’৬৯ এর গণ-আন্দোলনে গঠিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম পুরোধা শহীদ ছাত্রনেতা হারুনুর রশিদ ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর অতি সাধারণ একটি পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা মোহাম্মদ ইছমাইল, মাতা গুলনাহার বেগম, ৭ ভাই ৪ বোনের মাঝে হারুন ছিলেন সবার বড়। ১১ ডিসেম্বর ছিল ৫০ তম শাহাদাতবার্ষিকী।
তিনি আমার পরম আত্মীয়, তার ছোট ভাই আব্বাস উদ্দীন আমার বেয়াই, তার মুখ থেকে এই দুঃসাহসী ছাত্র নেতার কৈশোর থেকে যৌবন পর্যন্ত সংগ্রামী জীবনের অনেক অজানা কথা জেনেছি। বর্তমানে তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যরা সামাজিক ও ব্যবসায়িকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত। এস.এস.সি পাস করার পর আন্দোলন সংগ্রামের সুতিকাগার চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপিঠ সিটি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে ভর্তি হন। পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে পরবর্তীতে ডিগ্রীতে ভর্তি হন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাহসী ও মেধাবী ছাত্রনেতা, ’৬৯ এর গণ আন্দোলনে ছাত্র সমাজের কেন্দ্রবিন্দু ছিল সিটি কলেজ। সেই সময় শহর ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন বাঁশখালীর কৃতী সন্তান বঙ্গবন্ধু হত্যার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদকারী শহীদ মৌলভী সৈয়দ আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক চট্টলবীর এ.বি.এম মহিউদ্দীন চৌধুরী। শহীদ হারুনুর রশিদ ছাত্রলীগের নির্বাচনী দল অভিযাত্রিকের মনোনয়ন নিয়ে সিটি কলেজ ছাত্র সংসদ এর ভিপি নির্বাচিত হন। পাকিস্তানের সামরিক শাসক কুখ্যাত আইয়ুব, মোনায়েম স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন নির্ভীক সাহসী লড়াকু সৈনিক। তিনি চট্টগ্রামের প্রথম সারির একজন ছাত্রনেতা। ১৯৭০ এর ডিসেম্বর মাসে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের নির্বাচিত করার জন্য নিরলস পরিশ্রম করেন তিনি। এম.এ আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরী সেই সময় চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি সরাসরি জহুর আহমদ চৌধুরীর অনুসারী ছিলেন এবং তার ছেলে শহীদ সাইফুদ্দীন ছিলেন শহীদ হারুনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, আরেক বন্ধু ছিলেন বাকলিয়ার ইদরিস আলম। সেই সময় তাদের আড্ডা ছিল রিয়াজউদ্দীন বাজারের মুখে পুরাতন রেলষ্টেশনের কাছে বর্তমান সিটি কর্পোরেশনের মোটেল সৈকত নামে পরিচিত রেস্ট হাউজে। সেই রেস্ট হাউজের একটি কক্ষে শহরের প্রায় ছাত্রনেতারা উপস্থিত থাকত। সকল আন্দোলন সংগ্রাম সেখান থেকে আবর্তিত হতো। চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা আন্দোলনের আঁতুড়ঘর ছিল সেই রেষ্ট হউজ। ’৭০ এর নির্বাচনে রাউজানে মুসলিম লীগের প্রার্থী ফজলুল কাদের চৌধুরীর বিপরীতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন দৈনিক আজাদীর তৎকালীন সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। ভোটে হেরে গিয়ে ফজুলুল কাদেরের সন্ত্রাসী বাহিনী হিন্দুদের ঘর বাড়ি পোড়াসহ আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের উপর অমানসিক নির্যাতন চালিয়েছেন। ১৯৭০ এর ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন হওয়ার কথা। ১০ ডিসেম্বর বহু প্রচার প্রচারণায় হাটহাজারী রাঙ্গুনিয়া হয়ে রাউজানে পথ সভা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু সাথে ছিলেন হারুনুর রশিদ। ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু এলাকা পরিদর্শন শেষে ফেরার পথে রাউজান নতুন বাজার নামক স্থানে বঙ্গবন্ধুর গাড়িতে একটি পুলিশের গাড়ি বার বার ধাক্কা দেয়ার চেষ্টা করে, হারুনুর রশিদ সহ আরো ছাত্র নেতারা সেই জীপটিতে ছিলেন এবং তারা পুলিশের গাড়িটিকে বাধা প্রদান করেন। পুলিশের গাড়িটি ধাক্কা দিয়ে হারুনুর রশিদদের বহনকারী গাড়িটি উল্টে দেন। ঘটনাস্থল থেকে দ্রুত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করলে বিকাল ৫ টার দিকে তিনি মারা যান। পুলিশের ধারণা ছিল জীপটিতে বঙ্গবন্ধু ছিলেন। কারণ বঙ্গবন্ধু একটির পর একটি জীপ পরিবর্তন করেছিলেন। নিজের প্রাণের বিনিময়ে হারুন ভাই বঙ্গবন্ধুর প্রাণ রক্ষা করেন। জীপ গাড়িতে থাকা সফর আলী, ফিরোজ আহমদ, কামাল, মধু ও উত্তম সহ আরো অনেকেই মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন। মৃত্যুর পর তার লাশ যখন মাদার বাড়ী দারোগাহাটস্থ ধনা সওদাগর লেইন নিজ বাড়িতে আনা হয়েছিল তখন সর্বস্তরের মানুষের ঢল নেমেছিল। সেখানে বঙ্গবন্ধু রাতে শহীদ হারুনের বাড়িতে এসে তার শোকাহত পিতাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন আজ থেকে আমি আপনার সন্তান। হারুনের মা আমার মা। তিনি হারুনের মৃত্যুকে শহীদি মৃত্যু বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। বলেছিলেন আজ নতুন এক শহীদের নাম দেশের রাজনীতির ইতিহাসে যুক্ত হলো। বঙ্গবন্ধু শহীদ হারুনের শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছিলেন। ১২ ডিসেম্বর লালদিঘির ময়দানে তাঁর নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। বাঙালি জাতির অধিকার আন্দোলন সংগ্রামে খুব অল্প বয়সে তিনি শহীদ হয়েছিলেন।
’৬৯ এর গণ আন্দোলনে আইয়ুব-মোনায়েমের লেলিয়ে দেওয়া পুলিশ বাহিনীর অত্যাচারে পুরো পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। সেই দিন দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া ছাত্রনেতা আলহাজ্ব সফর আলী (বর্তমান জাতীয় শ্রমিক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি) গত ১১ ডিসেম্বর তাঁর ৫০তম শাহাদাত বার্ষিকীতে স্মৃতিচারণমূলক বক্তব্যে অনেক অজানা কথা আমাদের জানিয়েছেন। শহীদ হারুনের মা বেঁচে থাকা অবস্থায় প্রতি বছর ১৫ আগস্ট আসলে কুরআন খতম ফাতেহা পাঠ এবং এতিম মিসকিনদের খাবার খাওয়াতেন। অত্যন্ত পর্দানসীন ও ফরহেজগার মহিলা ছিলেন তিনি। পুত্র ও আগস্টের শোকে সব সময় চোখের পানি ফেলতেন। আর দোয়া চাইতেন আল্লাহর দরবারে পুত্র ও বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নিহতরা যেন জান্নাতবাসী হয়। শহীদ হারুনের মা ২০০৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর সকল মায়া ত্যাগ করে আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে যান। তার পরিবার চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র আলহাজ্ব আ.জ.ম. নাছির উদ্দীনের কাছে কৃতজ্ঞ, তাকে তাঁর আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ মরণোত্তর একুশে পদক (চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন) ২০২০ প্রদান করেছিলেন। বর্তমান আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র পদপ্রার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা এম. রেজাউল করিম চৌধুরী তাঁর গ্রন্থে হারুনুর রশিদের আত্মত্যাগের কথা তুলে ধরেছেন। ছাত্রজীবনে তিনি অত্যন্ত মেধাবী ও বিচক্ষণ ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এস.সি তে ভর্তি হয়েছিলেন পিতামাতা অনেক কষ্ট করে তাকে লেখাপড়া করিয়েছিলেন। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, গত ৫০বছরে এই বীরের স্মরণে ব্যাপক আকারে কোন রাজনৈতিক কর্মসূচী পালিত হয়নি। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে হয়ত তাঁর ইতিহাস অন্যাভাবে লিখা হত। তেজস্বী টকবগে এক যুবককে বিস্তৃতির অতলে হারিয়েছি আমরা। সময়ের এক সাহসী ঠিকানা আজ আর আমরা খুঁজে পাই না। জাতির পিতার প্রাণ রক্ষা করে যে যুবক নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন সেই বীরের কথা আজ আর কেউ স্মরণ করেনা! মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন, তিনি যেন শহীদ হারুনের স্মৃতি রক্ষার্থে এমন কিছু করেন যাতে প্রজন্ম জানতে পারে শহীদ হারুনের মহান আত্মদানের কথা।
লেখক: শ্রম সম্পাদক, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ