১৩ জুন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ সমাজসেবক ও শিক্ষানুরাগী মরহুম এলএ চৌধুরীর ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। জনাব চৌধুরী শেরে বাংলা একে ফজলুল হক এর ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। ঐতিহাসিক ৫৪ এর যুক্তফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক ও শেরে বাংলা প্রতিষ্ঠিত কৃষক শ্রমিক পার্টির সভাপতি ছিলেন। ১৯৪৬ সালে তিনি চট্টগ্রাম থেকে আল হেলাল নামে একটি পত্রিকা সাপ্তাহিকী বের করেন। অতীতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তান উত্তর ৫২ এর ভাষা আন্দোলন। পরবর্তীতে সামরিক স্বৈরাচার বিরোধী বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সুদৃঢ় নেতৃত্ব প্রদান করেন। ১৯৫৪ সালে চট্টগ্রাম জেলা বোর্ডের সদস্য ছিলেন। তাছাড়া তিনি চট্টগ্রাম গুল-এ-জার বেগম গার্লস হাই স্কুল এর প্রতিষ্ঠা উন্নয়নের প্রধান সংস্কারক ছিলেন। এম.ই.এস স্কুল ও কলেজ, মুসলিম এডুকেশান সোসাইটি, সোসাইটি অব আর্টস এন্ড লিটারেচার, চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজ, চট্টগ্রাম সাহিত্য বক্তৃতা পরিষদ, চট্টগ্রাম বিভাগীয় শহর উন্নয়ন প্রজেক্ট এর চেয়ারম্যান, ডায়বেটিকস এসোসিয়েশন বাংলাদেশ ও যক্ষা সমিতির উপদেষ্টা ছিলেন। আলকুরআন কেন্দ্র, গহিরা হাই স্কুলও মাদ্রাসা সহ বহু শিক্ষা, সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
ষাটের দশকে এল এ চৌধুরী রচিত তাঁর ‘ষড়যন্ত্রের রাজনীতি ও জনগণ’ নামক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ৭০’ সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের প্রদত্ত ৬ দফা দাবী এক দফায় পরিণত হয় ও আওয়ামীলীগের একক নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পর বীর বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একতাবদ্ধ হয়।
৭১’ অগ্নিঝরা স্বাধীনতা আন্দোলন চলাকালীন মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে ২২ মার্চ ১৯৭১ ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের বৈঠক চলছিল। ঐ দিন চট্টগ্রামের রেলওয়ে পোলোগ্রাউন্ড ময়দানে মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এক জনসমুদ্রে ভাষণ শেষে চট্টগ্রাম সফরের এক পর্যায়ে মরহুম এলএ চৌধুরীর দেওয়ান বাজারস্থ বাসভবনে সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের সর্বদলীয় নেতৃবৃন্দ দেখা করেন ও মওলানা ভাসানীর প্রতি শ্রদ্ধা জানান এবং জনগণের একমাত্র প্রাণের দাবী বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে ঐতিহাসিক মতবিনিময় সভায় যোগদান করেন এবং একাত্মতা ঘোষণা করেন। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ঠিক এই সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাওলানা ভাসানীকে ফোন করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে অবহিত করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের প্ররোচনায় অসুস্থ ও বৃদ্ধ বয়সে এই প্রবীণ রাজনীতিবিদকে তাঁর বাস ভবন থেকে গ্রেফতার করা হয়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ মাতৃকার মহান স্বাধীনতা লাভের পর এল এ চৌধুরী কর্তৃক প্রস্তাবনায় ও পরিকল্পনায় সমাজের সর্বস্তরের রাজনৈতিক, সমাজসেবী, গবেষক ও আলেম সমাজের প্রতিনিধি নিয়ে তৎকালীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম শ্রম ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী, চট্টগ্রামের জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে “ইসলামী শিক্ষা ও সমাজকল্যাণ সম্মেলন” আয়োজনের পদক্ষেপ গ্রহণ একটি জরুরী ও উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হয়েছে। যার ফলে সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ইমাম সমাজ ও আলেম সমাজ ও অন্যান্য ধর্মের পুরোহিত তথা প্রধানদেরকে দলীয় রাজনৈতির উর্দ্ধে রেখে ধর্ম শিক্ষা প্রচলন ও দুঃস্থ মানবতার কল্যাণ সাধনের জন্যে সুপ্রসস্থ পথ তৈরীতে পৃথক সেক্রেটারিয়েট গঠন ও স্থাপনের লক্ষ্য ছিল।
১৯৮৮ সালে দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের বৃদ্ধিজীবী সাংবাদিক রাজনৈতিক সচেতন নাগরিক সমাজকে সম্পৃক্ত করে চট্টগ্রামে বৃহত্তর চট্টগ্রামের স্বার্থ সংরক্ষণ ও চট্টগ্রামের উন্নয়ন সাধনের লক্ষ্যে পরিচালিত সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ‘বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন গণ সংগ্রাম কমিটি’ গঠিত হয়। এই সংগঠনের উদ্যোগে যে কজন বরেণ্য ব্যক্তিকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, তার মধ্যে মরহুম এল এ চৌধুরীকে (লুৎফে আহমেদ চৌধুরী) শিক্ষা, সমাজ ও জাতিগঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ মরণোত্তর ‘চট্টগ্রাম পদক’ প্রদান করা হয়। এই পদক মরহুমের সন্তান মেসবাহ উদ্দীন জঙ্গী চৌধুরী উপস্থিত থেকে গ্রহণ করেন।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাধারণ সভায়- চট্টগ্রাম মহানগরী দেওয়ান বাজার দিদার মার্কেট হতে সিএন্ডবি ব্রিজ পর্যন্ত লেনকে বিশিষ্ট সমাজ সেবক ও দানবীর মরহুম ‘এল এ চৌধুরীর সড়ক’ নামে নামকরণের জন্য সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশনায় ও অনুমোদন প্রদানের মাধ্যমে চট্টগ্রামের সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ২০২০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ‘মরহুম এল এ চৌধুরী সড়ক’ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। এতে চট্টগ্রামের বিপুল সংখ্যক বিশিষ্টজনের উপস্থিতিতে সভাপতিত্ব করেন স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র চৌধুরী মাহমুদ হাছনী এবং বক্তব্য রাখেন সাবিহা মুসা এমপি, বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ ও চট্টগ্রামের ইস্পাহানী স্কুল এন্ড কলেজের প্রাক্তন প্রিন্সিপাল হাসিনা জাকারিয়া, মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল্লাহ আল রায়হান, স্থানীয় মহিলা কাউন্সিলর আঞ্জুমান আরা বেগম, মরহুমের জ্যেষ্ঠ সন্তান সালাউদ্দিন জঙ্গী চৌধুরী, মেসবাহউদ্দিন জঙ্গী চৌধুরী, শহীদ মাহমুদ জঙ্গী চৌধুরী প্রমুখ। ১৩ জুন ২০২১ বাদে মাগরিব মরহুমের মাজার সংলগ্ন চট্টগ্রামস্থ কদম মোবারক মসজিদে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকায় নয়াপল্টন জামে মসজিদ এ বাদে এশা মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।
লেখক : প্রকাশক, টইটম্বুর মাসিক শিশু কিশোর পত্রিকা