আমাদের জীবন ধারনের জন্য মৌলিক যে কতগুলো উপাদান রয়েছে, তার মধ্যে পানি অন্যতম। প্রতিটি জীবের বেঁচে থাকার জন্য সুপেয় পানি অপরিহার্য। তবে বিভিন্ন কারণে প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে পানি, বিপন্ন হচ্ছে জীবন। শুধু তাই নয়, নগরীর বিভিন্ন স্থানে রয়েছে পানি সংকট। পুরনো পাইপ লাইনের কারণে নগরীর অনেক এলাকায় ঠিক মতো পানি পৌঁছে না। এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক আজাদীতে গতকাল ১৩ অক্টোবর। সেই প্রতিবেদনে ৩শ কি মি নতুন পাইপ লাইন বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম ওয়াসার কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্পের অধীনে ‘শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার দ্বিতীয় প্রকল্পের’ সাথে মোট ৮শ’ কিলোমিটার পাইপ লাইন (ট্রান্সমিশন এবং ডিস্ট্রিবিউশন লাইন) বসানো হয়েছে নগরীতে। নগরীর প্রায় এলাকায় পুরনো পাইপ তুলে নতুন পাইপ বসানো হয়েছে এই প্রকল্পের মাধ্যমে। ২০২২ সালে এই প্রকল্প শেষ হয়েছে। কিন্তু নগরীর আরো বেশ কিছু এলাকায় এখনো পুরনো পাইপ রয়ে গেছে। পুরনো পাইপ লাইনের কারণে নগরীর অনেক এলাকায় ঠিক মতো পানি পৌঁছে না। পুরনো পাইপ লাইনে ভালোভাবে পানির প্রেসার দেয়া যায় না। অনেক এলাকায় পাইপ ফেটে পানি বাইরে পড়ে প্রতিনিয়ত নষ্ট হচ্ছে। নগরীর এসব এলাকায় নির্বিঘ্নে পানি পৌঁছানোর লক্ষ্যে চট্টগ্রাম ওয়াসা বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে নগরীতে আরো ৩শ’ কিলোমিটার পাইপ লাইন বসানোর উদ্যোগ নিয়েছে। চট্টগ্রাম ওয়াসার এখন দৈনিক পানি উৎপাদন ক্ষমতা ৫০ কোটি লিটার। নগরবাসীর চাহিদাও ৫০ কোটি লিটার। উৎপাদন এবং চাহিদা সমান সমান হলেও পুরনো পাইপ লাইনের কারণে অনেক এলাকার বাসিন্দা ওয়াসার পানির সুফল পাচ্ছেন না। এই সমস্যা দূর করতে নগরীতে নতুনভাবে আরো ৩শ’ কিলোমিটার পাইপ লাইন বসানো হবে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম। চট্টগ্রাম ওয়াসা সূত্রে জানা যায়, নতুন এই প্রকল্পের আওতায় নগরীর সর্ব দক্ষিণে সাগর তীরবর্তী উত্তর ও দক্ষিণ পতেঙ্গাসহ পুরো নগরী নতুন পাইপ লাইনের আওতায় চলে আসবে। তখন পানি সরবরাহ আর বাধাগ্রস্ত হবে না।
পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, বিশ্বের মোট পানির মাত্র ১% সুপেয় পানি, যার ৯৯% আসে ভূগর্ভস্থ পানি সরবরাহ ব্যবস্থা থেকে। মনুষ্যসৃষ্ট বিবিধ কারণে বিশ্ব আজ মারাত্মক সুপেয় পানির সংকটে। জাতিসংঘের সহযোগী বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (ডাব্লিউএমও) ‘স্টেট অব গ্লোবাল ওয়াটার রিসোর্সেস ২০২১’ প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বজুড়ে প্রায় ৩৬০ কোটি মানুষ সুপেয় পানির সংকটে ভুগছে। তারা বছরে অন্তত এক মাস এ ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। এ প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০৫০ সাল নাগাদ পানি সংকটে ভুগতে পারে বিশ্বের ৫০০ কোটি মানুষ। জার্মানির বন শহরে অনুষ্ঠিত ‘গ্লোবাল ওয়াটার সিস্টেম প্রজেক্ট’ শীর্ষক এক বৈঠকে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ৫০০ বিজ্ঞানীর এক যৌথ ঘোষণাপত্র অনুযায়ী মানুষের কর্মকাণ্ড (যেমন : ভূমিধস, দূষণ, নদী খনন ইত্যাদি) বিশুদ্ধ পানির সরবরাহে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। নদীর পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ স্তরের পানিও মানবসৃষ্ট কারণে দূষিত হচ্ছে। এ যৌথ ঘোষণাপত্রে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করেছেন, আগামী এক বা দুই প্রজন্মের মধ্যেই বিশ্বের ৯০০ কোটি মানুষের অধিকংশই বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকটের মধ্যে জীবনযাপন করবে। ডাব্লিওএইচও এবং ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বে ৭৮৫ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ মৌলিক অধিকার হিসেবে পানি সেবা পায় না এবং ৮৮৪ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ নিরাপদ পানি পান করতে পারছে না। এ প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের প্রায় ১.৬ বিলিয়ন মানুষকে নিরাপদ পানি ছাড়াই জীবনযাপন করতে হবে।
আজাদীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নগরবাসী এখন এই দুটি প্রকল্পে পানি পাচ্ছেন প্রতিদিন। এদিকে মদুনাঘাট শেখ রাসেল পানি সরবরাহ প্রকল্প থেকে দৈনিক ৯ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। সব মিলে চট্টগ্রাম ওয়াসার এখন দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা ৫০ কোটি লিটার। কিন্তু পুরনো পাইপ লাইনের কারণে নগরীর অনেক এলাকায় পানি সরবরাহ কিছুটা বিঘ্ন হচ্ছে।
অনেকের অভিযোগ, রেশনিং পদ্ধতিতে পানি সরবরাহ করলেও তাতে চাহিদা মিটছে না নগরবাসীর। আবার কোথাও পানি মিললেও অতিরিক্ত লবণাক্ত ও শ্যাওলাযুক্ত হওয়ায় পানি ব্যবহার ও পানের অনুপযোগী। নিরুপায় নগরবাসী এসব পানি পান করে আক্রান্ত হচ্ছেন পানিবাহিত রোগে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, দ্রুত এ সমস্যার সমাধান করতে না পারলে জনস্বাস্থ্য চরম হুমকির মধ্যে পড়বে। এ অবস্থায় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে নগরীতে আরো ৩শ কিলোমিটার পাইপ লাইন বাসানোর যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তা প্রশংসনীয়। এউদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে নগরীতে পানির সংকট কিছুটা মিটবে বলে আশা করা যায়। তখন নগরীর সর্বত্র সমানভাবে পানি পাওয়া যাবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।