মাছের ট্রালারে চাকরি দেওয়ার কথা বলে ৫৬ দিন আগে বাকলিয়ার বাস্তুহারা কলোনি থেকে ৪ কিশোরকে নিয়ে যাওয়া হয় টেকনাফ। সেখান থেকে বিভিন্নভাবে হাতবদল হয়ে ওই চার কিশোরকে সমুদ্রপথে নিয়ে যাওয় হয় মিয়ানমারের সামিলা নামক এলাকার গভীর জঙ্গলে। সেখানে একটি এলাকায় নিয়ে জিম্মি করে রাখা হয়। চালানো হয় নির্যাতন।
পুলিশের বিভিন্ন ধরনের তৎপরতা ও অভিযানের মুখে এই ৪ কিশোরকে বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী লম্বরীঘাট নামক সাগরপাড়ে ফেলে যায় অপহরণকারী চক্র। গতকাল ভোরে সেখান থেকে তাদের উদ্ধার করেছে বাকলিয়া থানা পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হয়েছে অপহারণকারী চক্রের ৫ সদস্যকে। তাদের কাছ থেকে পুলিশ পেয়েছে কঙবাজার–মিয়ানমার সীমান্ত ব্যবহার করে গড়ে ওঠা শক্তিশালী একটি অপরাধী সিন্ডিকেটের তথ্য, যেটি নিয়ন্ত্রণ করছে মূলত রোহিঙ্গা অপরাধীরা। গতকাল রাতে আজাদীকে এই তথ্য জানিয়েছেন নগরীর বাকলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুর রহিম।
উদ্ধারকৃত কিশোররা হলো বাকলিয়া বাস্তুহারা কলোনির আব্দু শুক্কুরের ছেলে আনসারুল করিম (১৬), মো. জাকির হোসেনের ছেলে মনির (১৩), আব্দুল আলমের ছেলে আজিজুর রহমান (১৬) ও মোখলেসুর রহমানের ছেলে মজিবুর রহমান (১৭)। উদ্ধারের পর তারা জানায়, টেকনাফ থেকে যে বড় নৌকায় করে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেই নৌকায় নারীসহ আরো ৩১ জন ছিল। তবে তারা কারা, কী পরিচয় তা জানাতে পারেনি।
গ্রেপ্তার ৫ অপহরণকারী হলো আব্দুল করিম জীবন (১৯), হাকিম বাদশা (২২), মেহেদী হাসান (২৭), মো. হারুন (৩৭) ও নুরুল হক (৪৫)। তারা আজ মঙ্গলবার আদালতে জবানবন্দি দেবে।
ওসি আব্দুর রহিম আজাদীকে বলেন, ২ আগস্ট বাকলিয়া থানার বাস্তুহারা কলোনি বস্তি থেকে চার কিশোরকে অপহরণের অভিযোগে মামলা হয়। মামলার তদন্তে নেমে অপহৃতদের অবস্থান কক্সবাজারের টেকনাফে বলে তথ্য পাই। সেখানে অভিযান চালিয়ে জানতে পারি, তাদের মিয়ানমারে নিয়ে বন্দি করে রাখা হয়েছে।
মুক্তি পাওয়ার পর চার কিশোর পুলিশের কাছে সেখানে নির্যাতনের লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছে। তাদের তথ্যে ওসি জানান, সেখানে তাদের নিয়মিত মারধর করা হতো। তাদের কান্নার শব্দ ইমো নম্বরে কল দিয়ে শোনানো হতো বাংলাদেশে পরিবারের সদস্যদের।
পুুলিশ জানায়, গ্রেপ্তারকৃত অপহরণকারী মেহেদী হাসান পুলিশকে জানিয়েছে, চার কিশোরকে মাছ ধরার ট্রলারে চাকরি দেওয়ার কথা বলে সে টেকনাফে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের তুলে দেওয়া হয় হারুনের হাতে। হারুন তাদের পৌঁছে দেয় সাইফুল ইসলাম সাবু নামে একজনের কাছে। সাবু ও তার চক্রের কয়েকজন মিলে চার কিশোরকে সমুদ্রপথে পাচার করে দেয় মিয়ানমারের বুচিদং এলাকার জোবায়েরের কাছে।
এই ঘটনায় অপহৃত আনছারুল করিমের পিতা মোহাম্মদ আব্দুর শুক্কুর বাদী হয়ে বাকলিয়া থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় তিনি উল্লেখ করেন, আসামি আব্দুল গফুর প্রকাশ জীবন (১৯) গত ২ আগস্ট রাত সাড়ে ৮টায় বাদীর ছেলে আনছারুল করিমসহ তিনজন মো. মনির, আজিজুর রহমান ও মজিদুর রহমানকে মাছ ধরার ট্রলারে চাকরি দেওয়ার কথা বলে কঙবাজার জেলার মহেশখালী এলাকায় নিয়ে যায়। এরপর থেকে তার ছেলের কোনো খোঁজখবর না পাওয়ায় এবং তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়ায় তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েন। পরে তার সাথে যাওয়া অন্য ছেলেদের সাথে বাদীর ছেলে আছে কিনা জানার জন্য তাদের পিতামাতার সাথে যোগাযোগ করলে তারাও জানান, তাদের ছেলেদের সাথেও তারা যোগাযোগ করতে পারছেন না। তাদের মোবাইলও বন্ধ।
পরবর্তীতে মামলার বাদী মোহাম্মদ আব্দুর শুক্কুর তার ভাগিনা দুলালের ফেসবুক আইডি থেকে তার ছেলে এবং তার সাথে যাওয়া অন্য ছেলেদের ছবি ফেসবুকে আপলোড করলে ৪ আগস্ট বেলা ২টায় অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তি মোবাইল (+৯৫৯২৫৩০১৯৩৮৫) নম্বর থেকে তার স্ত্রী হোসনে আরা বেগমকে ফোন করে একটি ইমো নম্বর চায়। বাদীর স্ত্রী হোসনে আরা বেগম তার ভাগিনা দুলালের নম্বর দিলে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি দুলালের নম্বরে ইমোতে ভিডিওকলে বাদীর ছেলে এবং তার সাথে যাওয়া অন্য ছেলেদের দেখায়। বাদীর বিশ্বাস না হলে উক্ত নম্বর থেকে তার ভাগিনার ইমোতে তার ছেলেসহ অন্যদের ছবি পাঠায়। তখন ছবি দেখে বাদী নিজের ছেলে ও তার সাথে যাওয়া অন্যদের চিনতে পারে। পরবর্তীতে ওইদিন সন্ধ্যা ৭টায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি একই নম্বর থেকে বাদীর ভাগিনার ইমো নম্বরে ফোন করে। এ সময় বাদী ও তার ভাগিনাকে ওই ব্যক্তি তাদের ছেলেদের ফেরত পেতে হলে জনপ্রতি ৮০ হাজার টাকা তাকে দিতে হবে বলে জানায়। ওইদিন রাত ১০টায় ওই ব্যক্তি বাদীর মোবাইলে ফোন করে তার ছেলেসহ অন্যদের ফেরত নিতে হলে জনপ্রতি দেড় লাখ টাকা দিতে হবে বলে জানায়। ৪ জনের কাছ থেকে মোট ৬ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। বাদী অপহরণকারী দলের ওই ব্যক্তিকে তার ছেলে কোথায় আছে জিজ্ঞাসা করলে ওই ব্যক্তি বাদীর ছেলেকে তার সাথে কথা বলিয়ে দেয় এবং তার ছেলে মিয়ানমারে আছে বলে জানায়।
পরবর্তীতে একাধিকবার উক্ত নম্বর থেকে বাদীর ভাগিনাসহ বাদীর নম্বরে ফোন করে মুক্তিপণ দাবি করা হয়। কথামতো জনপ্রতি দেড় লাখ টাকা করে মুক্তিপণ দিলে চারজনকে ছেড়ে দেওয়া হবে বলে জানায়। তখন বাদী বিষয়টি তার ছেলের সাথে যাওয়া অন্য ছেলেদের পিতামাতাকে জানান। এই ঘটনায় ১১ আগস্ট বাকলিয়া থানায় মানব পাচার ও প্রতিরোধ দমন আইন ২০১২–এর ৭/৮/১০ ধারায় আরেকটি মামলা হয়।
এরপর সিএমপির উপ–পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমানের নির্দেশে অতিরিক্ত উপ–পুলিশ কমিশনার নোবেল চাকমা, সহকারী পুলিশ কমিশনার (চকবাজার জোন) মো. শহীদুল ইসলাম, বাকলিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ আবদুর রহিমের নেতৃত্বে মামলার তদন্তকারী অফিসার এসআই মো. আব্দুল কাদের অভিযান পরিচালনা করে ৫ জনকে গ্রেপ্তার করেন। এর মধ্যে ধৃত আসামি মেহেদী হাসান ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়ে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।