মীরখানার ফকিরি : জীবনের অর্থ খোঁজার ব্যাকুলতা

রিজোয়ান মাহমুদ | বৃহস্পতিবার , ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ at ৬:৩২ পূর্বাহ্ণ

বাউল ফকিরি গান ও কবিতা এই উপমহাদেশের অবিরাম অভ্যস্ত চর্চার বিষয়। নিজেকে পুনঃ পুনশ্চ সন্ধান করা এবং গহীন ভেতরে ঐক্য ও সমতার কাজ করা এর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। হাজার বছরের বাংলার ফকিরি গান বা কবিতা আমাদের শেখায় সংকীর্ণ গণ্ডির ঊর্ধ্বে উঠে, সেই একেশ্বরবাদের সন্ধান করতে যা এই উপমহাদেশের সুফি মানবিক সাধনা। সারা দুনিয়া যখন বিভিন্ন শ্রেণি বিভাজনে আক্রান্ত, তখনই ফকিরি বা তান্ত্রিক সাধনা সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি বা সমপ্রদায়ের বিভেদ ও সাংস্কৃতিক সংঘাত নিরসনে বড় ভূমিকা রেখেছিল। বিবেকী ও সুস্থ কবি সাহিত্যিকের দায়বদ্ধতা জাতিগত বৈষম্য এবং নিপীড়ন দূর করে সুস্থ সমাজ বিনির্মাণে এগিয়ে আসা। বাউল কবিতা বা ফকিরি শক্তিকে রবীন্দ্রনাথ বহু আগেই আবিষ্কার করেছিলেন স্বভাবসুলভ বাউলিপনায়।

মীরখানার ফকিরি কবিতা বইয়ে চারলাইনের অন্ত্যমিলে আমি দেখাতে চেষ্টা করেছি, সেই সুরের আবেশ এবং প্রকাশঘন ঐকতান। এখানে মানবিকতা, মরমিবাদ ও প্রেম সাধনা দর্জিবাড়িতে আতিথ্যগ্রহণ করেছে অবলীলায়। সম্পূর্ণ গ্রন্থে খেয়াল করলে উপলব্ধ হবে আজকের বিপর্যস্ত মানুষের জীবনের সুখ ও দুঃখের নব পরাগায়ণ ঘটেছে কবিতায়। ব্যক্তি মানুষের অন্তর্গত কষ্টের চেয়ে বিশ্বমানবতার সামষ্টিক কষ্ট অসহায়ত্ব, অবিকশিত দার্শনিক নির্যাস উদ্ধারে ব্রত গ্রহণ করা হয়েছে । এই কারণে চতুর্পদী সব কবিতা সাধারণ ব্যক্তি কেন্দ্রিক দুঃখ কষ্টের নয়, গভীর ভাবকেন্দ্রিক এবং মানবিক। কবিতার অবিমিশ্র ভাবনায় যেমন পারস্যের হাফিজ, খৈয়াম, সাদি ও ফরিদউদ্দিন আত্তারের অসামপ্রদায়িক আধ্যাত্ম চেতনা, তেমনিভাবেই ভারতবর্ষের মীর তকি মীর এ বিশেষ সংলগ্ন থেকে মীর্জা গালিব ও ইকবাল এ, গভীর অনুরাগ। মীরের গজল আমাকে বেশি টেনেছে। মীরের কথার ফল্‌গুধারায় আমি একাকীত্ব বোধ করেছি। বিপন্নবিস্ময়ের তকমা খুঁজে পেয়েছি। আবার অসহ্য মানুষিক কষ্ট থেকে নির্বাণ লাভ করেছি। সরাসরি মীরের নাম উচ্চারণে সাধুসঙ্গের অভাজন আমি ভিন্ন এক রুবাইয়াত সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছি হরহামেশা। মীরখানার ফকিরি, সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিক মরমিকাব্য নয়, বরং তারই নির্যাসে রচিত ভাষা প্রবাহে আজকের কঠিন সময় রূপক বাস্তবতা নিয়ে ভিন্ন এক কবিতা কলাকেন্দ্র।

আমাদের উপমহাদেশের শিল্প সংস্কৃতি সাহিত্যে কতটা উর্বর এবং কতটা বন্ধ্যা আমরা বেমালুম ভুলে যাই। এখানে আধ্যাত্মিকতা মরমিবাদ, ভাববাদ, নিজের জাতিসত্তার উপাদানের সংমিশ্রণে মিশ্র সর্বসম্মতভাব বিবিধ সময়ে প্রচারিত হয়েছে, এতে অনেকেই ধর্মের দোহাই দিয়ে চর্চার ক্ষেত্র বন্ধ করেছে। এই উপমহাদেশ বিচিত্র এক মনভূমি মনন চিন্তার ক্ষেত্রে। অথচ ইউরোপীয় প্রগতির কথা বলে নিজস্ব দর্শনকে ভিক্ষার দর্শনে পরিণত করেছে বাঙালি। মানুষ যেমন ইতিহাসে বৈজ্ঞানিক ধারাবাহিকতা তেমনি বিবিধ জাতপাতধর্মের সংস্কৃতিতে ভিন্ন এক প্রবাহেরও মানবিক দলিল। এখানে আবেগ, ভালোবাসা, মমত্ববোধ ও স্নেহশীলতা পারিপার্শ্বিক সমাজ বাস্তবতার উল্লেখযোগ্য অংশ। আমাদের অভ্যস্ত বাস্তবতা রয়েছে সাহিত্যের চরিত্র বাস্তবমুখীতার চেয়ে ফ্যান্টাসি উতুঙ্গ কল্পনাকে আশ্রয় করে রচিত হতে হবে। থাকতে হবে মেটাফোর, সিমিলি, এলিটারেশন, থাকতে হবে হাই ইমাজেনেশন। হ্যাঁ একথা ঠিক ভবিষ্যৎ এর জন্য হাই ইমাজেনেশন দরকার আছে, সময়কে ধরা ও বোঝার জন্য। কিন্তু নিজের জাতিগঠনের সামাজ বাস্তবতার নিরিখে যে জীবনবোধ তা কি পরিত্যক্ত হবে? একটা জাতির ভাববিশ্ব তৈরি হয় সে জাতিগোষ্ঠীর স্বকীয় স্বতন্ত্র অভিনিবেশ সহযোগে। মরমিবাদ অধ্যাত্ম উপলব্ধি চিরায়ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অতি তুচ্ছ কিছু নয়, বরং নিজের আত্মপরিচয়ের খতিয়ান। মীরখানার ফকিরির মধ্যে আছে সে তবক আজকের সময় জ্ঞান কে সনাক্ত করে। এখানে সংস্কৃতি বৃহত্তর ভাবনা নিয়ে প্রকাশিত। এখানে প্রশ্ন ও উত্তর খোঁজা হয়েছে সময়ে ঘটে যাওয়া অনেক বিষয়ের অনুপুঙ্খসমেত বিশ্লেষণ নিয়ে। নতুন জিজ্ঞাসার আলোকে সাজানো হয়েছে বিনির্মিত সাহিত্য প্রক্রিয়া।

পুরো গ্রন্থ একাশিটা চতুর্পদী কাব্যের একটা ভিন্ন নন্দনকানন।

বহু বিচূর্ণ অনুভূতিময় চতুর্পদী কবিতা এই গ্রন্থে সন্নিবেশিত আছে। পারস্যের কবি ওমর খৈয়াম, সুফি সাধক এবং মসনবির কবি সুফি মৌলানা জালালুদ্দিন রুমির করণ কৌশল কিছুটা অনুসরণ করে ভারতের দিল্লির গজলের ঈশ্বর সতের শতকের কবি যিনি একাধারে মর্সিয়া, মসনবি, কসিদা, সেহরা, সলাম লিখে বিখ্যাত কবি ও গজল সঙ্গীতকার হিসেবে বরেণ্যজন। যিনি খোদাই সুখুন উপাধি প্রাপ্ত, তিনি আর কেউ নন, অবিসংবাদিত গজল স্রষ্টা মীর তাকি মীর এর নির্যাস নিয়ে মীরখানার ফকিরি। সামপ্রতিক সময়ের চিত্র, সমাজ বাস্তবতা, রাজনীতি, চিরায়ত সংস্কৃতি এবং প্রেমের নতুন বেহাগে উপস্থাপিত করার চেষ্টা করেছি চতুর্পদে। এখানে যেমন আত্মজিজ্ঞাসা, আত্মনিমগ্নতা, আত্মোপলব্ধি, ও আত্মশুদ্ধির বিষয়গুণে আবর্তিত তেমনিভাবে জীবনকে মরমি দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার ইচ্ছাও কাজ করেছে । এই উপমহাদেশ পাহাড় পর্বত সাগর বিধৌত অঞ্চলের শুদ্ধ পুণ্যভূমি। কবি, বাউল, চারণকবি, দরবেশ ও বারআউলিয়ার আস্তানা। বাউলগান ও একতারার সুরের মোহন ইন্দ্রজালে লুব্ধক এই জনপদ সাধারণ মানুষের আবেগে আবিষ্ট । বিবিধ জনস্রোত ও সাংস্কৃতিক মানস সম্পদ নিয়ে একটি ঘূর্ণাবর্ত তৈরি হয়েছে এই উপমহাদেশে সেই প্রাচীন কাল থেকে। এখানকার স্থানিক পারিপার্শ্বিকতার কারণে যেমন বাউল সুফি দরবেশদের জায়গা তেমনি সংগ্রামী জেলে লবনচাষী খেটেখুটে খাওয়া মানুষের জীবন জীবিকার অন্বেষণে এগিয়ে থাকা একটি সংগ্রামী জনপদ। মীরখানার ফকিরিধারণ করেছে এরকম সহস্রাধিক অনুষঙ্গ যা কালের যাত্রাপথের শুরুর সৌন্দর্য। সুফি সাধকেরা স্রষ্টা কে খোঁজেন ব্যকুল তৃষ্ণা নিয়ে। রক্তাক্ত হতে হতে যখন বুকের মেঘালয় শূন্য, না পেয়ে ফিরে যাবার তাড়া খেয়ে আবারও খোঁজবার উদগ্র আগ্রহ, তৈরী হতে দেখা যায়। অর্থাৎ খোঁজার ব্যাকুলতা শেষই হয়না। সেই সুফিবাদ! মীরখানার ফকিরিতত্ত্ব মীরের শুদ্ধ আত্মা নিয়ে উপস্থিত থাকতে চেয়েছে মানব মনের জখম উপশমের জন্যে। গ্রন্থটির ফ্ল্যাপ লিখেছেন দোঁহা কবি ইউসুফ মুহম্মদ। প্রকাশ করেছে শৈলী প্রকাশন, চট্টগ্রাম।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেওয়ানী মামলার বিভিন্ন ধাপসমূহ
পরবর্তী নিবন্ধড. মঈনুল ইসলামের কলাম