জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২২তম জন্মবার্ষিকীর নান্দনিক প্রাক্কালে তাঁর ‘সব্যসাচী’ কবিতার পংক্তি উচ্চারণে ক্ষুদ্র নিবন্ধের নান্দীপাঠ করছি। “ওরে ভয় নাই, আর দুলিয়া উঠেছে হিমালয়-চাপা প্রাচী !/ গৌরীশিখরে তুহিন ভেদিয়া জাগিছে সব্যসাচী !/ দ্বাপর যুগের মৃত্যু ঠেলিয়া/ জাগে মহাযোগী নয়ন মেলিয়া,/ মহাভারতের মহাবীর জাগে, বলে ‘আমি আসিয়াছি।’/ নব-যৌবন-জলতরঙ্গের নাচে রে প্রাচীন প্রাচী !/ বিরাট কালের অজ্ঞাতবাস ভেদিয়া পার্থ জাগে,/ গান্ডীব ধনু রাঙিয়া উঠিল লক্ষ লাক্ষারাগে!/ বাজিছে বিষাণ পাঞ্চজন্য,/ সাজে রথাশ্ব, হাঁকিছে সৈন্য,/ ঝড়ের ফুঁ দিয়া নাচে অরণ্য, রসাতলে দোলা লাগে,/ দোলায় বসিয়া হাসিছে জীবন মৃত্যুর অনুরাগে !” করোনা অতিমারির দ্বিতীয় তরঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ বিশ্বের প্রায় জাতিরাষ্ট্রে ভয়ঙ্কর ও শোচনীয় পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ভারতে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে চার হাজারের অধিক মৃত্যুর মিছিল ও অচিন্তনীয় অন্তেষ্টিক্রিয়া শুধু ভারতকে নয়, ধরিত্রীর বিশাল আকাশে ধূসর মেঘের ভেলায় ছড়িয়ে দিচ্ছে দু:সহ কাতরতা। নদী-সমুদ্রে ভাসমান গলিত লাশের দেহ করুণ দৃশ্যাদৃশ্য নির্মম বাস্তবতার বহি:প্রকাশ ঘটাচ্ছে। ইতিমধ্যে কালো-সাদা-হলুদ ফাঙ্গাস সংক্রমণে বাংলাদেশসহ বিশ্ব নাগরিক হচ্ছে প্রচন্ড ভীতসন্ত্রস্ত। কঠিন এই বিপর্যস্ত অসহায়ত্বকে পুঁজি করে বিশ্বের নানান দেশে নানা মাত্রিকতায় ‘সাম্প্রদায়িকতা ও ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’ বিশ্ববাসীকে করছে চরম ক্ষত-বিক্ষত।
দীর্ঘকাল ধরে নির্যাতিত-নিপীড়িত-নিষ্পেষিত অতীব নিরীহ ফিলিস্তিন মুসলিম জনগোষ্ঠী ইহুদী রাষ্ট্র ইসরায়েল কর্তৃক অযাচিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত আগ্রাসনের নবতর বিস্তারে সকলেই হতবাক। পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকাকে লণ্ডভণ্ড করে বিশাল ধ্বংসস্তূপে শুধু পরিণত করেনি; নারী ও শিশু হত্যা করে জঘন্যতম অমানবিক হত্যার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বিশ্ববিবেকের কাছ থেকে তেমন কোন প্রতিবাদ বা প্রতিরোধের উচ্চবাচ্য না থাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাও বরাবরই ধ্বংস-হত্যাযজ্ঞ সমর্থিত ছিল। নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতাকে নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গিতে মূল্যায়ন না করে উভয়কে শান্ত থাকার জন্য জাতিসংঘের বার্তাকে খুবই হাস্যকর ও লজ্জাজনক মনে হয়েছে। প্রাসঙ্গিকতায় মুক্তির মহানায়ক বাঙালির বঙ্গবন্ধু বিশ্ববন্ধু শেখ মুজিবের অনুপস্থিতি পৃথিবী নামক এই গ্রহের সকলেই নিগূঢ় উপলব্ধি করছে। কাজী নজরুলের ‘অসত্যের কাছে নত নাহি হবে শির, ভয়ে কাঁপে কাপুরুষ লড়ে যায় বীর’ শীর্ষক অমিয়বার্তাকে পরিপূর্ণ ধারণ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা এই অন্যায়-অন্যায্য আগ্রাসনের শুধু নিন্দা করেননি, অবিলম্বে এই অসম যুদ্ধ বন্ধে এবং অসহায় ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়ানোর উদাত্ত আহ্বান বিশ্বের সকল শোষিত-বঞ্চিত মানুষের হৃদয়ে প্রবল মনোবল ও আশার সঞ্চার করেছে। যোগ্যতম বিশ্বনেতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুসরণে জননেত্রী শেখ হাসিনার এই ভূমিকা সর্বত্রই প্রশংসিত।
প্রকৃতপক্ষে কথিত বিশ্বনেতাদের ব্যর্থ প্রয়াসে শেখ হাসিনার দৃঢ়চেতা মনোভাব নির্বাক বিশ্বকে করেছে অপরিমেয় উদ্বেলিত। বাংলাদেশ সরকার ও জনগণ বিশেষ করে বিশ্বের প্রায় বাঙালি জনগোষ্ঠীদের পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনিদের সহযোগিতায় প্রসারিত হস্তকে বাংলাদেশের বীরত্বগাথা এবং সকল ষড়যন্ত্র-কুচক্রের বিরুদ্ধে মাথা নত না করার অনবদ্য চেতনাকে আবারও অত্যুজ্জ্বল করেছে। এখানেই বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ এবং বাঙালি জাতি পরাভূত না হয়ে অপরাজিত থাকার ঋদ্ধতায় সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। বিশ্বনেতৃত্বের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনচরিত বিশ্লেষণে এটি প্রমাণিত সত্য যে, চতুর্বেদী বৈশিষ্ট্য তথা নিখাঁদ দেশপ্রেম-সত্য ও ন্যায়পরায়ণতা-সাহসিকতা ও নির্ভীকতা-বিশ্বজনীন মানবিকতাই বিশ্ববন্ধুর প্রকৃত পরিচায়ক। উল্লেখ্য নৈবেদ্য উদ্ভাবন ছাড়া নেতৃত্বের স্বকীয় সত্তার বিকাশ এবং আরাধ্য নিষ্ঠার সাথে দেশ ও বিশ্বকে সঠিক নেতৃত্বে এগিয়ে নেওয়া দুরূহ বিষয় বটে। সকল ক্ষেত্রেই শুধু বাচনিক ভঙ্গিতে নয়; বুদ্ধিমত্তার পাঠোদ্ধার থেকে শুরু করে জীবনের শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু প্রয়োগিক বিবেচনায় অন্যতম বিশ্বনেতার বিশ্বকোষ প্রণয়নে অগ্রগণ্য ছিলেন। বাঙালি জাতির জীবনে প্রতিটি ক্ষেত্রে এমন কোন বিষয় ছিল না যা বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ গোচরে আসেনি। তাতে তিনি হয়েছেন কখনো ব্যথিত, কখনো স্পন্দিত।
কবি নজরুল উচ্চারিত ‘আমি আসিয়াছি’ অদৃশ্য ঘোষণার মধ্যেই যেন বীজন মানদণ্ডে বাঙালির মুক্তিসাধনে জীবন-মৃত্যুর অনুরাগে আরদ্ধ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। নিজেকে মৃত্যুঞ্জয়ী করতে পেরেছিলেন সমধিক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সর্বোপরি জীবন বিসর্জনে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন বিশ্বে বিস্ময়কর কিংবদন্তী। তিনি শুধুই তাঁরই বিকল্প প্রতিচ্ছবি। তবুও তুলনামূলক আলোচনায় সারথি হিসেবে জ্ঞানমানস হলেন ১৪৭৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি জন্ম নেয়া আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানে বিপ্লবসূচক নিকোলাস কোপারনিকাস, ১৪৮৩ সালে ১০ নভেম্বর খৃষ্টান ধর্মে প্রোটেষ্টানিজম মতবাদের প্রবক্তা মার্টিন লুথার, ১৭৩২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট এবং আমেরিকানদের মুক্তিদাতা জর্জ ওয়াশিংটন, ১৭৭৪ সালের ১০ মে ব্রাহ্মধর্ম মতবাদ ও সতীদাহ প্রথার নিবারক ভারতের নবযুগের প্রবর্তক রাজা রামমোহন রায়, ১৮২০ সালের ১২ মে আর্তমানবতা সেবাধর্মের মাতৃস্বরূপা ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল, ১৮৩৩ সালের ২১ অক্টোবর নোবেল পুরস্কার প্রণেতা আলফ্রেড নোবেল।
আবৃত আচ্ছাদনে ১৮৬১ সালের ৭ মে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৮৭২ সালের ১১ মে মানবতার সীমাহীন মর্মবেদনা ও জ্ঞানের অপরিসীম অনুসন্ধানী বারট্রান্ড রাসেল, ১৮৬৯ সালের ২ অক্টোবর ভারতের জাতির পিতা মহাত্না গান্ধী, ১৮৭৯ সালের ১৪ মার্চ মহাজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন, ১৮৮৯ সালের ১৪ নভেম্বর ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা জওহরলাল নেহেরু, ১৮৯৯ সালের ২৪ মে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামসহ প্রমুখ এই ধরিত্রী সভায় প্রতিপদস্বরূপ আবির্ভূত হয়েছিলেন বলেই সমগ্র বিশ্ব হয়েছে পরিকাম্যসমৃদ্ধ। সমরূপ বপ্র আবরণে স্বাধীনতা-মুক্তিকামী মানুষের কাছে বিশ্বপরিমণ্ডলে সর্বোচ্চ সমাদৃত পরিকর্ষ নেতৃত্বের কালোত্তীর্ণ অধ্যায় ছিল বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা মহাকালের মহানায়ক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিদ্যুদর্ষী জন্ম।
কবিগুরু রবীঠাকুরের ‘আমি’ শিরোনামে কবিতার প্রথম কয়েকটি পংক্তি যেন বঙ্গবন্ধুর জন্মকেই উৎসর্গ করা। ‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হ’লো সবুজ, চুনি উঠল রাঙা হ’য়ে।/আমি চোখ মেললুম আকাশে – জ’লে উঠল আলো পুবে পশ্চিমে।/গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম, “সুন্দর”- সুন্দর হ’লো সে।/তুমি বলবে, এ যে তত্ত্বকথা, এ কবির বাণী নয়।/আমি বলব এ সত্য, তাই এই কাব্য।/এ আমার অহংকার, অহংকার সমস্ত মানুষের হ’য়ে। /মানুষের অহংকার-পটেই বিশ্বকর্মার বিশ্বশিল্প।’ বস্তুতপক্ষে দীর্ঘ তিন হাজার বছর প্রাচীন বাংলা নামক জনপদে সমাজ-ইতিহাস ভিনদেশী শাসক-শোষকদের নিপীড়ন-নির্যাতন-যন্ত্রণা-বঞ্চনা-বৈষম্যের এতাদৃশী। তেজস্বী এই বাংলার প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র নায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের গুণকীর্তন, ত্যাগ মহিমার একনিষ্ট ঘনিমার গতিময়তা অতিশয় দিব্যোদক। শৈশবকাল থেকেই ভয়কে জয় করে বঙ্গবন্ধু স্বমহিমায় নির্মাণ করেছিলেন অবিস্মরণীয় জীবনমানস।
১৯৫৫ সালের ৫ জুন গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে ১৭ জুন ঢাকার পল্টন ময়দানে পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়িত্তশাসন প্রতিষ্ঠার ২১ দফা দাবির অন্যতম নায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ২৫ আগস্ট পাকিস্তান গণপরিষদে বঙ্গবন্ধু বলেন ‘বাঙালিরা পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে পূর্ব বাংলা নামটিকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য মনে করে। কারণ ‘বাংলা’ শব্দটির একটি নিজস্ব ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে। ২১ অক্টোবর আওয়ামী মুসলিম লীগের পরিবর্তে দলের নামাকরণ করা হয় শুধু আওয়ামী লীগ। ১৯৬৬ সালে ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি পেশের মাধ্যমে বাঙালি জাতির যুগান্তকারী মুক্তি সনদ রচনা করেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৬৮ সালে ৩ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আনীত রাষ্ট্রদ্রোহী আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাংলার জনগণের অব্যাহত আন্দোলনে ২২ ফেব্রুয়ারি প্রত্যাহার করতে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী বাধ্য হয়। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুর এই মুক্তিতে আবেগ-আনন্দে প্রাণিত প্রায় ১০ লাখ ছাত্র-জনতার সমাবেশ থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। সেদিন থেকে আর বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্য কোথাও বাঙালিরা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’ ছাড়া অন্য কোন নামে তেমন সম্বোধন করার প্রয়োজন মনে করেননি। তিনি রাজনীতির আকাশে অবিশ্বাস্য আকাশচুম্বী মানদণ্ডে অবিসংবাদিত নেতা ও বাঙালির বঙ্গবন্ধু হিসেবে খ্যাতিমান হলেন।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন-সার্বভৌম প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি সমগ্র বিশ্বনেতৃত্বের প্রবল মুখে পাকিস্তানী জান্তা কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর মুক্তি নিশ্চিত হলে ১০ জানুয়ারি তাঁর সর্বোচ্চ ত্যাগের উপমায় এবং ৩০ লক্ষ প্রাণবিসর্জনের বিনিময়ে অর্জিত মুক্ত-স্বাধীন ভূমি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় পৌঁছেই সরাসরি রেসকোর্স ময়দানে গিয়ে ইতিহাসের অধ্যায়ে অবিনস্বর এক সংবর্ধনা সভায় যোগদান এবং জাতির উদ্দেশ্যে অসাধারণ ভাষণ প্রদান করেন। রবীঠাকুরের কবিতা উচ্চারণ করে বললেন ‘বাঙালি আজ পরিপূর্ণ মানুষের মর্যাদায় সমাসীন হয়েছে’। ১২ জানুয়ারি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে বিপর্যস্ত এবং সার্বিক দিক থেকে বিধ্বস্ত প্রাণপ্রিয় দেশকে নতুন করে গড়ে তোলার বিচক্ষণ ও দু:সাহসিক প্রত্যয়ে নতুন সংগ্রামে নিজেকে সমর্পণ করেন। মাত্র নয় মাসের মধ্যে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধানে স্বাক্ষর করেন ১৪ ডিসেম্বর যা ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়। প্রায় সকল ক্ষেত্রে স্বল্প সময়ের মধ্যে অভূতপূর্ব সংস্কার সাধনের মাধ্যমে দেশকে একটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন অবস্থানে সুদৃঢ় করতে সমর্থ হন। একটি আত্মনির্ভরশীল জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং জাতিকে অর্থবহ স্বাধীনতা উপহারের লক্ষ্যে সাধারণ মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান নিশ্চিতকল্পে দুর্নীতি দমন; কৃষি ও শিল্পে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিকরণ; দেশের মৌলিক সমস্যাসমূহের অন্যতম জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ এবং জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে দেশকে সুমহান মর্যদায় আসীন করার লক্ষ্যে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
বঙ্গবন্ধুর সফল রাষ্ট্র প্রশাসনের সুফল ধীরে ধীরে যখন দৃশ্যমান হতে চলেছে, তখনই ১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর বিশ্বশান্তি পরিষদের সম্মেলনে আন্তর্জাতিক বিশ্বনেতার স্বীকৃতিস্বরূপ ‘জুলিওকুরি শান্তি পদকে’ ঘোষিত হন। চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে প্রাপ্ত এই বিরল সম্মান বঙ্গবন্ধুর আগে অর্জন করেছিলেন কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রো, চিলির সার্ভে আলেন্দে, ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাত, ভিয়েতনামের হো চি মিন, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসেন ম্যান্ডেলা, ভারতের মুলকরাজ আনন্দ ও শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। বাংলাদেশে বিশ্বশান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে শান্তিপদক প্রদানের জন্য ১৯৭৩ সালের ২৩ মে ঢাকায় আয়োজন করে আন্তর্জাতিক সম্মেলন। সেদিন উদ্বোধনী ভাষণে বিশ্বশান্তি পরিষদের সম্মানিত মহাসচিব শ্রী রমেশচন্দ্র আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে বিশ্বশান্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নির্ভীক কাণ্ডারী এবং বিশ্বের সকল শোষণ-বঞ্চনায় বিপন্ন জনগণের অধিকার আদায়ে তৎকালীন সময়ের জীবন্তকিংবদন্তী আজীবন সংগ্রামী বিশ্বনেতা বঙ্গবন্ধুকে ‘বিশ্ববন্ধু’ হিসেবে অভিষিক্ত করেন। সেদিন থেকেই বাঙালির বঙ্গবন্ধু বিশ্বপরিমণ্ডলে ‘বিশ্ববন্ধু শেখ মুজিব’ অভিধায় নন্দিত রাষ্ট্রনায়কের বিশ্ব শিরোপা অর্জন করলেন।
জনশ্রুতিমতে বাংলাদেশের সমসাময়িক আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পর্যালোচনায় নিঃসন্দেহে বলা যায়; দেশ ও জাতি দেশীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের গভীর কূটকৌশল সৃষ্ট সংকটকাল অতিক্রম করছে। চরম অনৈতিক ও সুবিধাভোগী নষ্ট চরিত্রের কতিপয় রাজনীতিক ও স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবী নামক জ্ঞান-পাপীদের বিকারগ্রস্ত মানসিকতা থেকে উদ্ভূদ ধ্যান-ধারণা বাংলাদেশের বর্তমান স্থিতিশীল অবস্থানকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে দুষ্ট চক্রান্তে ভীষণভাবে প্ররোচিত। কোমলমতি শিশু-কিশোর এবং দেশমাতৃকার আগামীদিনের পথ নির্ধারক ও প্রদর্শক তরুণ প্রজন্মকে নানাভাবে বিভ্রান্ত করে অসৎ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। প্রাণপ্রিয় শিক্ষার্থীদের সাবলীল জীবনধারাকে কুলুষিত করার জন্য জঙ্গি-সন্ত্রাসী ও মাদকসেবী অছাত্রদের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে কুৎসিত পন্থায় তাদের ধাবিত করার কুচক্রান্তে অতিশয় সক্রিয়। কিছু সংখ্যক বর্ণচোরা অর্ধশিক্ষিত ছাত্র-যুব-রাজনীতিক নামধারী শুধুমাত্র বাহিনী প্রধান হয়ে অপশক্তির দোসরদের কাজে লাগিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ ও আর্থিক লোভলালসা চরিতার্থ করার কাজে ব্যতিব্যস্ত। সময়ের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় দাবী হচ্ছে; বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে যথার্থ অর্থে ধারণ করে মানবিকতা ও মনুষ্যত্বের চেতনায় দেশপ্রেমিক নেতৃত্বের বিকাশ ও প্রসারের উজ্জীবন। কঠিন সত্য হচ্ছে এই, পুস্তক ও কলমের বিপরীতে কোন ধরনের সহিংস হাতিয়ার কোনভাবেই দেশের সার্বিক কল্যাণে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথকে আলোকিত করতে পারবে না। সত্য-সুন্দর-কল্যাণ-আনন্দের অনুষঙ্গগুলো নিত্যদিনের পাথেয় হিসেবে অনুসরণ করে করোনা অতিমারিসহ সকল দুর্যোগ অতিক্রান্তে দেশবাসীকে আস্থা ও বিশ্বাসে অবিচল থেকে উন্নয়ন অভিযাত্রাকে সফল ও দৃশ্যমান করতেই হবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজবিজ্ঞানী
সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়