। নতুন বইয়ের ঘ্রানে শিক্ষার্থীদের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। উৎসব আমেজে নতুন বই হাতে পাওয়ার লোভে বছরের প্রথম এই দিনটির জন্য অপেক্ষায় থাকে সারাদেশের কয়েক কোটি শিক্ষার্থী। তবে গতবছর থেকে সব কিছুই যেন ব্যতিক্রম।
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস এলোমেলো করে দিয়েছে সব। নতুন বইয়ের অপেক্ষা থাকলেও উৎসবের আমেজ ছিলনা গতবার। কারণ, বই উৎসব না করে বিকল্প উপায়ে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া হয় গতবছর। এবারও ব্যতিক্রম হচ্ছেনা। গতবছরের ন্যায় এবারও বই উৎসব না করার সিদ্ধান্তের কথা আগেই জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রতি ক্লাসের বই তিন দিন করে ১২ দিনে বিতরণের নির্দেশনা দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর। একইভাবে প্রাথমিক পর্যায়ের বইও কয়েক দিনে বিতরণে নির্দেশনা জারি করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
নির্দেশনা অনুযায়ী-স্বাস্থ্যবিধি মেনে কোন ধরণের জমায়েত না করে শিক্ষার্থী বা অভিভাবকের হাতে বই তুলে দেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। স্বাস্থ্যবিধি মেনে বই বিতরণের উদ্দেশ্যে ক্লাস ভিত্তিক সিডিউল করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মাউশি চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপ-পরিচালক দেবব্রত দাশ ও চট্টগ্রামের জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম। সিডিউল মেনেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া হবে বলে জানান এই দুই কর্মকর্তা।
অর্ধেক বই পৌছেঁনি মাধ্যমিকের
বছর শেষ হলেও মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রায় অর্ধেক বই পৌঁছেনি চট্টগ্রামে। গত বৃহস্পতিবার (৩০ ডিসেম্বর) পর্যন্ত চাহিদার ৫৩ শতাংশ বই পাওয়া গেছে। মাউশি, চট্টগ্রাম অঞ্চল ও চট্টগ্রাম জেলা শিক্ষা অফিসারের কার্যালয় সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে। হিসেবে চাহিদার ৪৭ শতাংশ (প্রায় অর্ধেক) বই এখনো বাকি। এতে করে নতুন বছরের শুরুতে মাধ্যমিকের বই বিতরণে জটিলতা দেখা দিতে পারে চট্টগ্রামে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অনেক শিক্ষার্থীর সবকয়টি বই পাওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। অবশ্য, ধাপে ধাপে বই বিতরণের সিদ্ধান্ত রয়েছে জানিয়ে মাউশি চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপ-পরিচালক দেবব্রত দাশ বলেন, মাধ্যমিকের একটি ক্লাসে তিন দিন করে বই বিতরণ করা হবে। সব মিলিয়ে ১২ দিন ধরে বই বিতরণ চলবে। তাই বছরের প্রথম দিন বিতরণ শুরু হলেও ১২ দিনের মধ্যে বাকি সব বই চলে আসবে বলে আমরা আশা করছি। চট্টগ্রাম জেলা শিক্ষা অফিসারের কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী- মহানগরসহ চট্টগ্রাম জেলার মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এবার মোট বইয়ের চাহিদা ১ কোটি ১৯ লাখ ৫২ হাজার ৯০২টি। এর মাঝে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৩ লাখ ৯৯ হাজার ২৯২টি বই পাওয়া গেছে। হিসেবে চাহিদার ৫৩ শতাংশ বই পৌঁছেছে স্কুলগুলোতে। আরো প্রায় অর্ধেক (৪৭ শতাংশ) বই এখনো বাকি। এর বাইরে মাদরাসার ২৫ লাখ ৭৬ হাজার ৫৮১টি বইয়ের চাহিদার বিপরীতে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৪ লাখ ২৮ হাজার ১২৮টি বই পাওয়া গেছে। হিসেবে চাহিদার ৫৫ শতাংশ বই পৌঁছেছে মাদ্রাসাগুলোতে। আরো ৪৫ শতাংশ বই এখনো আসেনি। বিশেষ করে মাদরাসার এবতেদায়ী শ্রেণির বই খুব কম এসেছে বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে।
এদিকে, সবমিলিয়ে (মাদ্রাসাসহ) মাধ্যমিক পর্যায়ে চট্টগ্রামে মোট বইয়ের চাহিদা দাঁড়ায় ১ কোটি ৪৫ লাখ ২৯ হাজার ৪৮৩টি। এর মাঝে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭৮ লাখ ২৭ হাজার ৪২০টি বই পাওয়া গেছে। হিসেবে মোট চাহিদার ৫৩ শতাংশের কিছু বেশি বই পাওয়া গেলেও ৪৭ শতাংশ (প্রায় অর্ধেক) বই এখনো বাকি। হিসেবে চাহিদার অর্ধেক বই না পেয়েই বই বিতরণ শুরু হচ্ছে চট্টগ্রামে।
প্রাক-প্রাথমিকের একটি বইও আসেনি ১৯ থানায়
জেলার প্রাথমিকের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এরই মধ্যে চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশ বই পৌঁছে গেছে বলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় জানিয়েছে। তবে মহানগরসহ জেলার ১৯ থানা-উপজেলায় প্রাক-প্রাথমিকের একটি বইও আসেনি।
জেলার ২১ থানা-উপজেলার প্রাথমিকের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রাক-প্রাথমিকের শিক্ষার্থী সংখ্যা ১ লাখ ৬৩ হাজার ১৯ জন। ‘আমার বই’ নামে একটি বই পেয়ে থাকে প্রাক-প্রাথমিকের এই খুদে শিক্ষার্থীরা। যার একটিও ৩০ ডিসেম্বর (বৃহস্পতিবার) পর্যন্ত পৌঁছেনি। যদিও শুক্রবার (৩১ ডিসেম্বর) সকালে দুটি থানায় (বন্দর ও ডবলমুরিং) প্রাক-প্রাথমিকের বই পৌঁছেছে বলে দাবি করেছেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম। অবশ্য, বই পাওয়া না গেলেও প্রাক-প্রাথমিকের একটি করে অনুশীলন খাতার শতভাগ পৌঁছে গেছে জানিয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, অন্যান্য শ্রেণির প্রায় সব (৯০ শতাংশের বেশি) বই পাওয়া গেছে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের তথ্য অনুযায়ী, মহানগরীর ৬টি থানা ও ১৫টি উপজেলাসহ চট্টগ্রাম জেলায় প্রাথমিক পর্যায়ের মোট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৪ হাজার ৪৪৪টি। এর মধ্যে জাতীয়করণকৃতসহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ২ হাজার ২৬৯টি, বেসরকারি কিন্ডার গার্টেন (কেজি স্কুল) ১৮ শতাধিক, এনজিও স্কুল ১১৮টি, উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন ১২৭টি, রঙ (আনন্দ স্কুল) ৩০টি, আন রেজিস্ট্রার্ড স্কুল ১০টি এবং পরীক্ষন স্কুল ২টি। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১১ লাখের বেশি।
এসব শিক্ষার্থীর জন্য ২০২২ সালের সম্ভাব্য চাহিদার ভিত্তিতে বরাদ্দকৃত মোট বইয়ের সংখ্যা ৪৬ লাখ ৮ হাজার ৪৯২টি। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার (৩০ ডিসেম্বর) পর্যন্ত ৩৮ লাখ ৬২ হাজার ৩২টি বই থানা-উপজেলার গোডাউন হয়ে স্কুলে-স্কুলে পৌঁছে গেছে। যা মোট চাহিদার প্রায় ৮৪ ভাগ। এর বাইরে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ের ১ লাখ ৬৩ হাজার ১৯ জন শিক্ষার্থীর জন্য একটি করে বইয়ের চাহিদা রয়েছে চট্টগ্রাম জেলায়। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়ের মনিটরিং অফিসার নূর মোহাম্মদ এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। অবশ্য শুক্রবারও (৩১ ডিসেম্বর) বই এসেছে জানিয়ে এরই মাঝে ৯০ শতাংশের বেশি বই পাওয়া গেছে বলে দাবি করেছেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম।
প্রাক-প্রাথমিকেরসহ কিছু বই না পাওয়ায় বই বিতরণে জটিলতার বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, এবারও বই উৎসব হচ্ছেনা। আর গতবারের মতো একটি স্কুলে অন্তত ৫ দিন করে বই বিতরণ করা হবে। এর জন্য ক্লাস ভিত্তিক সিডিউল তৈরি করা হয়েছে। সিডিউলে প্রাক-প্রাথমিকের বই বিতরণ রাখা হয়েছে শেষ দিনে। এই সময়ের মধ্যে প্রাক-প্রাথমিকসহ সব বই পৌঁছে যাবে বলে আমরা আশা করছি। তাই প্রথমিকের বই বিতরণে কোন জটিলতা হবে বলে আমরা মনে করছিনা।