পটিয়া উপজেলার চারটি গ্রামকে পানি সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিতে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দিয়েছে হাই কোর্ট। একই সঙ্গে গ্রাম চারটির স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য নিয়মিত পানি সরবরাহে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব, পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক, জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক, পটিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান, জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশল অধিদপ্তর পটিয়ার সহকারী পরিচালকে নির্দেশ দেয়া হয়। এছাড়া এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন সাপেক্ষে তা আগামী তিন মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে নির্দেশনা দেয়া হয়।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) দায়েরকৃত একটি আবেদনের শুনানি শেষে বিচারপতি মাহমুদুল হক ও বিচারপতি মোঃ মাহমুদ হাসান তালুকদারের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বিভাগের ডিভিশন বেঞ্চ গতকাল মঙ্গলবার এ আদেশ প্রদান করে। বেলার পক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তাকে সহযোগিতা করেন অ্যাডভোকেট এস. হাসানুল বান্না।
গ্রাম চারটি হচ্ছে পটিয়া উপজেলার হাবিলাস দ্বীপ ইউনিয়নের চরকানাই, হুলাইন, পাচুরিয়া ও হাবিলাসদ্বীপ। এসব গ্রামে আটটি শিল্প প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ভূ–গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ২৬ নভেম্বর রিট পিটিশন (নং ৪৪০/২০১৫) দাখিল করে বেলা। আট শিল্প প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বনফুল এন্ড কোঃ (ফুড প্রোডাক্টস), বনফুল এন্ড কোঃ (মিনারেল ওয়াটার), আম্বিয়া নীটিং এন্ড ডাইং লিঃ, আম্বিয়া পাল্প এন্ড পেপার মিলস লিঃ, মোস্তফা পেপার কমপ্লেঙ লিঃ, হাক্কানী পাল্প এন্ড পেপার মিলস লিঃ, আনোয়ারা পেপার মিলস লিঃ ও শাহ্ আমানত নীটিং এন্ড ডাইং লিঃ।
বেলার রিট পিটিশনে অনুমোদনহীন ও অপরিকল্পিতভাবে গভীর নলকূপ স্থাপন ও ব্যাপক হারে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন, কারখানার বর্জ্য পার্শ্ববর্তী খাল ও কৃষি জমিতে নিক্ষেপ এবং প্রতিষ্ঠানগুলো পরিবেশের জন্য বিপজ্জনক ও দূষণযুক্ত পরিচালনার বিরুদ্ধে প্রতিকার চাওয়া হয়েছিল বেলার আবেদনে। বলা হয়, ভূ–গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ৩৫০টি টিউবওয়েল বিকল হয়ে পড়ে। এতে গ্রামগুলোর প্রায় ৩০ হাজার মানুষ সুপেয় পানির তীব্র সংকটে পড়ে।
বেলার আইনজীবী অ্যাডভোকেট এস. হাসানুল বান্না বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, পানি আইনের অধীনে দেশে কোনো এলাকাকে পানি সংকটাপন্ন এলাকা দাবি জানিয়ে বেলার রিট পিটিশনটি ছিল দেশের প্রথম আইনি কার্যক্রম।
তিনি জানান, আদালত পানি আইন, ২০১৩–এ ধারা (১৭)-এর অধীনে চরকানাই, হুলাইন, পাচুরিয়া ও হাবিলাসদ্বীপ গ্রামকে পানি সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণার বিষয়ে আগামী তিন মাসের মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। একইসাথে আদালত বিবাদী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভূ–গর্ভস্থ পানি উত্তোলন থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং জেলা প্রশাসককে আদালতে আটটি শিল্প প্রতিষ্ঠান কর্তৃক করা দূষণের পরিমাণ যাচাই করে তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন।
এস. হাসানুল বান্না জানান, ভবিষ্যতে এই চারটি গ্রামে বিকল্প পানির ব্যবস্থা না করে ভূ–গর্ভস্থ পানির উপর নির্ভর করে কোনো ‘লাল’ বা ‘কমলা–খ’ শ্রেণির শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হতে পারবে না। পটিয়া উপজেলায় পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়া এবং কার্যকরী বর্জ্য শোধনাগার প্ল্যান ছাড়া কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান যেন পরিচালিত হতে না পারে তা নিশ্চিত করতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছেন। আদালতের নির্দেশ প্রতিপালন বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে মেমো প্রস্তুত করে আদালতে দাখিলে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আদালতে পরিবেশ অধিদপ্তর, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপস্থাপিত বিভিন্ন প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে বলা হয়, গ্রামগুলোতে এখন আর হস্তচালিত পাম্প বা তারাটিউবওয়েলের মাধ্যমে পানি উত্তোলন সম্ভব নয়। ফলে সরকার মাটির ১৫০ মিটার নিচ থেকে পানি উত্তোলনে সক্ষম এমন পাম্প বসিয়ে এলাকাবাসীর পানির চাহিদা মেটাতে উদ্যোগ নিচ্ছে। তবে সরকারের এমন উদ্যোগ ক্ষয়িষ্ণু ভূগর্ভস্থ পানি স্তরের উপর আরো চাপ সৃষ্টি করবে আশঙ্কায় এ উদ্যোগের বিরোধিতা করে আদালতে বক্তব্য রাখেন বেলার আইনজীবীরা। এছাড়া শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো পার্শ্ববর্তী খালের পানি নিয়ে কার্যক্রম চালাবার অনুমতি চাইলে খালের পানি ইতোমধ্যে দূষিত হয়ে পড়েছে এবং তা পরিশোধন করে গ্রামের মানুষের পানির চাহিদা প্রথমে পূরণ করতে হবে–এমন যুক্তিতে বেলার পক্ষ থেকে বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়।