প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম এলেই পাহাড় ধসের শঙ্কা বাড়ে। এর পর কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেন কর্তৃপক্ষ। ভারী বৃষ্টি হলে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে রাখেন তাঁরা। বর্ষা চলে গেলে আর কোনও খবর থাকে না। যার কারণে প্রতিবছর পাহাড় ধসে প্রাণহানি হচ্ছে, ক্ষতি হচ্ছে সম্পদ।
কিন্তু এবছর বর্ষা আসার আগেই পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের উচ্ছেদের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে– যা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। গত ৪ এপ্রিল দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, নগরীর লালখান বাজারের মতিঝর্না এলাকায় অবৈধভাবে গড়ে ওঠা কাঁচাপাকা, সেমিপাকা থেকে শুরু করে বহুতল ভবনগুলো ভেঙে ফেলা হবে। দখলে যে–ই থাকুক উচ্ছেদ করা হবে। এজন্য রেলওয়ের প্রতিনিধির কাছে তালিকা চাওয়া হয়েছে। পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির ২৬তম সভায় জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান এ কথা বলেন। সভায় বিভাগীয় কমিশনার পাহাড়ে অবৈধ বসতি দ্রুত উচ্ছেদ করা হবে বলে জানান। সভায় বলা হয়েছে, নগরীর পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারী পরিবারের তালিকা হালনাগাদ করা হয়েছে। বিভিন্ন সংস্থা ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী নগরীর ২৬টি পাহাড়ে অবৈধ বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৬ হাজার ৫৫৮টি। ২৬টি পাহাড়ের মধ্যে ১৬টি সরকারি সংস্থার এবং ১০টি ব্যক্তি মালিকানাধীন। এ সময় পাহাড় কীভাবে ব্যক্তি মালিকানাধীন হয় তা জানতে চান বিভাগীয় কমিশনার। তিনি প্রশ্ন করেন, এই বন্দোবস্ত দেয় কে? মালিকের সোর্স কী? এর জবাবে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বলেছেন, ২০০২ সালের আগে হয়েছে এসব বন্দোবস্ত। এর পরে আর হয়নি। সভায় পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিনিধি বলেন, পাহাড় নিয়ে কোনো অসঙ্গতি দেখলে মামলা করা ছাড়া পরিবেশের আর কোনো কাজ নেই। এক বছরে বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ৮৪টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। বিভাগীয় কমিশনার বলেন, আমাদের সকলকে একত্রিত হতে হবে। তাহলে পাহাড়কে দখলমুক্ত করা যাবে। অবৈধদের উচ্ছেদ করতেই হবে। পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হবে। যাদের উচ্ছেদ করা হবে তাদের একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এ বিষয়ে আমাদেরকে সচেতন হতে হবে।
আসলে চট্টগ্রামে প্রতিবছর কোনো না কোনো জায়গায় পাহাড় ধসের ঘটনায় ঘটে প্রাণহানি। গত ১৩ বছরে পাহাড় ধসে দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যু হলেও থেমে নেই ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস। টানা ভারী বৃষ্টিতেও পাহাড়ে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে অনেক পরিবার। তাদের সরানো হয় শুধু বর্ষা মৌসুমে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, যদি স্থায়ী কোনও সমাধান না হয় তাহলে প্রাণহানি আরও বাড়বে। নগরীতে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বসবাস করছে ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ। তাদেরকে সেখানে বসবাসের সুযোগ করে দিচ্ছে কিছু চিহ্নিত সন্ত্রাসী। আগে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। অপরিকল্পিত নগরীতে কোনো পরিকল্পনা নেই। যদি পরিকল্পনা থাকতো তাহলে তাদের কোথাও স্থায়ীভাবে সরিয়ে নেওয়া যেত।
পাহাড়ধস বন্ধে বেশ কিছু পাহাড় সংরক্ষণ করে দেখা যেতে পারে বলে অভিজ্ঞমহল মত প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলেন, পাহাড়গুলো আমাদের সম্পদ, প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য। প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকা যায় না! ধারাবাহিকভাবে পাহাড়ের ক্ষতি করে চললে পাহাড়ও একসময় তার প্রতিশোধ নেবে। পাহাড়কে নিজেদের স্বার্থে কোনো গোষ্ঠী বা চক্র যেন ব্যবহার করতে না পারে, সেদিকে নজর দিতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রবেশদ্বার’ খ্যাত এ শহরের অপরূপ সৌন্দর্যের অন্যতম উপাদান হচ্ছে পাহাড়। পাহাড়ের সঙ্গে রয়েছে এ শহর ও অঞ্চলের আত্মিক বন্ধন। পাহাড় ধ্বংস করা হলে এ শহরের ভৌগোলিক চরিত্রও বদলে যেতে পারে। সংঘবদ্ধ কয়েকটি চক্রের লালসা পাহাড়ের সৌন্দর্য নষ্ট করছে। বেলেমাটির পাহাড় একটু কাটা হলেই বাকি অংশও ধসে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। সামনের বছরগুলোতে পাহাড়ধস আবারও যে মৃত্যুর কারণ হবে না, তার নিশ্চয়তা নেই! সহজকথায় পাহাড়কাটা বন্ধ করতে হবে, ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে সব ধরনের বসতি উচ্ছেদ করতে হবে।
পাহাড়ধস প্রতিরোধে নানারকম কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের উচ্ছেদের পাশাপাশি পাহাড় ঝুঁকিমুক্ত ও বসবাসের উপযোগী কি না তা যাচাই করতে হবে। পাহাড় কাটা প্রতিরোধে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের যথাযথ প্রয়োগ ঘটাতে হবে এবং পরিবেশ অধিদপ্তরকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।