আমরা মানুষ। জীবনধারণের লড়াইয়ে টিকে থাকা প্রাণীজগতের মধ্যে বুদ্ধির নিরিখেই সর্বোচ্চ প্রাণী বলে নিজেদের দাবি করি। তথাপি এই বুদ্ধিমান প্রাণীটিও কখনো কখনো বেঁচে থাকার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে হতাশায় নিমগ্ন হয়ে যায়। এমনকি বেছে নেয় আত্মহননের মত চরম পথ! নিজেদের জীবন জীবন রাখা-না রাখার সিদ্বান্তে নিজেরা স্বাধীন বলেই হয়তো বিশ্বের এক মিলিয়ন মানুষ এই পথ বেছে নেয়। এমনকি যে সমস্ত দেশে বা সমাজে আত্মহত্যা বেআইনী বা নিষিদ্ধ সেখানেও মানুশের আত্মহত্যার কমতি নেই।
সমপ্রতি আমাদের দেশের একটা আত্মহত্যার ঘটনা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে তুমুলভাবে চর্চিত হচ্ছে। আবু মহসিন খান নামক জনৈক ৫৮ বছরের এক ব্যবসায়ী ফেসবুক লাইভে এসে নিজের হতাশার কথা জানিয়ে ফিল্মি কায়দায় নিজের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করে।
এটা ঠিক যে, অত্যন্ত অনভিপ্রেত এই ঘটনাটা মানুষের চর্চায়-আলোচনায় ফানুসবাতির মত যেভাবে উপরে উঠেছে, তেমনিভাবেই আবার কিছুদিনের মধ্যে মানুষের সকল আগ্রহ হারিয়ে ধপ করে নিভে যাবে। কারণ এধরণের বেদনাদায়ক ঘটনাগুলো মানুষ বেশিদিন মনে রাখতে চায় না।
কিন্তু শত এড়িয়ে যেতে চাইলেও এই জ্বলন্ত সমস্যাটাকে এড়িয়ে যাবার তো কোন জো নেই আমাদের!
২০১৯ সালে ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র এক ভয়ংকর পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে বিশ্বে একজন মানুষ আত্মহত্যা করে।
আরোও বলা হয়েছে, পৃথিবীতে যত আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে তার প্রায় ১৭% ঘটে এই ভারতীয় উপমহাদেশেই। প্রতি ৪ মিনিটে এখানে ১জন মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করে এবং তার মধ্যে ৩ জন মারা যায়।
এর মধ্যে প্রায় ৩০% মানুষের বয়স ১৫-২৫ এর মধ্যে। ৩৪% এর বয়স ২৬-৪০ এর মধ্যে। তালিকায় এর চেয়ে বেশি বয়সের ব্যক্তিও আছেন তবে কিছুটা বিরল।
এই ভয়াবহ তথ্য প্রকাশের পরেও কি মানুষ নামক এই শ্রেষ্ঠ জীবটির জীবনধারণে অনাগ্রহী মানুষগুলো সম্বন্ধে আমরা উদাসীন হয়েই থাকবো? অবশ্যই নয়! বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে নিজেদের স্বার্থে, প্রিয়জনদের স্বার্থে দুটো প্রশ্নের উত্তর খোঁজা আমাদের জন্য খুবই জরুরি।
(১) মানুষ কেন আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়?
(২) মানুষের এই আত্মহত্যার প্রবণতা রোধ করা যায় কিভাবে?
মনে রাখতে হবে, প্রতিটি আত্মহত্যাই একটি পৃথক ঘটনা। সবার জন্য কারণটা একইরকম হয় না। তবে মনোবিজ্ঞানের বিশ্লেষণে কিছু ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, যার সাহায্যে প্রতিরোধের উপায় খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।
আত্মহত্যার কারণ:
শুরুর দিকে মনে করা হতো যে, (ফ্রয়েডীয় মতবাদ) আত্মহননকারীর কারোও উপর রাগ থাকলে, সেই রাগকে অপর ব্যক্তির উপর প্রকাশ না করে তা নিজের দিকেই অভিমুখ পরিবর্তন করে নেয়। অর্থাৎ নিজেকে শাস্তি দেওয়ার মাধ্যমে অন্যকে শাস্তি দিতে চায়। এটা আত্মহননকারী সাময়িক উত্তেজনার বশে নিজের অবচেতন মনের তাড়নাতেই করে থাকে।
কিন্তু বর্তমানে বিষয়টাকে এত সরলভাবে দেখা হয় না। এখনকার মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, অনেক মানুষের একটা ‘সুইসাইডাল আইডিয়েশন’ থাকে। অর্থাৎ আত্মহত্যা সংক্রান্ত কিছু নিজস্ব চিন্তা। এছাড়াও থাকতে পারে ‘সুইসাইডাল ফ্যান্টাসি’! (যেমন – ফেসবুক লাইভে এসে সবাইকে সাক্ষী মেনে আত্মহত্যা। যেটা ইদানীং খুব দেখা যাচ্ছে আমাদের সমাজে)।
অর্থাৎ ব্যক্তি কল্পনা করে, যদি সে মারা যায় তবে পরিস্থিতি কেমন হবে? সে আরো ভাবে, যার উপর তার রাগ আছে সে হয়তো চরম শাস্তি পাবে! কিংবা তার হয়তো এটাও মনে হতে পারে, যে তাকে এতদিন অবহেলা করেছে, সে নিশ্চয় তার মৃত্যুতে অনেক আফসোস করবে! মূলত যেসব বিষয়ের উপর আত্মহত্যার প্রবণতা নির্ভর করে তার মধ্যে অন্যতম হলো, ‘চরম মানসিক অবসাদ’ এবং ‘অসহায়তাবোধ’, যা জন্ম নেয় সামাজিক বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে। যেমন-পারিবারিক সমস্যা, ভারসাম্যহীন দাম্পত্য, অপরিণত ব্যক্তিত্ব, কোনো কঠিন শারীরিক অসুস্থতা, ব্যবসায়িক অসফলতা, হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনো ভুলের জন্য চরম সামাজিক অসম্মানের ভয় ইত্যাদি, যেখান থেকে ঐব্যক্তি উদ্ধার পাওয়ার আর কোনো রাস্তা খুঁজে পায় না। মৃত্যুই তার কাছে তখন শ্রেয় মনে হয়।
আবার কোনো কোনো তীব্র মানসিক অসুখে (যেমন সিজোফ্রেনিয়া) কোনো বিশেষ কারণ ছাড়াও রোগী আত্মহত্যা করতে পারে।
আত্মহত্যার প্রতিরোধ ব্যবস্থা:
আজকের দিনে একটা কথা আমাদের স্পষ্টভাবেই বুঝে নেওয়া ভালো যে, আইনের চোখে আত্মহত্যাকে অপরাধ হিসেবে দেখে, বা ধর্মগ্রন্থের আত্মহত্যাবিরোধী নীতি শুনিয়ে আত্মহননকারীর মানসিকতা পরিবর্তন করা যাবে না।
আত্মহত্যার উদ্দেশ্য দু’ ধরনের হতে পারে।
এক. আত্মহত্যার মাধ্যমে কোনো পরিস্থিতির পরিবর্তন করতে চাওয়া, অন্যকথায়, সেই পরিস্থিতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা। এই দুষ্কর্ম হঠাৎ কোনো উদ্ভুত পরিস্থিতিতে বা ঝোঁকের বশেও হতে পারে।
দুই. জীবনের উপর তীব্র বীতশ্রদ্ধ হয়ে দীর্ঘদিন থেকে মরে যাবার স্পৃহা। কখনো কখনো মানুষ বহুদিন এমনকি বহুবছর ধরেই আত্মহত্যার প্রস্তুতি নিতে পারেন, এবং অনেক সংগোপনে ঠাণ্ডা মাথায় এর পরিকল্পনা করতে পারেন। আমার ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয়েছে সেটাই হয়েছে হতভাগ্য আবু মহসিন খানের ক্ষেত্রে।
অর্থাৎ কোন পরিস্থিতিতে কে, কবে আত্মহত্যা করবে, তা আগে থেকে বোঝা সম্ভব নয়, যদি না সেই সম্ভাবনার কথা আগে থেকেই মাথায় রাখা হয়। ছোট করে বলতে গেলে এটাই বলতে হয়, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষের তিনটা জিনিষের প্রয়োজন হয়।
১. সহানুভূতি, ২. বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার মত ব্যক্তিত্ব, ৩. সময়মতো সঠিক পদক্ষেপ।
অনেকসময় মা-বাবারা সন্তানকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত শাসন করেন বা ওভার প্রটেকশন দেন, যার ফলে, সন্তানের মধ্যে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা বা প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করার কোনো ক্ষমতাই তৈরি হয়না। কখনো বা দাম্পত্যের অন্তর্কলহ সন্তানকে দুর্বল ও নিষ্পেষিত করে দেয়। নিজের ইচ্ছেটা প্রকাশ করার বা মনের কথা খুলে বলার মত সাহসটাও তার থাকে না। এর ফল যে কতটা মারাত্মক হতে পারে তা আমরা খবরের কাগজ খুললেই দেখতে পাই। বাবা- মায়ের কাছে আবদার করে সামান্য মোবাইল ফোন না পেয়েও কিশোর বা কিশোরী আত্মহত্যা করে ফেলে! এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য খুউব প্রয়োজন অন্তত একজন হলেও ভাল বন্ধু, যা আমাদের বর্তমান সমাজে খুবই বিরল হয়ে যাচ্ছে।
নিজের যে সমস্যাগুলো কাউকে ভিতরে ভিতরে নিঃশেষ করে দিচ্ছে সেগুলো প্রকাশের জন্য কারোও সমর্থন বা সহানুভূতি ভীষণভাবে অপরিহার্য। সামাজিক অখণ্ডতা অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও মানুষকে টিকে থাকতে সহায়তা করে। পরিবারের ভূমিকাও এক্ষেত্রে অপরিসীম! কোনো মানুষ, সে হোক কিশোর-কিশোরী বা বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, যদি মানসিক অবসাদের শিকার হন, তবে তাকে সহানুভূতি জানান। ভরসা দিন, কঠিন সমালোচনা করে তাকে আরোও বিধ্বস্ত করবেন না। একা ছেড়ে দেওয়া যাবে না একেবারেই। প্রয়োজনে উপযুক্ত বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। লোকে ‘পাগল’ বলবে এই ভেবে যদি কোনো ব্যবস্থা না নেয়া হয় তবে আপাত সহনীয় পরিস্থিতি ভয়ানক হতে বেশি দেরি নাও হতে পারে। আমাদের দেশের সমস্যা হলো, এখানে মনের কোনো চিকিৎসা হয় না। অথচ উন্নত বিশ্বে শরীরের সকল অংগ-প্রত্যংগের রোগের মত মনের রোগেরও যথোপযুক্ত চিকিৎসা হয়। সেখানে মনোবিদরা রোগীকে সরাসরি প্রশ্ন করেন আত্মহত্যা এবং তার বিস্তারিত বিবরণ নিয়ে। তবে আমাদের দেশেও অধুনা বেশ কিছু চিকিৎসক -মনোবিজ্ঞানী এসব বিষয় নিয়ে এগিয়ে এসেছেন যা আমাদেরকে আশার আলো দেখায়।
রোগী তার অন্তর্মুখী মনের জটিল সব বিষয় তার পরিচিত কোনো লোককে ভরসা করে নাও বলতে পারেন। তবু কথা বলুন, সাহস দিন, ভরসা যোগান। প্রয়োজনে চিকিৎসকের কাছে যেতে তাকে উদ্বুদ্ধ করুন।
হাইরিস্ক পেশেন্ট অর্থাৎ যারা ঘনঘন মরে যাওয়ার কথা বলেন, তীব্র ডিপ্রেশনে ভুগছে যারা, এদের আত্মহত্যা করার একটা প্রবল সম্ভাবনা থাকে। তাই এমন রোগীকে বাসায় ছেড়ে না রেখে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজন হতে পারে। পরিবেশ পরিস্থিতি বেশির ভাগ সময়েই মানুষের আয়ত্বের মাঝে থাকে না। তা বদলাতে সময় লাগে। তাই প্রয়োজন প্রতিকূল পরিবেশে লড়াই করার শক্তি, সাহস আর অসহায়কে সমর্থন করার মানসিকতা। আর এক্ষেত্রে আমরা সুস্থ মানুষেরা যদি একটু সচেতন আর সহানুভূতিশীল হতে পারি তবে অনেক মানুষকে অকালমৃত্যু থেকে রক্ষা করতে পারি। এছাড়াও নিজেকে সময় দিতে হবে। নিজেকে ভালোবাসতে হবে। আবেগে বা ঝোঁকের মাথায় কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে চিন্তা করতে হবে। নিজের কথা, পরিবারের কথা, বেঁচে থাকার কথা ভাবতে হবে।
পরিশেষে এটাই বলতে চাই, এই পৃথিবীতে প্রকৃতির কি বিপুল আয়োজন! সেখানে উপভোগ করে বাঁচার রসদের স্বাদের অনুভূতিবোধটা জাগ্রত করতে হবে। আর এটাই হচ্ছে আত্মহত্যা প্রতিরোধের প্রধান উপায়।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গল্পকার