কনফুসিয়াস বলেছিলেন, ‘তিনজনে একজন শিক্ষক’ কিন্তু আমাদের দেশে প্রত্যেকটি মানুষই এক–একজন শিক্ষক। সে কারণেই হয়তো শিক্ষকদের এখানে কোনো মূল্য নেই এবং শিক্ষকদের শিক্ষা দিতে পারাটাই বাকিদের মূল কাজ!
তাই এখানে বহুকাল ধরে শিক্ষকদের শিক্ষা দেয়ার কাজটা সকলেই নির্দ্বিধায়, নিঃসঙ্কোচে করে আসছেন। এই ব্যাপারে নির্লিপ্ত প্রায় সকলে। অবশ্য, আমাদের প্রথম যিনি একখানা নীতি বানিয়ে চিরদিনের জন্য শিক্ষা দিয়ে দিয়েছেন তার নাম লর্ড ম্যাকলে। ১৮১৩ সালে দেয়া লর্ড ম্যাকলের ‘নিম্নগামী পরিস্রবণ শিক্ষানীতি’র সুবিধাবাদী কেরানি তৈরির কারিগর করা থেকে আমরা এখনও একচুলও সরতে পারিনি।
বক্তৃতাবাজিতে অবশ্য আমরা প্রায়ই বলতে শুনি, শিক্ষকই মানবসম্পদ তৈরির কারিগর। এইসব লম্বালম্বা কথায় তো আর মন ভরে না! স্বাধীনতার এই চুয়ান্ন বছরে আমরা জাতি হিসেবে শিক্ষকদের কতটা সম্মান দিয়েছি তা এখন আর ভেবে না দেখলেও জাতির খুব একটা ক্ষতি আছে বলে মনে হচ্ছে না। সামপ্রতিক সময়ে বাড়িভাড়ার টাকা নিয়ে বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদের রাজপথে নামার চিত্রটি দেখে বিষয়টি আবারও মনে পড়লো।
আমাদের শিক্ষকদের অবস্থান কেমন তার জন্য অবশ্য ইউরোপ–আমেরিকার দিকে যাওয়ার দরকার নেই, আশেপাশের দেশের দিকে তাকালেই চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে, ভারত নয় কেবল পাকিস্তান, নেপাল, ভুটানেরও শিক্ষকদের বেতনভাতা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু আমরা আমাদের শিক্ষকদের মহামানব হিসেবেই দেখতে চাই। তাদের কোনো মানবিক জীবন থাকবে না। তারা চিরকাল অভাবের সাথে লড়াই করবে। এটাই তো প্রকৃত পাণ্ডিত্য!
আমরা শিক্ষকদের অভাব দেখতেই বেশি অভ্যস্ত! শিক্ষকদের ময়লা একখানা ছিন্ন শার্ট ও তার চেয়েও মলিন চেহারা, বুকপকেটে রঙ–বেরঙের কালির দাগ, গাছের হাতলওয়ালা একখানা ছাতা আর যার অহংকার করার মতো থাকবে নিত্য অভাব ও একধরনের মেকি জাত্যাভিমান।
অর্থনেতিক দিকটা বাদই দিলাম, সমাজই বা একজন শিক্ষককে কীভাবে দেখে তার চিত্রতো আমাদের সকলের জানা। একজন কেরানির সম্মানও এরচেয়ে অনেকগুণ বেশি কারণ তার বেতনের জন্য আন্দোলন প্রয়োজন হয় না বা দরকারই পড়ে না! তাই এখানে শিক্ষক হওয়ার থেকে পুলিশের দারোগা হওয়াটাকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে ছেলের বাবা, মেয়ের বাবা সকলেই। যেন যার আর কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকে না, যে সবচেয়ে অযোগ্য, অথর্ব সেই আসে বাচ্চাদের পড়াতে!
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কোনো কথা বলবো না, তার মানোন্নয়নে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত তাও আলোচনা করবো না; কারণ এ দেশের শিক্ষকদের বেতনকাঠামো দেখলেই তা সহজে বোধগম্য! অবশ্য, কোচিং বাণিজ্য বা প্রাইভেট পড়িয়ে এদের অনেকে যে বিদেশে বিলাসী অট্টালিকা তৈরি করে তা বন্ধ করতে রাষ্ট্রব্যবস্থা কিন্তু বন্ধপরিকর! অথচ, প্রাইভেটাইজেশনের নামে পরিকল্পিতভাবে এই শিক্ষাব্যবস্থা কীভাবে ক্রমশ আমজনতার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে সেদিকে কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
আমরা নাকি উন্নয়নের রোল মডেল, এমন একটা সান্ত্বনার মূলা আশার বাণী হিসেবে বুকে ঝুলিয়ে বিগত সরকারগুলোর আমলে কেবল দুর্নীতিতে লাগাতার প্রথমসারিতে রয়ে গেলাম। আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশের চিত্রকল্প শুধু এদেশ থেকে গুটিকয় মানুষের টাকা পাচার, ব্যাংকলুট আর কিছু আমলা–কামলার টাকার কুমির হয়ে ওঠার গল্প ছাড়া আর কিছু নয়!
এইসব থেকে একটা বিপ্লব জাতিকে আপাদমস্তক বদলে দিবে সে আশাবাদও করা হয়নি। কিন্তু কষ্টটা হচ্ছে এই জুলাই বিপ্লবের পরে সবচেয়ে দুঃখজনক আর অপমানজনক ঘটনা ঘটেছে শিক্ষকদের সাথেই। মবের সুযোগ নিয়ে, বিগত সরকারের দোসর আক্ষা দিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান প্রধান, শিক্ষককে অপমান–অপদস্ত করা হয়েছে। কিন্তু মেরুদণ্ডহীন, সুবিধাবাদী শিক্ষকদলের পাশাপাশি আমরা তো এও দেখেছি, দেশের সব ক্রান্তিলগ্নে কীভাবে এই পেশার মানুষ এগিয়ে এসেছিল। কতজন শিক্ষক বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিল শিক্ষার্থীদের পাশে, আন্দোলন অংশ নিয়েছিল, প্রেরণা জুগিয়েছিল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ডেরায় গিয়ে ছিনিয়ে নিয়েছিল প্রিয় ছাত্রদের। সেই সব গল্প কি আমরা বলতে শুনেছি কোনোদিন। অথচ, যেই দুর্নীতিবাজ আমলাতন্ত্র একটি গণমুখী রাজনৈতিক দলকে রীতিমতো হায়েনায় পরিণত করেছে বা ভবিষ্যতেও অনাগত শাসকশ্রেণিকে একইভাবে জম্বিতে রূপান্তরিত করবে তাদের কি কোনো বিচার হয়েছে বা আদৌ হবে! সেই সব ফাঁপরবাজরা ভোল পাল্টে বহাল তবিয়তে থেকে যাবে অনাদিকাল। তাদের কেউ, কোনো সরকারই টিকিটাও ছুঁতে পারবে না! দিনশেষে এরাই চালাবে রাষ্ট্র ও সমাজ।
আমাদের সমাজে যেকোন পেশার মানুষের চেয়ে শিক্ষককের মূল্য সবচেয়ে কম। একজন কেরানির সম্মানও যে কোন শিক্ষকের চেয়ে ঢের বেশি। তাই রাষ্ট্র ব্যবস্থা শিক্ষকের গায়ে সহজেই হামলা করতে পারে, একজন শিক্ষককে সন্ত্রাসীর মতো কলার ধরে মারতে–মারতে নিয়ে যেতে পারে, গলায় জুতার মালা পরিয়ে জনসম্মুখে ঘোরাতে পারে। কারণ, একজন গার্মেন্টস শ্রমিক, একজন রিকশাওয়ালার সমানও তার দাম নেই। তার পক্ষে এসে কেউ দাঁড়ায় না! কেননা, তার পেশায়ও আছে দালালের দল, তোষামোদকারী আর সুবিধাভোগী শ্রেণির আধিপত্য। বস্তুত, শিক্ষক আমাদের দেশের সবচেয়ে নিরীহ প্রাণী। আমরা কথায় কথায় বলি, শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড কিন্তু ভাঙা মেরুদণ্ড নিয়ে জাতির মেরুদণ্ড কী করে ঠিক করবে তারা।
লেখক : কবি–প্রাবন্ধিক; কলেজ শিক্ষক










