কোরআন তেলাওয়াতের মর্যাদা ও বিশ্লেষণ (পর্ব-২)

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | শুক্রবার , ৬ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৪:৫৭ পূর্বাহ্ণ

মানব হৃদয়ে সবটুকু আবেগ-অনুরাগ ঢেলে দিয়ে আল কোরআনের সাথে নিজের মানবসত্তাকে একাকার করে তোলা একজন তেলওয়াতকারীর অন্যন্য বৈশিষ্ট্য হওয়া চাই। কোরআন পাঠকের সমস্ত হৃদয়জুড়ে থাকবে আল-কারআনের শিক্ষা ও তার থেকে নির্যাস ধারণের অবিরত প্রচেষ্টা ও কৌতুহল। বিশেষত তেলওয়াত শব্দটির গভীরে রয়েছে এর মূল অর্থ উপলব্ধি করা, অনুধাবন করা। কেননা মানুষ তো বুদ্ধিদীপ্ত সত্তা। কোরআনের অর্থ না বুঝে মন্ত্রের মতো কিছু পাঠ করা তার জন্য শোভনীয় নয়। এমনকি শিশুরাও কিছু পড়লে তার অর্থ বুঝার জন্য কেমন যেন কৌতুহলী হয়ে উঠে। কারণ অনুধাবনশূন্য পাঠে মানুষের প্রকৃত জ্ঞান ও ক্ষুধা চরমভাবে উপেক্ষিত হয়, মানসিক বিকাশ ও প্রশান্তি ব্যাহত হয়। এটি নিজের উপর মহাজুলুম।

আল্লাহতায়ালা মানুষকে যে বিবেক বুদ্ধি, চিন্তা-চেতনা, গবেষণা ও ধী শক্তি প্রদান করেছেন তা ধীরে ধীরে লোপ পেতে থাকে। চূড়ান্ত পরিণামে সে নির্বোধ পশুদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায়। আর সেটাই আল্লাহতায়ালা অনেক সুন্দরভাবে তাঁর সত্য কিতাবে বর্ণনা করছেন এভাবেই, ‘তাদের হৃদয় আছে, কিন্ত তা দিয়ে তারা উপলব্ধি করে না, তাদের চক্ষু আছে তা দিয়ে তারা দেখে না, এমন কি তাদের কর্ণ আছে তা দিয়ে তারা শুনে না; তারা পশুর ন্যায় বরং তারা পশুর চেয়ে অধিক বিভ্রান্ত, তারাই গাফিল’। সূরা আরাফ- ১৭৯। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, আমরা অধিকাংশ মুসলমান আজ কোরআনুল করীমের অর্থ অনুধাবনের প্রতি কোন গুরুত্বই প্রদান করি না বরং তাদের অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, কুরআন খতম করাই যেন কুরআন পাঠের মূল উদ্দেশ্য।

একজন কুরআন গবেষক বলেছেন: লিসান, আকল ও কলবের সক্রিয় ভূমিকার সমন্বয়ে যে তেলওয়াত সম্পাদিত হয়, তাই হচ্ছে প্রকৃত তেলওয়াত । যার মাধ্যমে কাঙ্খিত ফলাফল অর্জন করা সম্ভব। লিসানের ভূমিকা হচ্ছে: তারতীলের সাথে বিশুদ্ধ উচ্চারণে কুরআন পড়া। আকলের ভূমিকা হচ্ছে: অর্থ বিশ্লেষণ। আর কলবের ভূমিকা হচ্ছে: শিক্ষা ও উপদেশ গ্রহণ করা এবং মেনে নেয়া। মোট কথা লিসান তারতীলের সাথে পাঠ করবে, আকল তা অনুবাদ করবে এবং কলব তা গ্রহণ করবে। হযরত ইবনু মাসঊদ (রা:) থেকে বর্ণিত-তিনি বলেন: ‘আমরা রাসূলের কাছ থেকে দশটি দশটি করে আয়াত শিখতাম। যতদিন না এই দশটি আয়াতের শিক্ষা ও মর্ম বুঝে তা কর্মে বাস্তবায়ন করতাম, ততদিন অন্য দশটি আয়াত শিখতাম না’। ইবনু ওমর (রা:) থেকে বিশুদ্ধ বর্ণনায় এসেছে: ‘তিনি (ইবনু ওমর) শুধুমাত্র সূরাহ আল্‌-বাকারা’র পঠন ও এর অন্তর্নিহিত শিক্ষা ও তাফসীর আয়ত্ত করতে আটটি বছর কাটিয়ে দিয়েছিলেন’।

মূলত কোরআন তেলওয়াত ও মুখস্ত করার মূখ্য উদ্দেশ্যই হল: তা হৃদয়ের ভেতর প্রোথিত করা এবং এর সার্বজনীন শিক্ষা, এর ভাষাশৈলী, এর নিগুঢ় অর্থ ও তাৎপর্য উপলদ্ধি করা। কারণ এ ধরনের তেলওয়াতেই পাঠকের হৃদয়বৃত্তিকে গভীরভাবে আন্দোলিত ও প্রভাবিত করতে পারে। তার ভেতর আল্লাহর ভয়, আল্লাহ প্রেমের বহিঃপ্রকাশ ও তার সান্নিধ্য লাভের অকৃত্রিম আকুলতা জাগিয়ে তুলতে পারে। এজন্যে মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা অবতীর্ণ করেছেন উত্তম বাণী সম্বলিত কিতাব যা সু-সামঞ্জস্য এবং যা পুনঃ পুনঃ আবৃত্তি করা হয়।

এতে তারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, তাদের গাত্র রোমাঞ্চিত হয়, অতঃপর তাদের দেহ-মন বিনম্র হয়ে আল্লাহর স্মরণে ঝুঁকে পড়েন। ইহাই আল্লাহর পথনির্দেশ, তিনি এর দ্বারা যাকে ইচ্ছা পথ প্রদর্শন করেন’। সুরা-ঝুমার-২৩। মহান আল্লাহতায়ালা অন্য এক আয়াতে বলেন, ‘মোমিন তো তারাই যাদের হৃদয় প্রকম্পিত হয়-যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয় এবং যখন তাঁর আয়াত তাদের নিকট পাঠ করা হয়, তখন তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি পাই এবং তারা তাদের প্রতিপালকের উপরই নির্ভর করে’। সূরা আনফাল-২। অনুধাবনশূন্য, প্রাণহীন, নিছক তেলওয়াতের জন্য কোরআন অবতীর্ণ হয়নি-এই সত্যের প্রতি কোরআন মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে বারবার।

আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, ‘এই কল্যাণময় কিতাব, ইহা আমি তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহ অনুধাবন করে এবং বোধশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিগণ গ্রহণ করে উপদেশ’। সূরা সাদ- ২৯। ‘তবে কি তারা কুরআন সম্বন্ধে অনুধাবন করে না? ইহা যদি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নিকট হতে আসত তবে তারা তাতে অনেক অসংগতি পেত’। সূরা আন-নিসা-৮২। যারা এই কুরআন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে না আল্লাহ তাদেরকে কঠোর ভাষায় আক্রমণ করে প্রশ্ন করেছেন, ‘তবে কি তারা কুরআন সম্বন্ধে অভিনিবেশ সহকারে চিন্তা করে না? তাদের অন্তর তালাবদ্ধ’। সূরা-মুহাম্মদ-২৪। অন্য একটি আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তবে কি তারা এই বাণী অনুধাবন করে না? অথবা তাদের নিকট কি এমন কিছু এসেছে যা তাদের পূর্ব পুরুষদের নিকট আসেনি?-সূরা আল্‌-মোমিনুন-৬৮। ‘যে ব্যক্তি আল্লাহতায়ালার সাথে কথা বলতে চায়, সে যেন কোরআন তেলওয়াত করে’।

পাঠকের হৃদয়ে যদি এ ধরনের অনুভূতি জাগ্রত থাকে যে, তিনি স্বয়ং এবং সরাসরি আল্লাহর সাথে বাক্যালাপ ও অভিসার করছে, তাহলে তিনি সহজেই কোরআন আত্নস্থ করতে পারবেন। পারবেন প্রতিটি আয়াতের অর্থ আবেদনের সাথে নিজের দৈহিক, মানসিক বিক্রিয়াকে পরিশোধিত করে নিতে। ইমাম হাকিম বর্ণনা করেন যে, ‘রাসূল (সাঃ) একদা সাহাবীদের সামনে আর-রহমান সূরাটি পাঠ করলেন। তারা নিঃশব্দে গভীর মনোযোগের সাথে তা শ্রবণ করলেন। (কিন্তু কেউ কোন প্রকার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন না)। তখন রাসূল (সাঃ) বললেন, এই সূরাটি জ্বিনদের সামনে তেলওয়াত করেছি, তারা প্রতিক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশে তোমাদের চেয়ে উত্তম ছিল। আমি যতবারই এই আয়াতটি পুনরাবৃত্তি করেছি, ‘অতএব হে জ্বিন ও ইনসান! তোমরা আল্লাহর কোন কোন নেয়ামতকে অস্বীকার করবে?’ অতপর তারা তৎক্ষণাৎ জবাব দিয়েছে, ‘হে আমাদের প্রভু-আমরা তোমার কোনো নেওয়ামতকে অস্বীকার করি না, তোমার জন্যই সকল প্রশংসা’

লেখক: সভাপতি-রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাংলাদেশের মেয়ে
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা