মেরুদণ্ড জোড়া লাগা অবস্থায় জন্ম নেওয়া কুড়িগ্রামের দুই শিশু নুহা–নাবাকে আলাদা করার পর তারা অনেকটাই সুস্থ। তারা এখন হাঁটতে, দৌড়াতে পারে। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারায় তাদের হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্রও দেওয়া হচ্ছে। এ বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে আলাদা করা হয় নুহা–নাবাকে। খবর বিডিনিউজের।
২০২২ সালের ২১ মার্চ মেরুদণ্ড জোড়া লাগানো অবস্থায় জন্ম নেওয়া ওই দুটি শিশুকে ঢাকায় আনা হয় সে বছরের ৪ এপ্রিল। তখন থেকে ওই বছরের ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা হাসপাতালে শিশু সার্জারি ওয়ার্ডে ছিল। ৪ ডিসেম্বর তাদের কেবিনে স্থানান্তর করা হয়। সে হিসাবে শিশু দুটি আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে হাসপাতালে আছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আগামী সপ্তাহে তাদের দুজনের কিছু শারীরিক পরীক্ষা করা হবে। এরপর ছাড়পত্র দেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। তবে তাদের মলদ্বারের একটি অস্ত্রোপচারের জন্য কয়েক মাস পর আবার হাসপাতালে আসতে হবে।
শিশু সার্জারি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক একেএম জাহিদ হোসেন বলেন, দুটি শিশু এখন ভালো আছে। তাদের পায়ুপথ জোড়া লাগানো ছিল, আলাদা করার পর তাদের কোলোস্টোমি (পায়ুপথ ঠিক করা) করতে হয়েছে। কোলোস্টোমির দ্বিতীয় ধাপের অস্ত্রোপচারটি করার প্রস্তুতির জন্য ছয় মাস থেকে এক বছর সময় লাগতে পারে। তাদের পায়ুপথের পেশিগুলো এখন অবিকশিত। এজন্য এখনই অস্ত্রোপচার করা যাবে না। অস্ত্রোপচার করলে পায়খানা করতে থাকবে, আটকে রাখতে পারবে না। এজন্য বিষয়টি মূল্যায়ন করতে হবে, তাতে ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। ছাড়পত্র দিলেও ওই শিশু দুটিকে নিয়মিত ফলোআপে আসতে হবে বলেও জানিয়ে দেন এই চিকিৎসক।
শিশু দুটির শরীরের এখন যে অবস্থা তাতে তাদের সংক্রমণ হওয়ার কোনো ভয় নেই বলেও আশ্বস্ত করেন তিনি। বলেন, হাসপাতালের বাইরের পরিবেশে তাদের খাপ খাওয়াতে হবে। বাড়ি গেলে ফ্যামিলির সঙ্গে মিশবে, অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে খেলবে। আমরা অভিভাবকদের বলে দেব বাড়ি ফিরে কী করতে হবে, কী করা যাবে না। বৃহস্পতিবার দুপুরে হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, বাবা মো. আলমগীর হোসেন শিশু দুটিকে খাবার খাওয়াচ্ছেন। খাওয়া শেষ করে দুই বোন দুটি ফ্লোরে দৌড়াদৌড়ি করছে। একটির হাঁটাচলা পুরোপুরি স্বাভাবিক, অপরটি কিছুটা বাঁকা হয়ে হাঁটে।
নুহা–নাবার বাবা বলেন, তাদের রেসপন্স ভালো। হাঁটাচলা করছে। কোমরের দিকে একটু ভাঁজ আছে। ডাক্তার বলেছেন কিছু ব্যায়াম করলে এটা আস্তে আস্তে ঠিক হওয়ার সম্ভাবনা আছে, বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পর ফিরে আবার যে অস্ত্রোপচার করতে হবে, সেটার খরচ হাসপাতাল বহন করবে নাকি তাদের নিজেদের বহন করতে হবে তা বুঝতে পারছেন না আলমগীর। এ নিয়ে কিছুটা দ্বিধায় আছেন। তিনি বলেন, আমরা বাচ্চাদের জন্য দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালে আছি। চাকরি নাই, স্বাভাবিকভাবেই চিকিৎসার খরচ বহন করা আমাদের জন্য কষ্টসাধ্য। এর মধ্যে কয়েক লাখ টাকা ধার করেছি। পরের অপারেশনটা আগে যেভাবে করেছে সেভাবে করলে আমাদের জন্য ভালো হয়।
নুহা–নাবার বাবার এই উদ্বেগের প্রশ্নে চিকিৎসক জাহিদ হোসেন বলেন, খরচের বিষয়টি আমি জানি না। এতদিন তো ইউনিভার্সিটি প্রশাসন তাদের চিকিৎসার খরচ দিয়েছে। হয়ত পরের ধাপের চিকিৎসার খরচও দেবে। আমি কেবল চিকিৎসা করব, খরচের বিষয়টি প্রশাসন জানবে।
বিএসএমএমইউর উপাচার্য সায়েদুর রহমান বলেন, ওই শিশু দুটির পরবর্তী অস্ত্রোপচারের খরচও বিশ্ববিদ্যালয় বহন করবে।
এ বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে আলাদা করা হয় নুহা–নাবাকে। বিএসএমএমইউর সার্জারি অনুষদের সে সময়ের ডিন ও নিউরোসার্জারি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ হোসেনের নেতৃত্বে ৩৯ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ ১০০ জনের দল এতে অংশ নেয়। ওই অস্ত্রোপচার করতে সময় লাগে ১৫ ঘণ্টা।
২০২২ সালের ২১ মার্চ কুড়িগ্রাম জেলার কাঁঠালবাড়ীর পরিবহন শ্রমিক আলমগীর রানা ও তার স্ত্রী নাসরিনের গর্ভে জন্ম নেয় মেরুদণ্ডে জোড়া লাগানো শিশু নুহা ও নাবা। ওই বছরের এপ্রিল মাসে বিএসএমএমইউ এর সার্জারি অনুষদের ডিন ও নিউরো স্পাইন সার্জন অধ্যাপক মোহাম্মদ হোসেনের অধীনে দুই শিশুকে ভর্তি করা হয়। ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি তাদের প্রথম ধাপের সফল অস্ত্রোপচার করা হয়। এরপর আরও কয়েক ধাপে অস্ত্রোপচার হয় এই দুই শিশুর। চূড়ান্তভাবে আলাদা করা হয় ২০২৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ওই শিশু দুটির চিকিৎসার সব খরচ সরকার বহন করে আসছে।