প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স (শূন্য সহনশীলতা)’ দেখানো, মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নেওয়াসহ নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যদের প্রতি একগুচ্ছ নির্দেশনা দিয়েছেন। সোমবার নতুন মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী এসব নির্দেশনা দেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকের পর সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাসহ মন্ত্রিসভার বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন। তিনি বলেন, বৈঠকে মন্ত্রিসভার পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানানো হয়। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী তাঁর তরফ থেকে মন্ত্রীদের কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন।
সরকারি ক্রয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর ‘জিরো টলারেন্স’ থাকবে। সব মন্ত্রণালয়কে একই নীতি অনুসরণ করতে বলেছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কেউ যদি কোনো অনিয়ম করেন বা কোনো দুর্নীতি করেন, তাহলে তাঁর কোনো মাফ নেই, ছাড় নেই। প্রধানমন্ত্রী কঠোরভাবে এ বিষয়টি দেখবেন। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় মিতব্যয়ী হওয়া, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা, সৎ ও স্বচ্ছ থাকা এবং কোনো ক্রয়প্রক্রিয়ায় কোনো অনিয়ম করা যাবে না। কোনো পর্যায়ে প্রকল্পের কাজ ধীরগতি করা যাবে না। আর প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে নাগরিক সুবিধা দেখে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন বলেন, প্রধানমন্ত্রী মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের নির্দেশনা দিয়েছেন। বিশেষ করে আগামী পবিত্র রমজান মাসে যাতে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং একই সঙ্গে রমজান মাস–সংশ্লিষ্ট যেসব পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়, সেগুলোর সরবরাহ পরিস্থিতি যাতে স্বাভাবিক থাকে, সে ব্যাপারেও কাজ করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী কর্মপরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্সের’ কথা পুনর্ব্যক্ত করেন দীপ্তকণ্ঠে। এর আগেও দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতেই এগিয়ে চললেও সরকারের নানা বিভাগে তা হ্রাস পায়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় দেশজুড়ে চলেছে দুর্নীতিবিরোধী সর্বাত্মক অভিযান। যত প্রভাবশালী এবং সরকার কিংবা ক্ষমতাসীন দলের যত ঘনিষ্ঠই হোন না কেন, ছাড় দেননি কোনো অপরাধীকে। কারও ব্যক্তিগত অপরাধের দায় নিতেও নারাজ ছিল সরকার ও দল। সরকারের এই কঠোর অবস্থান সুধী সমাজসহ সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে।
দেশে দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান থাকার পরও দুর্নীতির হ্রাস না হওয়ায় অবাক হয়েছেন দেশের সাধারণ জনগণ। অভিযোগ আছে, তাঁরা দুর্বল আর সমাজের সাধারণ মানুষের বিষয়ে যতটা সোচ্চার, ততটা নন ক্ষমতাবান রাজনীতিবিদ, আমলা কিংবা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে সেগুলো খুব কমই আমলে নেওয়া হয় বলে মনে করেন দেশের অনেকে। সাধারণ মানুষের মধ্যে দুর্নীতিবিরোধী সচেতনতা তৈরির ওপর জোর দিয়েছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, তাঁর এক বক্তৃতায়। তিনি বলেন, দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার মাধ্যমেই কেবল দুর্নীতিকে সহনশীল মাত্রায় কমিয়ে আনা সম্ভব। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বব্যাপী প্রতিরোধ গড়ে তোলার বিকল্প নেই। কোনো মানুষ দুর্নীতিবাজ হিসেবে জন্মগ্রহণ করে না। পারিবারিক, সামাজিক ও আশপাশের পরিবেশই মানুষের জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। তাই দুর্নীতিবিরোধী অভিযান নিজের ঘর থেকেই শুরু করতে হবে। দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। সৎ, আন্তরিক ও নিষ্ঠাবানদের সামাজিকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। তাহলেই দুর্নীতি হ্রাস পাবে।
বিশ্লেষকরা বলেন, একধরনের বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে দেশে। তাতে পরোক্ষভাবে দুর্নীতিবাজদের পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে দুর্নীতির বিষয়টি অস্বীকার করা হয়। কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করলে নাগরিকসমাজ ও গণমাধ্যমকর্মীদের নাজেহাল হতে হয়। ফলে দুর্নীতিবাজরা এতে উৎসাহিত হচ্ছে। বাংলাদেশে আরও কয়েকটি কারণে দুর্নীতি কমানো যাচ্ছে না। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল– রাজনীতিবিদদের প্রতিশ্রুতির ঘাটতি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবহিদিতার অভাব, রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য অবস্থান সংকুচিত করে দেয়া এবং গণমাধ্যম ও সুশীলসমাজের প্রতিনিধিদের কথা বলার সুযোগ সীমিত করে দেয়া।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দুর্নীতি প্রতিরোধ ও দুর্নীতি দমনের অভিযানকে সফল করতে হলে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ–উদ্যমকে একযোগে কাজে লাগাতে হবে। তবে এই কঠিন লক্ষ্যে সফলতা অর্জনের একটি পূর্বশর্ত হচ্ছে দুর্নীতি সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা। যদি সংঘবদ্ধ ও সমন্বিতভাবে দুর্নীতির কদর্য চেহারাকে পরিচিত করে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে এবং জনস্বার্থে এর কুফল সম্পর্কে তথা জনসচেতনতা সৃষ্টি করা যায়, তাহলে দেশ আরও এগিয়ে যাবে।