সবার উপরে দেশ– এটা অনেক বড় কথা। এর চেয়ে বড় কথা আর কী হতে পারে। দেশকে ভালোবাসে না এমন কেউ কি আছে? দেশের কথা ভাবে না এমন কেউ নেই। কোনো না কোনোভাবে দেশের কথা এসে যায়। দেশের কথা ভাবতে হয়। দেশ শুধু দেশ না, দেশমাতৃকার। মাতৃভূমির কথা না ভেবে পারা যায় না। এর সাথে আবেগ অনুভূতি জড়িয়ে থাকে। এতে আশা আকাঙ্ক্ষার স্বপ্ন জাগে। গড়ে তোলার স্বপ্ন, বিনির্মাণের স্বপ্ন। ভেঙেচুরে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন। এ স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার স্বপ্ন। এর জন্য মনের শক্তি অনেক বড় শক্তি। প্রয়োজন মনোবল, শক্ত মনোবল। অদম্য ইচ্ছা, অসীম সাহস। এগিয়ে চলার প্রত্যয়, দৃঢ় প্রত্যয়। স্বপ্ন পূরণে অবিচল দৃঢ়তা।
তরুণেরা এসব স্বপ্ন দেখে। দেশ গড়ার স্বপ্ন, নিজেকে তৈরী করার স্বপ্ন। নিজে তৈরী না হলে দেশ গড়ার কাজ করবে কী করে। লেখাপড়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে তৈরী করতে হয়। লেখাপড়া ছাড়া নিজেকে তৈরী করার অন্য কোনো সহজ পথ নেই। এজন্য তরুণেরা লেখাপড়ায় ব্যস্ত থাকে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তারা বিভিন্ন বিষয়ের ওপর জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পায়। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় তরুণদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে একটা পর্যায়ে নিয়ে যায়। শিক্ষা শেষে তরুণেরা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করার অপেক্ষায় থাকে। যদিওবা অনেক ক্ষেত্রে তাদের কর্মক্ষেত্রের সাথে পঠিত বিষয়ের খুব একটা সামঞ্জস্য থাকে না। তারপরও তারা শিক্ষার একটা পর্যায়ে উন্নীত হওয়ায় কর্মক্ষেত্রের কাজ সহজে আয়ত্ত করে নিতে পারে।
মানবিকতা, নৈতিকতা, দেশপ্রেম এসবের ওপর সবার কম বেশি ভাবনা থাকে। আবেগ অনুভূতি যত সহজে তরুণদের নাড়া দিয়ে যায়, এসব বিষয় সেভাবে ভাবিয়ে তোলে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসবের উপর তেমন গুরুত্ব প্রদান করা হয় না। পাঠ্যক্রমে থাকলেও এগুলোর অনুশীলন নেই বললে চলে। অনেকটা উপেক্ষিত থেকে যায়। ফলে শিক্ষার্থীরা মানবিকতা বা নৈতিকতা নিয়ে ভাবার প্রয়োজনও মনে করে না। তবে দেশপ্রেমের বিষয়টা তাদেরকে নানাভাবে আন্দোলিত করে। কারণ দেশ প্রেমের সাথে আবেগ অনুভূতির একটা সম্পর্ক থাকে। এ সম্পর্কটাকে সহজে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। তরুণদের জন্য এটা খুবই স্পর্শকাতর। এদের দেশপ্রেম আবেগ অনুভুতি দ্বারা তাড়িত হয়। এদের একবার নাড়া দিতে পারলে আর সহজে থামানো যায় না।
দেশপ্রেম অনেকভাবে দেখানো যায়। দেশকে ভালোবাসার নামই তো দেশপ্রেম। অনেকে মনে করে মানুষের কল্যাণে বা দেশের জন্য কাজ করার নাম দেশপ্রেম। আসলে সব কাজের মূল উদ্দেশ্য মানুষের কল্যাণ। কেউ মনে করে আর্তমানবতার সেবা করা, সামাজিক দায়িত্ব পালন করা কিংবা দেশের কোনো কাজের সাথে যুক্ত থাকা দেশপ্রেম। সত্যিকার অর্থে দেশপ্রেমের কোনো সীমা পরিসীমা নেই। প্রত্যেকেরই দেশপ্রেমের সাথে যুক্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। যে যেই কাজটি করে সেটি সঠিকভাবে করার মাঝে লুকিয়ে আছে দেশপ্রেম। তবে মানুষের জন্য বা দেশের জন্য অকল্যাণকর কোনো কাজই দেশপ্রেমের আওতাভুক্ত নয়। যে যেখানে থাকুক না কেন নিজের কাজ বা দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করার আরেক নাম দেশসেবা। কারণ প্রতিটি কাজের সুফল কোনো না কোনোভাবে দেশের মানুষের কল্যাণে আসে।
তরুণ শিক্ষার্থীরা কোনো কোনো সময় দেশ সেবার কাজে নিয়োজিত হয়। বিশেষ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় তারা আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে আসে। বিভিন্ন জায়গা থেকে অর্থ সংগ্রহ করে বন্যাকবলিত দুর্গত এলাকায় গিয়ে সহয়তা প্রদান করে। চিকিৎসক টিম গঠন করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করে। এসব উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় এবং অন্যদের কাছেও অনুকরণীয়। প্রবল জলোচ্ছ্বাস ও ঘুর্ণিঝড়ে বিপর্যস্থ এলাকায়ও শিক্ষার্থীরা ত্রাণ বিতরণ ও চিকিৎসা সেবা প্রদান করে। শিক্ষার্থীদের শিক্ষার পাশাপাশি আর্তপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মানসিকতা দেশ প্রেমেরই উৎকৃষ্ট উদাহরণ। নিজেদের উদ্যোগে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে তারা এ মহৎ কাজটি করে থাকে। ছাত্রাবস্থায় এরকম সেবামূলক উদ্যোগের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে ভবিষ্যতে দেশ প্রেমের সেবার পথ সুগম করে। এজন্য তরুণ শিক্ষার্থীদের এরকম মহৎ উদ্যোগগুলোর সাথে সমাজের অন্য সবাইয়ের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত হওয়া এবং তাদের অনুপ্রাণিত করা প্রয়োজন।
শিক্ষার্থীরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়, প্রতিবাদ করে। তরুণদের ধর্মই তাই। তারা কোনো অন্যায় অত্যাচারকে মেনে নিতে পারে না। অন্যরা সমাজের ঘাত প্রতিঘাতগুলো দেখতে দেখতে ধাতস্থ হয়ে যায়। প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলে। সবকিছু মুখবুজে মেনে নেয়। তরুণেরা তার সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা প্রতিবাদী হয়ে উঠে। সহজে একতাবদ্ধ হয়ে যেতে পারে। যে কোনো কিছুতে অবিচল থাকতে পারে। তাদের আর সহজে থামানো যায় না। দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা এগিয়ে যায়। যে কোনো বাধাকে অতিক্রম করতে পারে। তারুণ্যই তাদেরকে এগিয়ে নিয়ে যায়। শক্ত বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখে। শিক্ষার্থীদের দাবী আর কী হতে পারে। কিন্তু প্রতিপক্ষ সহজে কোনো কিছু মানতে চায় না। নানা রকম কূট কৌশল ও দমন পীড়নের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের থামিয়ে দিতে চায়। তরুণেরা কোনো কিছুর কাছে হার মানে না। কখনো নতি স্বীকার করতে পারে না। এমনকি মৃত্যুও তাদের থামিয়ে রাখতে পারে না। শেষ পর্যন্ত তরুণদের কাছে প্রতিপক্ষের হার মানতে হয়। তরুণেরা ভবিষ্যতের জন্য নতুন একটা পথ তৈরী করে দিতে পারে।
যারা সাফল্য অর্জন করতে পারে, তারা নতুন পথ দেখাতে পারে। সেই সাফল্যকে ধরে রাখা এবং নতুন পথে চলার দায়িত্ব সবার। তবে এ পথ সহজ ও মসৃণ নয়, অনেকটা বন্ধুর, আবার কোথাও কোথাও দুর্গম। এ দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতির প্রয়োজন। এ পথ অতি দীর্ঘ, সহজে শেষ হয়না। এ পথে দীর্ঘ সময়ের জঞ্জাল পরিষ্কার করে এগিয়ে চলতে হয়। নানা ধরনের বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে হয়। কখনো কখনো এমন বাধা এসে যায় যা অতিক্রম করা যায় না। তবে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সবার অংশ গ্রহণে বড় বাধাকে অতিক্রম করা যায়। এজন্য সাফল্যের সার্বিক সফলতা অর্জন করতে হলে সবার অংশ গ্রহণের মাধ্যমে পথ চলার কোন বিকল্প নেই।
আগে বলা হতো সবার উপরে দেশ। এখন বলা হয় সবার আগে দেশ। দুটি বাক্য সমার্থক হলেও কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। দেশ সবার উপরে–একেবারে খাটি কথা। এর উপর আর কি থাকতে পারে। দেশের চেয়ে আর বড় কিছু নেই। কিন্তু পিতামাতার কাছে সন্তান সবচেয়ে বড়। এ সন্তানেরা দেশের জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়। এর চেয়ে আর বড় কি হতে পারে। এমন সন্তানের পিতামাতার হওয়াও গৌরবের বিষয়। এদের এ মহান ত্যাগকে দেশ ও জাতি মনে রাখে। স্মরণ করে, শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। এ ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত সাফল্যকে ধরে রাখতে হয়। সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়। এ দায়িত্ব সবার। সম্মিলিতভাবে এ দায়িত্ব পালন করা না হলে অর্জিত সাফল্যের সুফল পাওয়া যায় না। সাধারণের কাছে এর সুফল পৌছে দিতে চাইলে সমন্বিত উদ্যোগের খুবই প্রয়োজন।
সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে এ ধরনের মহৎ উদ্যোগ বাস্তবায়ন সম্ভবপর হয়ে ওঠে। এসব ক্ষেত্রে ব্যক্তি স্বার্থের চেয়ে দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হয়ে। দেশের স্বার্থকে সবার আগে দেখতে হয়। এজন্য বলা হয় সবার আগে দেশ। বহুকাল থেকে দেশের স্বার্থকে খুঁজতে দিয়ে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। ফলে যুগের পর যুগ দেশের স্বার্থ আর সমুন্নত থাকেনি। ব্যক্তি বিশেষের মাঝে এমন এক মানসিকতা বিরাজ করে নিজের স্বার্থকে আগে দেখে। নিজের স্বার্থকে রক্ষা করতে গিয়ে বার বার দেশের স্বার্থকে ক্ষুণ্ন করে। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রে নিজের স্বার্থও রক্ষা হয়নি। ক্ষুদ্র ব্যক্তি স্বার্থের চেয়ে সামগ্রীক স্বার্থের দিকে মনোনিবেশ করা প্রয়োজন। সবক্ষেত্রে সামগ্রিকতার দিকে এগিয়ে যেতে পারলে দেশের কথা ভাবা সহজ হয়। দেশকে ভালোবাসা যায়। দেশকে ভালোবাসার চেয়ে মহৎ কাজ আর কি থাকতে পারে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংক নির্বাহী