ট্রাম্প আমলে বিশ্ব রাজনীতিতে ছড়ি ঘোরানোর চে’ মার্কিন শ্রেষ্ঠত্ববাদের উত্থানে বেশি মনোযোগ দেয় ওয়াশিংটন। ভঙ্গুর অর্থনীতি সুরক্ষা দিতে সবকিছু নতুনভাবে সাজানো হয়। এতে আর যাই হোক, আফগানিস্তানে তালেবান উত্থানসহ বিশ্ব রাজনীতিতে অনেক উলটপালট ঘটে যায়। ট্রাম্পের হাত গুটিয়ে নেয়ার সুযোগটা পুরোপুরি কাজে লাগায় নতুন অর্থনৈতিক ও সামরিক পরাশক্তি চীন। চীন শুধু এশিয়া, আফ্রিকা বা লাতিন আমেরিকা নয়, খোদ ইউরোপেও তার বলয় জোরদার করে। হাঙ্গেরি, পোল্যান্ডের মত মার্কিন প্রভাব বলয়ের দেশও চীনের দিকে হাত বাড়ায়। চীনা সহায়তা, কঠিন ঋণ ও কর্পোরেট বাণিজ্য দেশে দেশে জাল ছড়ায়। তলে তলে রাশিয়াও মার্কিনী আধিপত্য খতমে চীনা প্রভাবকে পরোক্ষ সমর্থন দেয়। দক্ষিণ চীন সাগরে কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করে সামরিক স্থাপনা বানিয়ে চীন জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনামসহ পূর্ব এশীয় দেশগুলোকে কোনঠাসা করে ফেলে। তাইওয়ানকে গ্রাস করতে আগ্রাসী সমরসজ্জার কূটনীতিও চীনের নয়া কৌশল। পাকিস্তানকে পকেটে ভরে উপসাগরীয় দেশ ও মধ্য এশিয়াতেও ঝেঁকে বসে। ‘রোড অ্যান্ড বেল্ট ইনিশিয়েটিভ’ হচ্ছে, চীনের বৈশ্বিক আধিপত্যের নতুন সংস্করণ। বৈরি ভারতকে চাপে রেখে ভারত মহাসাগরে নৌ আধিপত্য দখল নিতেও মরিয়া চীন। বাইডেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে আসার পর হুঁশ ফিরে যুক্তরাষ্ট্রের। পুরনো মিত্রদের আবারো জড়ো করে চীনকে থামাতে সব কৌশল নিয়ে মাঠে নামে। বৈশ্বিক আধিপত্যের ব্যাটন হাতছাড়া করতে কোনোভাবেই রাজি না, এই পরাশক্তি। ন্যাটোসহ সবখানে শুরু হয়েছে নতুন সমরসজ্জা। ইউক্রেনে রুশ হুমকির মুখে যাচ্ছে অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ভারত মিলে গড়েছে নতুন জোট। ট্রাম্প আমলে যাত্রা হলেও জোর পাচ্ছে এখন। জাপান, অস্ট্রেলিয়া সামরিক খাতে বিপুল বাজেট বরাদ্দ দিয়েছে। সমুদ্র প্রতিরক্ষা ও দেশ সুরক্ষায় জাপান বানাচ্ছে অত্যাধুনিক সাবমেরিন। পরমাণু কর্মসূচিতেও ফিরতে পারে দেশটি।
বিশ্বব্যাপী নতুন সমরসজ্জার বাইরে নিজেদের পক্ষে মিত্র বাড়াতেও জোর দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন। এরই আলোকে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল গণতান্ত্রিক সম্মেলন। সম্মেলনে গণতন্ত্র জোরদারে তিনটি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। ক. স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিতকরণ। খ. দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোর লড়াই চালু রাখা। গ. মানবাধিকার নিশ্চিতকরণে বাধা দূর। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাইডেনের ডাকা সম্মেলনটিতে এমন অনেক দেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, যেসব দেশে গণতন্ত্রের অস্তিত্ব নেই-দুর্নীতিই নীতি-মানবাধিকার ‘ম’ও নেই। আবার সামরিক ছায়াপুষ্ট ভঙ্গুর গণতন্ত্রের দেশ পাকিস্তানকে আমন্ত্রণ জানালেও তারা চীনের চাপে অংশ নেয়নি। সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ দেয়া হয়নি। আমন্ত্রণ পায়নি শ্রীলঙ্কাও। এতে পরিষ্কার চীনের সাথে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কার কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার হওয়ায় দেশ দুটোকে চাপে রাখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। এ’নিয়ে বিরোধী দলসহ কিছু গ্রুপ সন্তোষ প্রকাশ করলেও বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। আসলে মার্কিন গণতান্ত্রিক সম্মেলনে গণতন্ত্রের ভিত্তি মজবুতে কোনো সমাধান আসেনি। কারণও নেই। মার্কিন বলয়ের অগণতান্ত্রিক শক্তিকে জামাই আদর দিয়ে গণতন্ত্রের বাচ্চার নার্সিং মানে বাচ্চাকে অপুষ্টিতে ঠেলে দিয়ে খুন করা। সম্মেলন শেষ হতে না হতে বাংলাদেশের পুলিশ প্রধানসহ কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান বাহিনী কর্মকর্তার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ওয়াশিংটন। নিষেধাজ্ঞাও একটা চাপ। কিন্তু বাংলাদেশের বৈশ্বিক অবস্থান এখন এতবেশি শক্তপোক্ত যে বাইডেন প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা খুব একটা প্রভাব ফেলার কারণ নেই। আবার বাংলাদেশ বাইডেনের দাওয়াত না পাওয়ায় রাশিয়া, চীনসহ কিছু বড় শক্তি বাংলাদেশের আরো কাছে দাঁড়িয়েছে।
শুধু তাইনা, চীন তাদের বিরুদ্ধে মার্কিন জোট গঠনের পাল্টায় দাবি করছে, চীন হচ্ছে কার্যকর গণতন্ত্রের দেশ। তারা ‘কনসাল্টেটিভ ডেমোক্রেসি বা হোল প্রসেস ডেমোক্রেসী’ চর্চা করে। রাষ্ট্রীয় নীতি ও সিদ্ধান্ত প্রণয়নে সকল পেশাজীবিসহ সর্বশ্রেণির মতামত গ্রহণ করার পর সিপিসি (চীনা কমিউনিস্ট পার্টি) তা পাশ করে। চীনের রাষ্ট্রীয় প্রচারণায় প্রথম বারের মত এই মত ব্যাপক চর্চা হচ্ছে। এটা ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধে চীনের নতুন কূটনৈতিক ফ্রন্ট। আগে কখনো চীন নিজের রাষ্ট্রীয় নীতি নিয়ে কথা বলেনি। চীনা গণতন্ত্রের মডেলের পক্ষে দেশটির সকল গণমাধ্যম তুমুল প্রচারণায় নেমেছে। এতে মার্কিন গণতান্ত্রিক সম্মেলনের প্রভাব কার্যত ফিকে হয়ে গেছে। বাস্তবতা হচ্ছে, গণতন্ত্র বহু দেশে নিজস্ব ঢংয়ে চর্চা হলেও ২০০৬ সালের পর থেকে বিশ্বব্যাপী শ্রেষ্ঠত্ববাদী শাসনব্যবস্থা জোরদার হয়েছে। গণতন্ত্রের গায়েও বিভিন্ন নামের লোগো সেঁটে দেয়া গেছে। ভারত, বৃটেন, যুক্তরাষ্ট্রকে বুনিয়াদি গণতন্ত্রের দেশ বলা হলেও সেখানেও গণতন্ত্রের ভঙ্গুরতা এখন তীব্র। মধ্যপ্রাচ্যসহ এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিনের বহুদেশে গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটাও নেই। আসলে নিজের বলয় এবং শক্তি বাড়াতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন সোভিয়েত পতনের পর নতুন সংস্করণের স্নায়ুযুদ্ধে নেমেছে। তারই আয়োজন মার্কিন তথাকথিত গণতান্ত্রিক সম্মেলন।
দু’পরাশক্তির বিপজ্জনক খেলায় বাংলাদেশ অবস্থানগত কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মার্কিন আচরণে পরিষ্কার, বাংলাদেশ শক্তি বলয়ের চাপে ভারসাম্য রক্ষায় আপাতত ঠিকঠাক এগুচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র চাপ প্রয়োগ করলেও বাংলাদেশকে এড়িয়ে চলা তার পক্ষে সম্ভব না। কারণ ভারতকে তার লাগবেই। ভারতে-বাংলাদেশ সম্পর্কে মাঝে মাঝে কিছু টানাপোড়েন থাকলেও এটা ভাঙবেনা। আবার চীন বাংলাদেশকে নিজের বলয়ে পুরোটাই চাইবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অসাধারণ কূটনৈতিক দক্ষতায় সব পক্ষের সাথে ভারসাম্যের নীতি নিয়ে এগুচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন, জাপান সব পক্ষই বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী। গোস্বা করলেও ওয়াশিংটনের পক্ষে বাংলাদেশকে দূরে ঠেলা বৈশ্বিক বাস্তবতায় অসম্ভব। বিশ্বাস, গণতন্ত্রের উঠতি দু’ওস্তাদকে শেখ হাসিনা ঠিকঠাক সামলে নিতে পারবেন।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট