বহু বছর ধরে রুগ্ণ শরীর নিয়ে চলাফেরায় অক্ষম হয়ে তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন। মাহবুব ভাইয়ের (চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলনের শীর্ষ নেতা মাহবুব উল আলম চৌধুরী। তবে তাঁকে মানুষ চেনেন ভাষা আন্দোলনের ওপর রচিত প্রথম কবিতার জনক হিসেবে) ভাইপো খায়রুল আনোয়ারের কাছে তাঁর খবর নিতাম। তিনিও আমার খবর নিতেন, আমার অসুখের কথা তিনি গোড়া থেকেই জানতেন। তাঁকে নিয়ে একটা লেখা লিখবো লিখবো করেও লিখে ওঠার আগেই তিনি অন্তিম নিঃশ্বাস ফেলে মনেরও অগোচর হয়ে গেলেন। চোখের অগোচর তো ছিলেনই, এবার চলে গেলেন মনের কোণের বাইরে।
কার কথা বলছি, আশা করি এতক্ষণে আপনারা বুঝে গেছেন। তিনি জওশন আরা রহমান। অনেকের মধ্যে তিনি ছিলেন অনন্যা। ঊননব্বই বছরের জীবনে তিনি এত বিপুল মহৎ ও মানবিক কর্মপ্রচেষ্টার সঙ্গে নিজেকে জড়িত করেছিলেন যে তাঁর পরিচয় দিতে যাওয়া মনে হয় ধৃষ্টতা ছাড়া আর কিছু নয়।
বিশ শতকের দু’তিন দশক পর্যন্ত চট্টগ্রামের নারীজীবন ছিলো পর্দার ঘেরাটোপে ঢাকা। মুসলিম সমাজ সম্পর্কেই এটা বিশেষভাবে প্রযোজ্য। তবে হিন্দু, বৌদ্ধ সমাজও যে খুব একটা এগিয়ে ছিলো তা’ নয়। শিক্ষার কথা যদি ধরি, তাহলে দেখবো নারীকে শিক্ষার জন্য যোগ্যই মনে করা হতো না। তখন বাল্যকালে মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেত। এমনকি আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী মৃণালিনী দেবীও কবির সঙ্গে বিয়ের সময় একজন অল্পবয়স্ক বালিকাই ছিলেন। সমাজ মনে করতো নারীর শেষ গন্তব্য যখন স্বামীগৃহ, তখন এত লেখাপড়া শিখে আর কাজ কি।
চট্টগ্রাম কলেজে তখনো সহশিক্ষা চালু হয়নি। জননায়ক যাত্রামোহন সেন ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর স্ত্রী চট্টগ্রামের নবজাগরণের অগ্রদূত ডা. অন্নদাচরণ খাস্তগীরের কন্যা জিনাদনী দেবীর প্রয়াণের পর পরলোকগত স্ত্রী ও শ্বশুরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে অন্নদাচরণ খাস্তগীর প্রতিষ্ঠিত ভার্নাকুলার স্কুলকে ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে ডা. খাস্তগীর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বটে, কিন্তু তাতে ক’জনই বা ছাত্রী। হিন্দু–বৌদ্ধ পরিবার থেকেই ছাত্রী আসতো বেশি, এই সময় আমরা বিপ্লবী কন্যা প্রীতিলতা ও কল্পনা দত্তের সাক্ষাৎ পাই। মুসলিম পরিবার থেকে আগত তিনজন ছাত্রীর নাম পাচ্ছি। খান বাহাদুর আবদুল আজিজ বিএ’র নাতনি, নজরুল–খ্যাত নাহার–বাহারের নাহার অর্থাৎ শামসুন্নাহার মাহমুদ আসতেন রেয়াজুদ্দিন বাজার ‘আজিজ মঞ্জিল’ থেকে; খান বাহাদুর আবদুর রহমান দোভাষের কন্যা আমেনা ও জামেনা আসতেন ফিরিঙ্গীবাজার পৈতৃক বাসভবন থেকে পারিবারিক কারে করে। দোভাষ দু’কন্যাকে এত বেশি ভালোবাসতেন যে, তাদের নামে দু’টি জাহাজও তিনি তৈরি করেছিলেন। সে জাহাজ পানিতে ভাসানোর সময় কর্ণফুলীর পাড়ে বহু লোক জমা হয়েছিলো। আমেনার বিয়ে হয়েছিলো পূর্ব পাকিস্তানের যোগাযোগ মন্ত্রী সুলতান আহমদের পিতা খান বাহাদুর খলিলুর রহমানের সঙ্গে, জামেনার বিয়ে হয়েছিলো আবু সাঈদ দোভাষের সঙ্গে। খ্যাতনামা ফুটবলার আবু তাহের পুতু জামেনারই পুত্র।
পঞ্চাশের দশকেই আমরা পাই জওশন আরা রহমানকে, জন্ম যাঁর বৃহত্তর সাতকানিয়া (বর্তমানে লোহাগাড়া থানা) থানার চুনতি গ্রামের একটি আলোকপ্রাপ্ত পরিবারে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ১৯ অক্টোবর তারিখে। চুনতি গ্রামটা প্রসিদ্ধ। বলা হয়, গ্রামের শতকরা ৯৯ জন মানুষ শিক্ষিত। কবি সুফিয়া কামাল এই গাঁয়েরই বধূ। নৃত্য সম্রাট বুলবুল চৌধুরীও চুনতির ভূমিপুত্র এবং জওশন আরা রহমানের বংশের এক কৃতী সন্তান। এছাড়া ব্রিটিশ আমলে কত ডেপুটি কালেক্টর ও ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং পাকিস্তান আমলে একাধিক সিএসপি অফিসার চুনতিতে জন্মগ্রহণ করে গ্রামটিকে গৌরবান্বিত করেছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলের মুন্সেফ শুকুর আলী জওশন আরার প্রপিতামহ তাঁর নামে চট্টগ্রাম মহানগরের রুমঘাটা গলিতে একটি উপগলি রয়েছে। জওশন আরা রহমানের পিতা মাহবুবুর রহমান ছিলেন বিভাগ–পূর্ব বাংলার চট্টগ্রাম জেলার প্রথম জেলা রেজিস্ট্রার; মাতা সাদীদা খানম, তিনিও বিদূষী নারী। তিনি একজন লেখক।
পঞ্চাশের দশকে চট্টগ্রাম কলেজে বেশ ছাত্রীর সমাগম। ব্রিটিশ আমলেই (১৯২২ খ্রিস্টাব্দে) সহশিক্ষা আরম্ভ হয়ে যায়। জওশন আরা রহমানের জীবনকে দিয়ে আমরা চট্টগ্রামের নারীজাতির অগ্রগমণের একটি ইতিবৃত্ত পেতে পারি। জওশন আরা রহমান খাস্তগীর স্কুলে অধ্যয়নকালে বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনে শহরের দেওয়ালে পোস্টার লাগিয়েছিলেন; এ সময় তিনি অন্যান্য ছাত্রীদের নিয়ে শহরে ট্রাক মিছিল করেন এবং ভাষার দাবিতে আয়োজিত সমাবেশে যোগ দেন। ভাষা সংগ্রামী প্রতিভা মুৎসুদ্দী সে সময় চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্রী, তিনি এবং তালেয়া রেহমান (সাংবাদিক শফিক রেহমানের স্ত্রী এবং ডেমোক্রেসীওয়াচের চেয়ারপারসন) চট্টগ্রাম কলেজ থেকে খাস্তগীর স্কুলে গিয়ে সে স্কুলের ছাত্রীদের মিছিলে যোগ দেন।
চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যয়নকালে জওশন আরা রহমান ১৯৫৫–৫৬ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে কলেজের বার্ষিক ম্যাগাজিন “অন্বেষা” সম্পাদনা ও প্রথম বাংলায় প্রকাশ করেন। সে সময় চট্টগ্রাম কলেজ থেকে সহপাঠী, নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের সঙ্গে যৌথ সম্পাদনায় জওশন আরা রহমান দু’পাতা নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন।
একটি ঋদ্ধ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে তিনি বড় হয়েছিলেন। ৬০ দেওয়ান বাজারে তাঁদের বাসাটি ছিল বুদ্ধিদীপ্ত তরুণদের একটি মনোরম আড্ডার জায়গা। সেখানে সাহিত্য–সংস্কৃতি, সমাজ–উন্নয়ন, রাজনীতি বিষয়ে উৎসাহী ব্যক্তিরা আসতেন। এর মধ্যে নবীনেরা ছিল খুবই প্রাণবন্ত। তাদের নিয়ে জওশন আরাদের একটি বিশেষ জগৎ ছিল। প্রায়ই বিকেলে তাঁরা জোর আড্ডায় বসতেন। এতে থাকতেন সুচরিত চৌধুরী, এডভোকেট শফিউল আলম, আবদুল্লাহ আল মামুন, আবদুল্লাহ আল হারুন, ড. মুহম্মদ ইউনূস, আবদুস শাকুর, এডভোকেট এ কে এম এমদাদুল ইসলাম, দীননাথ সেন, সোবহান, সুধাংশু ভট্টাচার্য (একাত্তরের শহীদ), আবদুল হাই, কাজী ফরিদ প্রমুখ।
চট্টগ্রামে পয়লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ উদযাপনও প্রথম শুরু হয়েছিলো জওশন আরার দেওয়ান বাজারের বাসা থেকে। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁরা নিজেদের মধ্যে প্রথম ঘরোয়াভাবে পয়লা বৈশাখ উদযাপন আরম্ভ করেছিলেন দেওয়ান বাজারে তাঁদের বাড়ির পেছনের উঠোনে। সেখানে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে আন্দরকিল্লা থেকে যেতেন বেলা হক, আবদুল হক, ফ্যানসি, রুমী, সানি। পাথরঘাটা থেকে তারাপদ ঘোষ, চিত্তরঞ্জন দাশ (এডভোকেট–শীলা মোমেনের পিতা ও আবুল মোমেনের শ্বশুর), পুতুল রানী দাশ এবং তাঁদের ছেলেমেয়েরা, বানী দাশ এবং তাঁর ছেলেমেয়েরা, নিখিল রঞ্জন দাশ (এডভোকেট চিত্তরঞ্জন দাশের ভাই), শিখারানী দাশ (নিখিল রঞ্জন দাশের স্ত্রী) এবং সদরঘাট থেকে ডা. কামাল এ খান ও তাঁর কন্যা কিশোয়ার কামাল, রুমঘাটা থেকে হুসনুন্নাহার (জওশন আরার বড় বোন), লুৎফর রহমান (জওশন আরার ভাই), শাহাবুদ্দীন (জওশন আরার ভাই), স্বপন, নওশাদ ও সেবু (জওশন আরার ভ্রাতুষ্পুত্রী)। দেওয়ান বাজার থেকে মেসবাহউদ্দীন জঙ্গী (বর্তমানে ঢাকায় থাকেন) এবং সেজবাবু। দেওয়ান বাজার থেকে কৃষ্ণগোপাল সেন (কালাচান), মীরা সেন, সমীরন রায় এবং তাঁর ছেলেমেয়েরা। দেখতে দেখতে লোকের ভিড়ে উঠোন ভরে যেত।
উষালগ্নে সুচরিত চৌধুরীর বাঁশি বাদনের মধ্য দিয়ে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান শুরু হতো। তারপর সকলে মিলে ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ এই গান গেয়ে বছরের প্রথম দিনকে বরণ করা হত। চমৎকার আবৃত্তি করতেন এডভোকেট চিত্তরঞ্জন দাশ। পরপর অনেকগুলো একক ও সম্মিলিত গানের শেষে পরিবেশন করা হতো লুচি–তরকারি। পুতুল রানী এতে তাঁদেরকে সহায়তা করতেন। রোদ তীব্র হয়ে ওঠার আগেই তাঁদের অনুষ্ঠান শেষ হতো। তাঁদের পয়লা বৈশাখ উদযাপন অনুষ্ঠানে একদিন ঘটনাক্রমে উপস্থিত ছিলেন প্রফেসর মুনীর চৌধুরী। ঢাকা থেকে বিশেষ কাজে চট্টগ্রাম এসেছিলেন। সেবার তাঁদের বাসায় উঠেছিলেন।
দেওয়ানবাজারে জওশন আরা রহমানের বাসায় এ অনুষ্ঠান ছাড়াও চট্টগ্রাম শহরে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হতো সদরঘাটে বাঁশপাড়া চৌধুরী বাড়িতে। সে বাড়িতে প্রতি বছর পয়লা বৈশাখে প্রীতিভোজের আয়োজন করা হতো। বিনোদ চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী অতি যত্নসহকারে অসংখ্য অতিথিকে আপ্যায়ন করতেন লুচি–তরকারি, মাছ–ভাত, দই–মিষ্টি দিয়ে।
পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে ছোটদের একটি শিল্পী গোষ্ঠী গড়ে ওঠেছিলো। এর প্রেক্ষিতে রবীন্দ্র জন্মোৎসব করার উদ্দেশ্যে ছোটদের রবীন্দ্রজয়ন্তী সংসদ নামে একটি কমিটি গঠন করা হয়। তারাপদ ঘোষকে সভাপতি, সাফিনা মাহবুব মুন্নিকে (জওশন আরা রহমানের একমাত্র কন্যা) সম্পাদক এবং শীলা দাশ (মোমেন) ও সাদেক সাইফুর রহমান স্বপনকে (ডা., বামপন্থী রাজনীতি করতেন) যুগ্ম–সম্পাদক করা হয়। এছাড়া এর সদস্য ছিলেন ফ্যানসি হক, সিতারা সাত্তার, রানা মল্লিক, শর্মিলা দাশ, শাহদীন মালিক (বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের খ্যাতনামা এডভোকেট) ও দীনা জাহেদ। তারাপদ ঘোষ বয়সে প্রবীণ হলেও ছোটদের ঘোষকাকা হিসেবে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। মুসলিম ইনষ্টিটিউট মিলনায়তনে ৩০ বৈশাখ, ১৩৭৩ বাংলা, ১৪ মে ১৯৬৬ এই সংসদের উদ্যোগে রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপিত হয়। এই উপলক্ষে দুই পৃষ্ঠার একটা ফোল্ডার ছাপানো হয়েছিল। লাল রঙে রঞ্জিত এই ফোল্ডারটি ডিজাইন করেছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী সবিহউল আলম। ফোল্ডারের তথ্য অনুযায়ী এই অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের উনিশটি গান পরিবেশিত হয়। এর মধ্যে কয়েকটি গানের নৃত্যরূপও দেয়া হয়। সম্মিলিত গানে হারমোনিয়াম বাজিয়ে লীড দিয়েছিলেন সাফিনা মাহবুব মুন্নি। ধারা বর্ণনায় ছিল রাণা মল্লিক ও মুনতাসির মামুন (বর্তমানে বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক)।
জওশন আরা রহমান ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে বৃত্তিসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। পরীক্ষার ফল প্রকাশ হবার আগেই বিবাহ–বন্ধনে আবদ্ধ হন কবি ও ভাষা সংগ্রামী মাহবুব উল আলম চৌধুরীর সঙ্গে। বিয়ের পর নিয়মিত লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটে।
১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে জওশন আরা রহমান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রী সংসদের চট্টগ্রাম জেলা শাখার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে বি.এ পাস করেন। সমাজকল্যাণ বিভাগে চাকরিতে থাকাকালীন ১৯৬৪–১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে কলম্বো প্ল্যান স্কলারশিপ নিয়ে দু’বছরের জন্য নিউজিল্যান্ডে যান। ওয়েলিংটনে ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে সোস্যাল সায়েন্স–এ পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে চাকরিরত অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে তৎকালীন ইনস্টিটিউট অব সোস্যাল ওয়েলফেয়ার থেকে এম. এ. পাস করেন।
কর্মজীবনে যখন প্রবেশ করলেন, তখনো তাঁর কর্মক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিলো প্রথমে সরকারের সমাজকল্যাণ বিভাগ। সেখানে সাড়ে আঠারো বছর কাটিয়ে দেন শিশু ও মাতৃমঙ্গলের ন্যায় মানবিক কর্মে। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে শহর সমাজকল্যাণ অফিসার হিসেবে চাকরি আরম্ভ করে ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে ডেপুটি ডাইরেক্টর হিসেবে ‘মাদার্স ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা করে ১৯৭৯–তে ইউনিসেফে–যোগ দেন। ইউনিসেফেও তিনি প্রথমে নারী উন্নয়ন কর্মসূচির প্রধান এবং পরে প্রোগ্রাম প্ল্যানিক্স সেকশনের প্রধান হিসেবে সাড়ে সতেরো বছর নারীর উন্নয়নে কাজ করেন।
এসব কর্মসূচিতে নারীকে উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। শিশু ও নারীর অধিকার রক্ষার ব্যাপারে তিনি একটি ইনস্টিটিউশন হয়ে উঠেছিলেন। তিনি ছিলেন চট্টগ্রামের গর্ব। তিনি যে উচ্চতায় উপনীত হয়েছেন, চট্টগ্রামের আর কোন নারী সে উচ্চতায় পৌঁছতে পারবেন কিনা সেটা ভেবে দেখার বিষয়। উন্নয়ন সংগঠক হিসেবে তাঁর কৃতিত্ব অনন্যসাধারণ। দেশের দুই প্রধান উন্নয়ন চিন্তাবিদ ও সংগঠক প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ও স্যার ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে সমপর্যায়ে সম দক্ষতায় তিনি কাজ করেছেন। বেসরকারী স্বাস্থ্যখাতে কিংবদন্তী সংগঠক ও চিকিৎসক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গেও নানা বিষয়ে তাঁর চিন্তার সংশ্লেষের কথাও উল্লেখ করা যায়। নারী ও শিশুর উন্নয়ন ও সংগঠন ব্যাপারে বিশেষজ্ঞের খ্যাতি জওশন আরা রহমানের জীবনের অনন্য অর্জন। কিন্তু পরিবার ও স্বামী লেখক, সাংস্কৃতিক সংগঠক, কবি ও ভাষা সংগ্রামী মাহবুব উল আলম চৌধরীর সঙ্গে দাম্পত্য জীবনের সূত্রে তিনি যে মানবিক জীবনবোধ ও সাংস্কৃতিক চেতনা অর্জন করেছেন, সেটাই জওশন আরা রহমাকে অনন্য মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। তাঁর জীবন একটি মহৎ মানবিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ একটি শুচি, শুভ্র ও সুন্দর সাংস্কৃতিক জীবনের অভিব্যক্তি।
তিনি অক্টোবর ১৯৯৬, ইউনিসেফ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৯৭–২০০২ খ্রিস্টাব্দের পাঁচ বছর মেয়াদী ‘National Action Plan for Children‘ প্রণয়নে তিনি টিম লিডার হিসেবে কাজ করেন। বাংলাদেশের চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নারী উন্নয়ন‘ এবং পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ‘শিশু উন্নয়ন‘ ম্যাক্রো চ্যাপ্টার সংযোজনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তিনি গ্রামীণ ট্রাস্টের উপদেষ্টা, গ্রামীণ–শিক্ষা পরিচালনা পরিষদের সদস্য, গণবিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও ট্রেজারার, কেমপেইন ফর পপুলার এডুকেশন–এর স্পনসারশীপে প্রকাশিত বাৎসরিক এডুকেশন ওয়াচ রিপোর্ট‘-এর এডভাইজরি বোর্ডের সদস্য। ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের ১১ জুলাই রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে মহীয়সী নারী জওশন আরা রহমানের মহৎ জীবনের যবনিকাপাত ঘটে।
লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা ও সংস্কৃতি সংগঠক।