চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) জন্য আগামী ২০২৫–২০২৬ অর্থবছরের ২ হাজার ১৪৫ কোটি ৪২ লাখ টাকার প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণা করেছেন মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। এতে নগর উন্নয়নে সর্বোচ্চ ১ হাজার ১২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। প্রস্তাবিত এ বাজেটে চসিকের নিজস্ব উৎসে ১ হাজার ৪৫ কোটি ২১ লাখ টাকা আয় ধরা হয়, যার অর্ধেক আসবে পৌরকর থেকে। গতকাল সোমবার দুপুরে নগরের থিয়েটার ইনস্টিটিউটে বাজেট ঘোষণা করেন মেয়র।
নিজ মেয়াদের প্রথম প্রস্তাবিত এ বাজেট বাস্তবায়নের মাধ্যমে নগরবাসীর আশা–আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানোর প্রত্যাশা ও চট্টগ্রাম মহানগরকে পরিবেশগত ক্লিন–গ্রিন, হেলদি ও সেইফ সিটি, আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ বাসযোগ্য নান্দনিক পর্যটন নগর প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন ডা. শাহাদাত। তিনি বলেন, সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও চট্টগ্রামবাসীর সার্বিক সহযোগিতায় নগরবাসীর সুখ–স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য আমার নিরলস প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
বাজেট অধিবেশনে গত (২০২৪–২০২৫) অর্থবছরের সংশোধিত ১ হাজার ২২১ কোটি ৯৬ লাখ টাকার বাজেটও ঘোষণা করেন মেয়র। অর্থবছরটিতে প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ছিল ১ হাজার ৯৮১ কোটি ৫২ লাখ টাকা।
উন্নয়নে বরাদ্দ বেশি : প্রস্তাবিত বাজেটে এডিপির ৯টি প্রকল্প এবং রাজস্ব তহবিলের ২৩টি খাতে নগর উন্নয়নে বরাদ্দ রাখা হয় ১ হাজার ১২৫ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে নগর উন্নয়নে ব্যয় হয় ৫৮৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটে এডিপির ৯টি উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দ রাখা হয় ৯৪৪ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে এডিপি প্রকল্পের বিপরীতে খরচ হয় ৫০৭ কোটি টাকা। এবার রাজস্ব তহবিলের বিপরীতে উন্নয়ন বরাদ্দ গতবারে চেয়ে বেড়েছে। গতবার সড়ক বাতি, রাস্তা ও ফুটপাতের উন্নয়ন, জলাবদ্ধতা দূরীকরণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ উন্নয়ন ও সৌন্দর্যবর্ধসসহ ২৩টি খাতে রাজস্ব তহবিলের বিপরীতে উন্নয়ন খাতে ব্যয় বরাদ্দ ছিল ১৪৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এবার তা বেড়ে ১৮১ কোটি টাকা করা হয়। সংশোধিত বাজেট অনুযায়ী গতবার রাজস্ব তাহবিল থেকে নগর উন্নয়নে চসিকের খরচ হয় ৭৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
নিজস্ব আয়ের অর্ধেক আসবে পৌরকর থেকে : প্রস্তাবিত বাজেটে নিজস্ব উৎস থেকে ১ হাজার ৪৫ কোটি ২১ লাখ টাকা আয় ধরা হয়। যার ৪৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ বা প্রায় অর্ধেকই আসবে পৌরকর থেকে। গতবার নিজস্ব উৎসে ১ হাজার ২৬ কোটি ৪৫ লাখ টাকা আয়ের প্রস্তাব করলেও আয় হয়েছে ৬০১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা।
চসিকের নিজস্ব আয়ের অন্যতম উৎস পৌরকর। প্রস্তাবিত বাজেটে হাল ও বাকেয়া মিলে পৌরকর খাতে ৫২০ কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। যা গত অর্থবছরে ছিল ৪৭১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ এবার পৌরকর খাতে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা বেড়েছে। অবশ্য গত অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আয় হয়েছে মাত্র ৩২২ কোটি টাকা। এছাড়া স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তরের ওপরসহ ৮ ধরনের কর থেকে প্রস্তাবিত বাজেটে ১৭৮ কোটি ৮৪ লাখ টাকা আয় প্রস্তাব করা হয়। গতবার এ খাতে আয় হয় ১১৮ কোটি ৯ লাখ টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে নিজস্ব উৎসের অন্যান্য খাতগুলোর মধ্যে রাস্তা খননসহ ১২ ধরনের ফি থেকে ১৩১ কোটি ৮০ লাখ টাকা, জরিমানা খাতে ২ কোটি টাকা, ব্যাংক স্থিতি থেকে ২৫ কোটি টাকা এবং সম্পদ থেকে অর্জিত ভাড়াসহ ১০৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা আয় ধরা হয়। অন্যান্য উৎস থেকেও গতবারের ন্যায় ৩৮ কোটি ৫ লাখ টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া প্রকল্পের বিপরীতে উন্নয়ন অনুদান হিসেবে আয় ধরা হয় ১ হাজার ৪৪ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে এ খাতে ৯০৯ কোটি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও আয় হয়েছে ৫৯৪ কোটি ১৪ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। এছাড়া ত্রাণ সাহায্য খাতে আরো ১০ কোটি আয়ের প্রস্তাব করা হয়।
মশক নিধনে বেড়েছে বরাদ্দ : প্রস্তাবিত বাজেটে মশক নিধন খাতে এক কোটি টাকা বৃদ্ধি করে ৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এর মধ্যে ওষুধ ক্রয়ে ৫ কোটি টাকা এবং ফগার ও হ্যান্ড স্প্রে মেশিন কেনায় দুই কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। গত অর্থবছরে মশক নিধন খাতে বরাদ্দ ছিল ৮ কোটি টাকা। তবে খরচ হয় ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
অন্যান্য ব্যয় খাতগুলো : প্রস্তাবিত বাজেটে চসিকের বকেয়া দেনা পরিশোধে ১৪৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। গতবার ২৩৬ কোটি ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখলেও ৯৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা বকেয়া দেনা পরিশোধ করা হয়। এছাড়া প্রস্তাবিত বাজেটের বড় অংশ খরচ হবে চসিকের পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে। যা টাকার অংকে ৬৩৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। গতবার এ খাতে খরচ হয় ৪২৮ কোটি ৭২ লাখ ৫ হাজার টাকা।
পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতের মধ্যে বেতনভাতা ও পারিশ্রমিক পরিশোধে খরচ হয় ৩৩৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও পানি খাতে ৭০ কোটি টাকা, কল্যাণমূলক খাতে ৩৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা ও আতিথেয়তা ও উৎসব খাতে ৫ কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে।
যা বললেন মেয়র : বাজেট অধিবেশনে মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, রাস্তঘাট ও অবকাঠামো উন্নয়ন, জলাবদ্ধতা নিরসন, সড়কবাতির উন্নয়ন এবং সেতু, কালভার্ট ও ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ খাতকে বাজেটে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়েছি।
তিনি বলেন, আজ আমার ১ম বাজেট অধিবেশন। বিগত ২০২১ সালের চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে নগরবাসীর হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসায় প্রদানকৃত ভোটে আমি জয়লাভ করলেও তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকারের কূট–কৌশলে আমাকে পরাজিত দেখানো হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে ন্যায়–বিচারের প্রত্যাশায় তৎসময়ে মাননীয় আদালতের স্মরণাপন্ন হই। জুলাই ২৪–এ ছাত্র–জনতার গণ–অভ্যুত্থানে অবৈধ আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকার ও তার দোসরদের পতনের পর আদালত কর্তৃক সুবিচার প্রাপ্য হয়ে চট্টগ্রাম মহানগরীর মেয়র পদে আদিষ্ট হয়ে দায়িত্বপালন করছি।
মেয়র বলেন, চট্টগ্রাম শহরকে ক্লিন ও গ্রিন সিটি হিসেবে গড়ে তুলতে বহু পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। তন্মধ্যে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, রাস্তাঘাট মেরামত এবং নগরবাসীর সুস্থ বিনোদনের জন্য নতুন নতুন পার্ক তৈরি ও শিশু–কিশোরদের মানসিক বিকাশের জন্য প্রতিটি ওয়ার্ডে খেলার মাঠ তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে পরিচ্ছন্ন বিভাগের সকল কর্মকর্তা–কর্মচারী নিরলসভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছে। জলাবদ্ধতা প্রকল্পের পরিচালকের সাথে দফায় দফায় বৈঠক ও আলোচনার মাধ্যমে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। জলাবদ্ধতাপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে অগ্রাধিকার দিয়ে দ্রুত পানি নিষ্কাশনের কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক কুইক রেসপন্স টিম গঠন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। নালা–নর্দমা, খাল ইত্যাদিতে কাজ তদারকি করার জন্য সিটি কর্পোরেশনের ৬ জন আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তার অধীনে একজন করে সুপারভাইজারসহ ২০ শ্রমিক ন্যস্ত করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় স্থানে ম্যানহোলের ঢাকনা বসিয়ে এবং অরক্ষিত নালা ও খালের পাড়ে র্যালিং স্থাপন করে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু ঠেকানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
মেয়র বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষ্যে মাত্র ১০ কোটি ব্যয়ে ১৯টি খাল থেকে ৪১ লাখ ঘনফুট মাটি ও আবর্জনা অপসারণ করা হয়। ড্রেনেজ পরিষ্কারে ১৪৮টি প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে, বর্ষায় আরও ২০০টি প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে। মশক নিধনে আধুনিক পদ্ধতি ও আমেরিকান প্রযুক্তির লার্ভিসাইড ব্যবহার শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, চলতি মৌসুমে অতিবৃষ্টিতেও জিইসি, বহদ্দারহাট, চকবাজারসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো তলিয়ে যায়নি। তিনি বলেন, আধুনিক বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণে দক্ষিণ পাহাড়তলীতে ১০ একর জমি কেনা হয়েছে এবং কুলগাঁও এলাকায় বাস–ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণ কাজও এগিয়ে চলছে।
বাজেট অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন চসিক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। চসিক সচিব মো. আশরাফুল আমিনের সঞ্চালনায় উপস্থিত ছিলেন প্রধান হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির চৌধুরী।