‘অলৌকিক আনন্দের ভার বিধাতা যাহারে দেয়, তার বক্ষে বেদনা অপার’

প্রফেসর ডা. প্রবীর কুমার দাশ | সোমবার , ১৮ জানুয়ারি, ২০২১ at ৬:২৯ পূর্বাহ্ণ

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আমি আমাদের গ্রাম সাতকানিয়া থানার ঢেমসা স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। সত্তর এর সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে আমাদের স্কুলের মাঠে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকার সমর্থনে নির্বাচনী সভা আয়োজিত হতো। নির্বাচনে সাতকানিয়া আসনে বঙ্গবন্ধু এমএনএ হিসাবে আওয়ামী লীগ নেতা আবু সালেহ এবং এমপিএ হিসাবে মরহুম সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে মনোনয়ন দেন। আমাদের নির্বাচনী স্লোগান ছিল ‘আমার ভাই তোমার ভাই সালেহ-ভাই, সিরাজ ভাই,’‘ জয়ের পথে জয়ের পথে নৌকা নৌকা।’ স্কুলের মাঠে আয়োজিত নির্বাচনী জনসভায় মাইকে গান বাজতো- ‘মুজিব বাইয়া যাওরে-নির্যাতিত দেশের মাঝে জনগণের নাওরে মুজিব বাইয়া যাওরে।’ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাসহ বঙ্গবন্ধুর বারংবার কারা ভোগের প্রেক্ষাপটে লেখা গান- ‘আকাশ কাঁদে, বাতাস কাঁেদ, কাঁদে সাগর, নদী/ সাড়ে সাত কোটি বাঙালি কাঁদে মুজিব মুজিব করিরে মুজিব বাইয়া যাও রে।’ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্টতা অর্জন করে। পাকিস্তানি সামরিক শাসকচক্র ক্ষমতা হস্তান্তরে গরিমসি করতে থাকলে মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। আমাদের গ্রামের যুবকরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিচ্ছেন। স্বপন চৌধুরী (মুক্তিযুদ্ধে শহীদ), রুপেন চৌধুরী (প্রয়াত), অধ্যাপক দিলীপ কান্তি চৌধুরী (মুক্তিযুদ্ধে শহীদ), মরহুম মনির আহমদ, দীপেশ চৌধুরী (প্রয়াত), মরহুম আবুল কালাম, অরবিন্দ দাশ চণ্ডী (প্রয়াত) সহ আরো অনেকে বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। স্বপন চৌধুরী ছিলেন তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক, স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিতে গঠিত সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা। প্রখর মেধাবী স্বপন চৌধুরী তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগে অধ্যয়নরত এবং জগন্নাথ হলের আবাসিক ছাত্র। প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক রূপেন চৌধুরী তার অগ্রজ। স্বপন চৌধুরীদের বাড়ি আর আমাদের বাড়ি একই পাড়ায়। তিনি ছিলেন আমার প্রয়াত কাকা অরবিন্দ দাশের স্কুলের সহপাঠী। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে এক সকালে স্বপন চৌধুরী ও রূপেন চৌধুরী দুই ভাই আমাদের বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে বেবিটেঙি যোগে চট্টগ্রাম শহরের উদ্দেশে রওনা হন। আমি আমার মার সাথে রাস্তার অদূরে দাঁড়ানো। মাকে দেখে ট্যাঙি থামিয়ে স্বপন চৌধুরী মার সাথে কুশল বিনিময় করেন। মা তাকে জিজ্ঞেসা করেন ‘স্বপন আবার ফিরবে কবে?’ স্বপন চৌধুরী দৃপ্ত কণ্ঠে উত্তর দেন ‘দেশ স্বাধীন করে তবেই ফিরব।’ ১৯৭১ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর আমাদের বিজয় অর্জিত হয়। আমরা স্বাধীনতা পাই। কিন্তু স্বপন চৌধুরী আর ফেরেননি। স্বপন চৌধুরীর মতো বীর মুক্তিযোদ্ধার রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা। পরবর্তীতে শহীদ স্বপন চৌধুরীর সহযোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. এম.এ ইউসুফ চৌধুরীর মুখে শুনেছি যুদ্ধক্ষেত্রে স্বপন চৌধুরীর বীরত্ব গাথা। স্বপন চৌধুরী ফরাসী বিপ্লবে আত্মাহুতি দানকারী বিপ্লবীদের মহান বাণী উচ্চারণ করে বলতেন, ‘on return to your home tell them, we are giving our today for their tomorrow’ (ভাবার্থ: বাড়ি গিয়ে তুমি তাদের বলবে, তাদের ভবিষ্যতের জন্য আমরা আমাদের বর্তমানকে উৎসর্গ করছি’)। সত্যিই স্বপন চৌধুরীর মতো বীরেরা তাদের সেই দিনগুলো আমাদের ভবিষ্যত গড়তে দিয়ে গেছেন- চরম আত্মত্যাগের মাধ্যমে। তাদের রক্তের বিনিময়ে এদেশ আজ স্বাধীন; আমরা যার যার অবস্থানে আসীন।
অপরিণত বয়সের কারণে প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমি সচক্ষে প্রত্যক্ষ করি রাজাকাররা আমাদের ঘরে আগুন দিচ্ছে। ঘরের জিনিসপত্র লুটে নিচ্ছে। আমার মার কাছ থেকে টাকা পয়সা কেড়ে নিচ্ছে। আমাদের ঘরে দেওয়া আগুন নেবাতে গেলে আমাকে গুলি করতে উদ্যত হচ্ছে। তাদের প্রতিহত করার ক্ষমতা আমার ছিল না অপরিণত বয়সের কারণে।একদিন আমাদের গ্রামে প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালামসহ মুক্তিযোদ্ধাদের একটা দল প্রবেশ করে। আমি তাঁদের কাছে যাই। তাঁদের সঙ্গী হতে আগ্রহ প্রকাশ করলে জনৈক বীর মুক্তিযোদ্ধা তাঁর কাঁধের রাইফেলটা আমার কাঁধে তুলে দেন। রাইফেলের বাট মাটিতে লেগে যাচ্ছে দেখে উনি বললেন, ‘নাহ্‌ তুমি যুদ্ধে যেতে পারবে না।’ আর এভাবে আমার যুদ্ধে যাবার স্বপ্নের আবাসন ঘটে। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস আমি নিজ গ্রামে এবং নিকটস্থ মামার বাড়িতে বিভিন্ন মেয়াদে আত্মগোপনে কাটাই নিকটজনদের সাথে। কখনও বা সেই বয়সে লুঙ্গি পরে ছদ্মবেশ ধারণ করেছি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও এদেশীয় রাজাকারদের হাত থেকে বাঁচতে বাড়ি ঘর ছেড়ে শুভানুধ্যায়ী মুসলমান ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ঘরে আশ্রয় নিয়েছি। কখনও দিনের পর দিন একই ঘরে বন্দী অবস্থায় কাটিয়েছি। এক বিভীষিকাময় রাতের কথা মনে পড়লে এখনও শিহরিত হই। আমি ও আমার বাবা তখন মামার বাড়িতে। আমার মা ছোট বোনদের নিয়ে আমাদের নিজ গ্রামে আছেন। হঠাৎ সেই রাতে মামাদের গ্রামে রটে যায় রাতে রাজাকাররা হানা দেবে গ্রামে; বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেবে তারা। মামা বাড়ির সবাই রাত যাপনে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে পার্শ্ববর্তী মুসলিম প্রতিবেশীদের সাথে যোগাযোগ করতে থাকেন। হানাদার আসার খবর প্রচারিত হওয়াতে শুভানুধ্যায়ী সবাই ভীত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়। পাছে হানাদার বাহিনী আমাদের আশ্রয় দেবার অপরাধে তাদের বাড়ি আক্রমণ করে-এই ভয়ে। সেই রাতে এগিয়ে আসেন এলাকার জনৈক সোনা মিয়া। গ্রামে সে পেশাদার সিঁদ্‌কাটা চোর হিসাবে পরিচিত। সাহস করে সে আমাদের সবাইকে তার কুড়ে ঘরে ঠাঁই দেয়। তার আর্থিক সংগতি ছিল না, পেটের দায়ে চুরি করতো। আমাদের জন্য তার ঘরে পেতে দেওয়া বিছানা মলিন। ছেঁড়া কাঁথা পিঠে লাগার অনুভূতি এখনও মনে করতে পারি। আমি সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করি সেই মহানুভব ব্যক্তিকে যিনি সমাজের কাছে একজন তস্কর কিন্তু আমার কাছে একজন মানবতাবাদী ব্যক্তি। পরবর্তীতে স্বাধীনতা লাভের পর তার পরিবারের সাথে আমাদের হৃদ্যতা দীর্ঘদিন অটুট থাকে। আমাদের গ্রামে ঘনঘন পাকিস্তানী বাহিনী ও রাজাকার হানা দিত। তাদের প্রতিরোধে আসতেন মুক্তিবাহিনী। মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন খবরাখবর দিয়ে আমরা সাহায্য করতাম। আর রাজাকার দেখলে দূর থেকে ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার করে উঠতাম-কিশোর বয়সের উচ্ছ্বাস হেতু। রাজাকাররা তখন গুলির ভয় দেখাতো। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় অর্জিত হয়। সেদিন বিকালে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্নসমর্পণ করে। বিজয়ী বাঙালি জাতি বিজয়ের আনন্দে আত্নহারা। সেই আনন্দের ঢেউ আমাদের গ্রামেও এসে পড়ে। কিন্তু সে দিন সন্ধ্যায় আমাদের পাশের চৌধুরী বাড়িতে কান্নার রোল। আমি দৌড়ে দিয়ে দেখি অধ্যাপক দিলীপ চৌধুরীর বাড়িতে সবাই অঝোরে কাঁদছে। অধ্যাপক দিলীপ চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রামের কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ কলেজের অংক শাস্ত্রের মেধাবী শিক্ষক। বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক দিলীপ চৌধুরী রাউজানের পাহাড়তলীতে চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (বর্তমান চুয়েট) গেইটে ১৩ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন। তার সহযোদ্ধা চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরীর সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা সাইফুদ্দীন খালেদ চৌধুরী, শেখ মোজাফ্‌ফর আহমদ, আবদুর রবও সেই যুদ্ধে শহীদ হন। সেদিন সন্ধ্যায় এই সংবাদ নিয়ে আসেন আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা অধীর। এই সংবাদে শহীদ দিলীপ চৌধুরীর মা, বাবা, ভাই, বোনসহ পাড়ার সবাই শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে। অথচ এই সংবাদ পৌঁছার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এরা সকলেই বিজয়ের আনন্দে ছিল উল্লসিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় ‘অলৌকিক আনন্দের ভার বিধাতা যাহারে দেয়, তার বক্ষে বেদনা অপার’। অধ্যাপক দিলীপ চৌধুরীর স্বজনরাও তার মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হবার সংবাদে অপাড় বেদনায় বিদীর্ণ হন।
৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের গ্রামের আরো দুইজন শহীদ হলেন বিমল কান্তি সেন ও সোনারাম দাশ। এই দুইজনই আমার পাশের বাড়ীর। শহীদ বিমল কান্তি সেন আমার কাকা সম্পর্কীয় (বাবার মামাতো ভাই) । ১৯১৭ সালে কলেজ পড়ুয়া ছাত্র ছিলেন পরোপকারী ও ধর্মপ্রাণ। সাংবৎসর নিজগৃহে সরস্বতী পূজা ও শারদীয় দুর্গাপূজা আয়োজন করতেন। শহীদ বিমলের মা কিরণ বালা সেন পুত্র শোক সারাজীবন বয়ে চলেন। একাত্তরে ছেলে নিখোঁজ হলে তিনি মা দুর্গার কাছে ছেলেকে ফিরিয়ে দিতে মিনতি জানাতেন। ছেলে ফিরে না আসলে পুত্র শোকে কাতর মা অভিমান করে তার জীবদ্দশায় আর তার ঘরে দুর্গাপূজার আয়োজন করেন নি এবং অন্য কোন পূজামণ্ডপেও যাননি। একাত্তরে অন্য শহীদ সোনারাম ছিলেন গরীব রিকশা চালক। বাড়ি আমাদের একই পাড়ায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পেটের দায়ে তার রিকশায় যাত্রী নিয়ে নিকটস্থ অন্য গ্রামে যাচ্ছিল। পথে রাজাকার তার পথ রোধ করে তাকে হত্যা করে এবং রিকশাটা নিয়ে যায়। যুদ্ধকালীন সেই রিঙা সাতকানিয়া থানা চত্বরে পড়ে থাকতে দেখা যায়। সোনারামের বৃদ্ধা মাতা সাতকানিয়া থানায় গিয়ে প্রতিদিন কাকুতি মিনতি করতো ছেলেকে ছেড়ে দিতে। তাঁর বিশ্বাস ছিল রিকশাটা যেহেতু সেখানে রক্ষিত আছে সোনারামকে হয়ত থানাতে আটকে রাখা হয়েছে। দেশ স্বাধীন হলো। সোনারাম ফেরেনি, রিকশাটাও নেই। সোনারাম যখন শহীদ হয়, তখন তাঁর স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা। দেশ স্বাধীন হবার পর শহীদ সোনারামের ছেলে জন্মগ্রহণ করে। তার মা ছেলের নাম রাখে বিপ্লব। সশস্ত্র বিপ্লবের পর স্বাধীনদেশে জন্ম বলে তার নাম বিপ্লব। বিপ্লব তার পিতাকে দেখেনি। তার পিতার কোনো ছবিও নেই। সে তার মার কাছে শুনেছে তার বাবা রিকশা চালাতে গিয়ে ৭১ এ শহীদ হয়। বাবার কোন স্মৃতি নেই বিপ্লবের। সে রিক্সাকেই তার বাবার প্রতিচ্ছবি মনে করে। আর তাই রিকশা চালানোকে সে পেশা হিসাবে গ্রহণ করে। রিকশার স্পর্শে সে তার বাবার স্পর্শ লাভ করে। তাদের বাড়িতে বিধবা মা, বড়বোন রত্না, বিপ্লবের ঠাকুর মা ও তার বাবার বড়বোন (পিসিমা) থাকতো। ছোট বেলায় সে তার পিসিকেই বাবা বলে ডাকতো। স্বামীকে হারিয়ে রত্না-বিপ্লবের মা নিদারুণ আর্থিক অনটনে দিনযাপন করে। কবি শামসুর রাহমানের ‘তোমাকে পাবার জন্য হে স্বাধীনতা’ কবিতায় আছে-‘তোমাকে পাবার জন্য হে স্বাধীনতা সিঁথির সিন্দুর মুছে গেল হরিদাসির।’ একইরূপ শহীদ সোনারামের স্ত্রীর মতো অগনিত হরিদাসীর সিঁথির সিন্দুরের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা। এই কবিতায় আরো আছে ‘তোমাকে পাবার জন্য হে স্বাধীনতা সখিনা বিবির কপাল ভাঙলো।’ স্বাধীনতার জন্য এ ধরনের সর্বস্ব হারানো এক ভদ্র মহিলাকে চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম শহরের মেহেদীবাগ এলাকা থেকে তাঁর জামাতা আজম সাহেব ও তাঁর স্ত্রী আমার চেম্বারে নিয়ে আসেন। সেটা ২০০১ সালের দিকের কথা। রোগীনির শরীর ক্ষীণ ও অতি দুর্বল। তথ্য অনুসন্ধানে জানতে পারি ভদ্র মহিলার স্বামী ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে চট্টগ্রাম শহরের কাট্টলি এলাকায় অবস্থিত ভিক্টোরী জুট মিলের ম্যানেজারের দায়িত্বে ছিলেন। মিলের অদূরেই তাঁর আবাসস্থল।
একদিন দুপুরে তিনি খাবার খেতে বসবেন। এমন সময় খবর আসে পাকসেনারা মিলে হানা দিয়েছে। তারা জলদি মিল খুলতে হুকুম করে। তিনি মিলের গেইটের চাবি নিয়ে বের হতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাঁর স্ত্রী তাকে ভাতটা খেয়ে যেতে অনুরোধ করেন। ভাত তরকারি সব পরিবেশন করা আছে। তিনি ভাত রেখেই চাবি নিয়ে বের হয়ে গেলেন, আর ফিরলেন না। মিল গেইটেই পাকসেনারা তাকে গুলি করে হত্যা করে। ভাত তরকারি পড়ে রইল। যার জন্য খাবারের আয়োজন তিনি আর ফিরলেন না। স্বামীর অভুক্ত অবস্থায় পাক হানাদারের হাতে শহীদ হওয়ার ঘটনা আজম সাহেবের শাশুড়িকে মানসিক ভাবে এতটাই বিপর্যস্ত করে তোলে যে তিনি সারাজীবন আর কোন দিন ভাত খাননি। তাঁর বর্তমান শারীরিক সমস্যা অনেকটা অপুষ্টিজনিত। তিনি অপুত্রক। একমাত্র মেয়ে ও জামাতা তাঁর সেবা যত্ন করেন। স্বাধীনতা পাবার জন্য যেসব সখিনা বিবিদের কপাল ভেঙেছে তাদের অন্যতম আমার এই রোগিনী। এরূপ অগনিত হরিদাসী আর অসংখ্য সখিনা বিবিদের চরম আত্মত্যাগে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদ ও তাদের পরিবারকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক : বিভাগীয় প্রধান, হৃদরোগ বিভাগ,
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

পূর্ববর্তী নিবন্ধসাম্প্রতিক চট্টগ্রাম ও দৈনন্দিন টুকিটাকি
পরবর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ – এর অন্ত্যমিল