সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে আন্দোলনে প্রাণহানি ও সহিংসতার ঘটনায় স্বচ্ছ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও স্বাধীন তদন্তের জন্য জাতিসংঘকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন দেশের ৭৪ জন নাগরিক। তারা বলেছেন, এই বিপুল প্রাণহানির দায় প্রধানত সরকারের। দেশবাসীকে কঠিন আত্মপ্রত্যয়ে দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে সক্রিয় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বানও জানান তারা।
গতকাল সোমবার এক বিবৃতিতে এসব আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, কোটা সংস্কারের দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর গত ১৬ জুলাই থেকে পুলিশসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন বাহিনী এবং তাদের পাশাপাশি সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল মন্ত্রীর প্ররোচনায় তাদের আর্শীবাদপুষ্ট ছাত্র সংগঠনের সহিংস কর্মীরা নজিরবিহীন দমন–পীড়নের তাণ্ডব চালিয়েছে।
ছাত্র আন্দোলনকে সরকারি দল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করতে চেয়েছে দাবি করে বিবৃতিদাতারা বলেন, বিরোধী পক্ষও তেমনি ছাত্র আন্দোলনের প্রতি সংহতির নামে একে নিজেদের রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের জন্য ব্যবহার করতে চেয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। খবর বিডিনিউজের।
ছাত্র–জনতা হত্যা ও জনগণের সম্পত্তি বিনষ্টের নাশকতার পেছনে যে কোনো ধরনের অপরাজনীতির নিন্দা করে বিবৃতিতে বলা হয়, সরকারের বল প্রয়োগে কমপক্ষে দুই শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, হাজার হাজার মানুষ গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন।
সহিংস ঘটনায় হতাহতের মধ্যে কয়েকজন আইন–শৃঙ্ঘলা বাহিনীর সদস্যও রয়েছেন। হতাহতের তালিকায় সংবাদকর্মীরাও আছেন বলেও উল্লেখ করা হয় এতে। হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা আরো অনেক ব্যাপক, অনেক ভয়াবহ বলে শঙ্কা প্রকাশ করে বিবৃতিতে বলা হয়, ইন্টারনেট ও গণমাধ্যমের উপর সরকারের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের কারণে আমরা জানতে পারছি না।
সরকারকে দায় দিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, সাংবিধানিক শপথ এবং আইন উপেক্ষা করে একাধিক মন্ত্রী যেভাবে চরম দায়িত্বহীন ভাষায় শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের উপর তাদের সমর্থক ছাত্রদের ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানালেন, তাতে সারা দেশ ও বিদেশে বাংলাদেশের জনগণ ও দেশের শুভকাঙ্ক্ষীরা স্তম্ভিত, গভীরভাবে ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত হয়েছেন।
আন্দোলন চলাকালে বেশ কিছু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, স্থাপনা ও সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উল্লেখ করে বলা হয়, যা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে এই সব নাশকতার জন্য যারা দায়ী তাদের চিহ্নিত করে আইন অনুযায়ী তাদের শাস্তির দাবি জানিয়ে বলা হয়, তবে এই অজুহাতে ভিন্নমতের কাউকে দমন–পীড়ন বা সাধারণ মানুষকে হয়রানি কোনোভাবেই সমর্থনীয় না।
নাশকতার ঘটনার সময় সরকার তা প্রতিরোধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়নি অভিযোগ করে বলা হয়, সরকারি বাহিনীগুলো কোনো কোনো ক্ষেত্রে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে বলে গণমাধ্যমের রিপোর্ট থেকে জানা যায়। সুষ্ঠু তদন্ত করে তাদের এই ভূমিকার রহস্য উদঘাটন এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা জরুরি।
প্রাণহানি, ছাত্র–জনতার উপর গুলির তদন্ত না করে পুলিশ শুধু নাশকতার মামলা করে হাজার হাজার অজ্ঞাতনামা লোককে আসামি, কয়েক হাজার লোককে গ্রেপ্তারের কথা উল্লেখ করে বলা হয়, এদের মধ্যে অসংখ্য নিরীহ নাগরিক, শিক্ষার্থী কিংবা তাদের পরিবারের সদস্যরা রয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
শিক্ষার্থী আন্দোলনের সমন্বয়ক ও কর্মীদের কয়েকজনকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগও আনা হয় বিবৃতিতে। চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় হাসপাতাল থেকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়াকে অত্যন্ত অনভিপ্রেত ও নিপীড়নমূলক বলেও মন্তব্য করা হয় এতে।
পুলিশ, র্যাব ও অন্যান্য বাহিনী ব্লক রেইড ও নির্বিচার গ্রেপ্তার করে জনমনে, পরিবারগুলোতে এবং তরুণ সমাজের মনে সীমাহীন ভীতি ও ত্রাসের সঞ্চার করেছে অভিযোগ করে বলা হয়, এতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে ওঠার বদলে আরো জটিল ও অশান্ত করে তোলার ইন্ধন যোগাবে বলে আমাদের আশঙ্কা।
দাবিগুলো : বিবৃতিতে বেশ কিছু দাবি তুলে ধরা হয়। এগুলো হলো ১. আন্দোলনকালে পুলিশ, র্যাব, অন্যান্য বাহিনী বা সরকারের মদদপুষ্ট বেসরকারি অস্ত্রধারীদের হাতে শিক্ষার্থী, শান্তিপ্রিয় নাগরিক, কিশোর–কিশোরী এমনকি শিশু নিহত, নির্যাতিত ও আহত হওয়ার প্রতিটি ঘটনার তদন্ত হতে হবে।
স্বচ্ছ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে এই তদন্ত করার স্বার্থে এটি জাতিসংঘের উচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ দলের তত্ত্বাবধানে হওয়া জরুরি বলেও মত দেওয়া হয় বিবৃতিতে। এ লক্ষ্যে জাতিসংঘকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করার আহ্বানও বিবৃতিদাতারা। বলা হয়, প্রকৃত দোষী যেই হোক, যত উচ্চ পদাধিকারী কিংবা যে কোনো দলমতের হোক, তাদের আইন অনুযায়ী শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
২. যারা নিহত, গুরুতর আহত হয়েছেন তাদের প্রতি সহানুভূতি, শ্রদ্ধা, সম্মান প্রদর্শনের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে যথাযথ মর্যাদায় শোক পালনের ঘোষণা দিতে হবে। এই ঘটনার শুরু থেকে এ পর্যন্ত কত লোক, শিক্ষার্থী, কিশোর–কিশোরী নিহত, আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার প্রকৃত সংখ্যা, নাম পরিচয় সরকারকে অবিলম্বে প্রকাশ করতে হবে।
৩. ‘মানুষের জীবন অমূল্য, কোনো কিছুতে এর ক্ষতিপূরণ হয় না’ মন্তব্য করে বিবৃতিতে বলা হয়, তারপরও এই সরকারের দায় মেনে নিয়ে প্রত্যেক নিহতের পরিবারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। যারা আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন তাদের সুচিকিৎসার পূর্ণ দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। যারা চোখ, হাত, পা হারিয়েছে তাদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে।
৪. কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক, সংগঠক, শিক্ষার্থীসহ সাধারণ নাগরিকদের সাজানো অভিযোগে আটক ও গ্রেপ্তারের বিবরণে ক্ষোভ ও নিন্দা জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদুল ইসলাম ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরসহ কাউকে কাউকে আটক করে যে ভয়াবহ নির্যাতন করা হয়েছে তা সংবিধানের লঙ্ঘন ও ফৌজদারি অপরাধ সমতুল্য। এসব অশুভ তৎপরতা বন্ধ করে, গণরুম ও টর্চার সেলকেন্দ্রিক নির্যাতনের অবসান ঘটানোর সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিয়ে এবং শিক্ষার্থীদের সকল দাবি মেনে নিয়ে সরকারকে শিক্ষাঙ্গনে সুষ্ঠু শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে।
নির্বিচার গ্রেপ্তার, আটক ও আটক রেখে বিবৃতি আদায়, দমন–পীড়ন, শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের স্বজনদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, পুলিশ ও র্যাবের লাগামহীন হয়রানি অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
৫. স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে কারফিউ তুলে নিতে হবে, দেশের ছাত্র–জনতাকে দমন–পীড়ন কিংবা ভয়–ভীতি প্রদর্শনের জন্য যে সকল সাঁজোয়া যান, হেলিকপ্টার ও অন্যান্য সরঞ্জাম রাস্তায় নামানো হয়েছে, অবিলম্বে তা স্ব স্ব স্থানে ফেরত নিয়ে যেতে হবে। অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করতে ইন্টারনেটের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণের অবসান করতে হবে এবং ভিন্নমতের মানুষকে হয়রানি ও তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বন্ধ করতে হবে।
যাদের নামে বিবৃতি : বিবৃতিতে যারা সই করেছেন তাদের মধ্যে আছেন মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল, হামিদা হোসেন, খুশী কবির, মেঘনা গুহঠাকুরতা, শামসুল হুদা, ফস্টিনা পেরেইরা, রুশাদ ফরিদী, নুর খান, রেজাউল করিম চৌধুরী, জাকির হোসেন, মাহিন সুলতানা, তাসনিম সিরাজ মাহাবুব, জাহানারা খাতুন, আরিফা হাফিজ, দীপায়ন খীসা।
অধিকার কর্মীদের মধ্যে আছেন ফজিলা বানু লিলি, ইশরাত জাহান প্রাচী, মুক্তশ্রী চাকমা, হানা শামস আহমেদ, এবং সাংস্কৃতিক কর্মী অরূপ রাহী। আইনজীবীদের মধ্যে আছেন জেড আই খান পান্না, শাহদীন মালিক, সারা হোসেন, সুব্রত চৌধুরী, তবারক হোসেন, শুভ্র চক্রবর্তী, শরীফ ভূঁইয়া, সাইদুর রহমান, প্রিয়া হাসান চৌধুরী, শারমিন খান।
এনজিও কর্মীদের মধ্যে আছেন রাশেদা কে. চৌধুরী, শিরিন হক, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, বদিউল আলম মজুমদার, শারমিন মুরশিদ। অর্থনীতিবিদদের মধ্যে আছেন ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, হোসেন জিল্লুর রহমান, আনু মুহাম্মদ, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
শিক্ষকদের মধ্যে আছেন আসিফ নজরুল, পারভীন হাসান, গীতি আরা নাসরিন, মো. তানজিমউদ্দিন খান, সুমাইয়া খায়ের, মুশতাক এইচ খান, মির্জা তাসলিমা সুলতানা, ফিরদৌস আজিম, বীনা ডি কস্তা, শাহনাজ হুদা, সাঈদ ফেরদৌস, রোবায়েত ফেরদৌস, নোভা আহমেদ, নাভীদা খান, সামিনা লুৎফা, ফারহা তানজিন তিতিল, মাইদুল ইসলাম, রিজওয়ানা করিম, সাইমুম রেজা তালুকদার।
গবেষকদের মধ্যে আছেন রেহেনুমা আহমেদ, রেজাউল করিম লেলিন, সাদাফ নুর, নাসরিন খন্দকার, স্বপন আদনান, দীনা সিদ্দিকী, রোজিনা বেগম, বারিশ হাসান চৌধুরী, রেজওয়ান ইসলাম। সাবেক ব্যাংকার নাসের বখতিয়ার, আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, সাঈদা গুলরুখ, সালিম সামাদ, লেখক আলতাফ পারভেজ, আহমেদ স্বপন মাহমুদও বিবৃতিতে সই করেন।