ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার দক্ষিণের রাফা অঞ্চলে ইসরায়েলের সামরিক অভিযান অবিলম্বে বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত–আইসিজে। দক্ষিণ আফ্রিকার করা মামলার শুনানিতে গতকাল শুক্রবার এ আদেশ দিয়ে হেগভিত্তিক জাতিসংঘের এ শীর্ষ আদালতের প্রেসিডেন্ট নওয়াফ সালাম বলেন, যত দ্রুত সম্ভব রাফা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার করতে হবে।
রয়টার্স জানিয়েছে, সামরিক অভিযান বন্ধে নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের কথা বলেছে আইসিজে। রাফার মিশর সীমান্ত ক্রসিং মানবিক ত্রাণ প্রবেশের জন্য খুলে দেওয়া, গাজায় তদন্তকারীদের প্রবেশ নিশ্চিত করা এবং ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনকে গাজায় ঢোকার অনুমতি দেওয়ার নির্দেশও রয়েছে এর মধ্যে। এসব নির্দেশ পালনের অগ্রগতি জানিয়ে ইসরায়েলকে এক মাসের মধ্যে আইসিজেতে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে আদেশে। খবর বিডিনিউজের।
১৫ জন বিচারক নিয়ে পরিচালিত আইসিজের প্রধানকে ‘প্রেসিডেন্ট’ বলা হয়। গতকালের আদেশের বিষয়ে ১৩ জন বিচারক একমত হয়েছেন। বর্তমানে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করা নওয়াফ সালাম আদেশে বলেন, এখন সেখানে যে পরিস্থিতি, তাতে গাজার নাগরিকদের আরও ক্ষতি হওয়ার অনেক বেশি ঝুঁকি রয়েছে। গাজা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঠেকাতেই আইসিজের এ আদেশ।
ফিলিস্তিনের জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে গাজায়, বিশেষ করে রাফায় ইসরায়েলের অভিযান বন্ধে আইসিজের জরুরি ব্যবস্থা চেয়ে গত সপ্তাহে আবেদন করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। এর পরিপ্রেক্ষিতে এমন আদেশ এল। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গাজায় ‘গণহত্যা’র চালানোর অভিযোগে দক্ষিণ আফ্রিকা চলতি বছরের জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক এই আদালতে মামলা করে। তাতে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার মত বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেই বৃহত্তর মামলার অংশ হিসেবেই দেশটি পরে রাফায় অভিযান বন্ধে আদালতের কাছে জরুরি ব্যবস্থা চেয়ে আবেদন করে।
আলজাজিরা লিখেছে, ইসরায়েলের হামলায় গাজার অধিকাংশ অঞ্চল তছনছ হয়ে যাওয়ায় দিশেহারা ফিলিস্তিনিরা রাফায় আশ্রয় নিতে শুরু করে, যেখানে এখন ৮ লাখের বেশি উদ্বাস্তু রয়েছে। অন্যান্য অঞ্চলে অভিযান শেষ করে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশের উদ্বেগ–উৎকণ্ঠা উপেক্ষা করে রাফা অভিযানে নামে ইসরায়েল। এর সম্ভাব্য ‘বিধ্বংসী পরিণতি’ ঠেকাতে আইসিজেতে দক্ষিণ আফ্রিকা আবেদন করলে তার বিরোধিতা করে ইসরায়েল। গত ১৭ মে দক্ষিণ আফ্রিকা আবেদনের পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলে, ফিলিস্তিনকে দুনিয়া থেকে মুছে ফেলতে চায় ইসরায়েল। এ লক্ষ্য পূরণে তারা রাফায় চূড়ান্ত অভিযান চালাচ্ছে। এ যুক্তি উপস্থাপন করে গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার, যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠা এবং রাফা শহরে হামলা বন্ধে জরুরি ভিত্তিতে নির্দেশ দিতে আদালতের কাছে অনুরোধ জানায় দক্ষিণ আফ্রিকা। পরদিন শুনানিতে ইসরায়েলের আইনজীবীরা আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেন, হামাস যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার্থেই গাজায় সামরিক অভিযান চালাচ্ছে ইসরায়েল। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যারিস্টার ভেগান লোয়ে কেসি আদালতকে বলেন, গাজা এবং এর ফিলিস্তিনি জনগণকে ‘ধ্বংস করার জন্য’ ইসরায়েলের সর্বশেষ পদক্ষেপ হচ্ছে রাফা অভিযান।
১৮ মে উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়। গত বৃহস্পতিবার আইসিজে জানায়, শুক্রবার এ বিষয়ে আদেশ দেওয়া হবে। গতকাল সেই আদেশ দিয়ে আদালতের প্রেসিডেন্ট নওয়াফ সালাম বলেন, গাজার অবস্থা ‘বিপর্যয়কর’। সেখানকার ৮ লাখ উদ্বাস্তু মানুষের নিরাপত্তা ও মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করার যে কথা ইসরায়েল দিয়েছিল, তারা তা পালন করেছে বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
দক্ষিণ আফ্রিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী নালেদি প্যানদর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আইসিজের আদেশকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, আমার বিশ্বাস, যুদ্ধ বন্ধে এ আদেশ খুবই শক্তিশালী আইনি ভিত্তি করে দিল। আইসিজের এ আদেশের পক্ষে সমর্থন দিতে জাতিসংঘ সদস্য দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন নালেদি প্যানদর।
আলজাজিরা জানিয়েছে, এ আদেশকে স্বাগত জানিয়েছে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ ও হামাস। তবে তাদের ভাষ্য, অভিযান বন্ধের এ নির্দেশ কেবল রাফার জন্যই নয়, বরং পুরো গাজার জন্য প্রযোজ্য হওয়া উচিত ছিল। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র নাবিল আবু রুদেইনা রয়টার্সকে বলেছেন, এ আদেশ গাজা উপত্যকায় যুদ্ধ বন্ধে আন্তর্জাতিক মতৈক্যের প্রতিফলন।
এদিকে ইসরায়েল সরকারের মুখপাত্র ডেভিড মেনসার বিবিসিকে বলেছেন, হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বন্ধ করা মানে প্রকাশ্যে ‘আত্মহত্যা’। বিশ্বে এমন কোনো শক্তি নেই, যা আমাদের প্রকাশ্যে আত্মহত্যা করার দিকে ঠেলে দেবে। কারণ, হামাসের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ বন্ধ করাটা সে রকমই ব্যাপার। আদেশের পর ইসরায়েল কী করবে, তা নিয়ে ‘যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার’ সদস্যদের নিয়ে জরুরি বৈঠক ডেকেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। যুদ্ধপরাধবিষযক আইনজীবী রিড ব্রোডি আলজাজিরাকে বলেছেন, আইসিজের কাছ থেকে খুবই সুনির্দিষ্ট আদেশ এসেছে। রাফায় সংঘাত বন্ধ, ত্রাণের জন্য সীমান্ত খুলে দেওয়া এবং তদন্তকারীদের প্রবেশ করতে দেওয়ার মত বিষয় এসেছে। এলোমেলো কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে নজিরবিহীন হামলা চালায় এবং কয়েকশ মানুষকে জিম্মি করে। তার প্রতিশোধ নিতে পাল্টা হামলা চালায় ইসরায়েল, যাকে ‘যুদ্ধ’ দাবি করে টানা সামরিক অভিযান চালিয়ে আসছে দেশটি। কথিত এই যুদ্ধে ইসরায়েলের হামলায় ৩৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যার এক–তৃতীয়াংশের বেশি শিশু। বহু অন্তঃস্বত্ত্বা নারীসহ বেসামরিক ফিলিস্তিনির প্রাণ গেছে এই অভিযানে, যার বিচার চেয়ে আইসিজিতে মামলা করে দক্ষিণ আফ্রিকা। সেই মামলায় গতকাল অন্তর্বতী আদেশ দিল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের শীর্ষ এ আদালত। তবে এ আদেশ মানতে ইসরায়েলকে বাধ্য করার উপায় খুব কমই রয়েছে আদালতের।
আইসিজে পরিচালনার আইনিভিত্তি রোম সংবিধিতে (রোম স্ট্যাটিউট) ইসরায়েল স্বাক্ষর করেনি। অর্থাৎ, তারা আইসিজের সদস্য নয়। ফলে ইসরায়েল আদেশ মানবে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। অবশ্য ফিলিস্তিন রোম সংবিধিতে স্বাক্ষর করেছে। আর আইসিজের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, ভুক্তভোগী হিসেবে কোনো সদস্য দেশ অ–সদস্য দেশের বিরুদ্ধে মামলা করলে তার ওপর দেওয়া রায় বা আদেশ পক্ষভুক্ত সবার জন্য প্রযোজ্য হতে পারে।
আইসিজের আদেশ আসার কয়েক মিনিট পরেই রাফার বাবৌরা অঞ্চলে ইসরায়েল সিরিজ হামলা চালিয়েছে বলে জানিয়েছে বিবিসি।