প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ২০ জানুয়ারি, ২০২১ at ১০:৫৫ পূর্বাহ্ণ

আল্লাহ পাকের বিস্ময়কর সৃষ্টি – উট
মহান আল্লাহ পাকের সৃষ্ট হালাল পশুর মধ্যে উট অন্যতম। উট অন্য সব পশু থেকে ব্যতিক্রম। ইহার দুধ, গোশত যেমনি হালাল তেমনি সেকালে মানুষের বহন হিসেবে অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
উটের জীবন প্রবাহ সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। যা মহান আল্লাহ পাকের এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। উটকে মরুভূমির জাহাজ বলা হয়। আরবীয়গণ ধূ-ধূ মরুভূমির মধ্যে উটের মাধ্যমে শত শত কিলোমিটার যেতে পারতেন। এতে উটের রয়েছে ব্যতিক্রমধর্মী শক্তি।
এক বর্ণনায় উট উত্তর আমেরিকায় আবির্ভূত হয় বলে জানা যায়। দক্ষিণ আমেরিকা থেকেও উটের উৎপত্তি বলে উল্লেখ দেখা যায়। প্রণালী পার হয়ে উত্তর আফ্রিকা ও এশিয়ায় চলে আসে। এ বক্তব্যের সাথে আমি একমত হতে পারছি না। আমি মনে করি উট জজিরাতুল আরব তথা আরব উপদ্বীপে সে প্রাচীনকাল থেকেই রয়েছে। মরুভূমিতে যুগ যুগ ধরে মানুষের কল্যাণে ব্যবহৃত হতে হতে উটের অপর নাম মরুভূমির জাহাজ হয়ে যায়।
উটের পায়ে গরুর মত চেরা খুর। তবে উটের পায়ের তলায় নরম প্যাড রয়েছে যা গরুর নাই। অন্য বর্ণনায় উটের পাকস্থলী তিন প্রকোষ্ট বিশিষ্ট। অন্যান্য প্রাণীর পাকস্থলী চার প্রকোষ্টের। মৌলিকভাবে উটকে দুইভাগে ভাগ করা যায়। এক কুঁজ ও দুই কুঁজ বিশিষ্ট। কিন্তু জজিরাতুল আরব বা আরব উপদ্বীপে প্রায় এক কুঁজওয়ালা উট দৃষ্টিগোচর হবে। আফগানিস্তানসহ ঐ অঞ্চলে কোন কোন এরিয়ায় দুই কুঁজওয়ালা উট দেখা যায় তবে তা সংখ্যায় নগণ্য। কুঁজগুলো চর্বিতে ভরে গিয়ে ঠান ঠান অবস্থায় থাকে। কুঁজের উচ্চতা ৩০-৩৬ ইঞ্চি পর্যন্ত হতে পারে। এটা তার খাদ্য ভান্ডার, যার বদৌলতে এক মাস বা তারও অধিক পানি ছাড়া চলতে পারে। এ অবস্থায় তার শরীরের ৩৩ শতাংশ পর্যন্ত ওজন কমতে পারে। অথচ এ রকম পরিস্থিতিতে ৮ শতাংশ ওজন কমলে মানুষের মৃত্যু হতে পারে। তাঁর গাট লম্বা ও বাঁকা যে গাছের নাগাল পেতে পারে। যখন উট অভুক্ত অবস্থায় অনেক দিন থাকে তখন এ চর্বি অনেকটা শক্তি উৎপাদনে ক্ষয় হয়ে যায়। এতে এর কুঁজ তুলতলে অবস্থায় পরিণত হয়। সেকালে ত বটেই আজও মরভূমিতে গরু ছাগলের চেয়ে উট পালন আকষর্ণীয়, যেহেতু উট পালন সহজতর। আরব দেশে ঘোড়ার মত উটের দৌড়ের আয়োজন করে উপভোগ করা হয়। উটের চোখের ভ্রু খুব ঘন। দুই স্তরে লম্বা আইরেশ আছে। যা চোখকে মরুভূমির বালু থেকে রক্ষা করে।
নাকের ছিদ্র মাংসল। সম্ভবত বিশ্বে একমাত্র প্রাণী যা ইচ্ছামত খুলতে ও বন্ধ করতে পারে। এতে মরু ঝড়ে ধূলাবালি প্রতিরোধ করে। চর্ম বেশ পুরু। এতে মরুভূমির প্রচন্ড তাপ থেকে শরীরকে রক্ষা দেয়। উটের চামড়ার নিচে চর্বি থাকে না। যা ঘাম নিঃসরণে ও শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
উটের পা খুবই শক্তিশালী। যার ফলে সে দিনে ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত হাঁটতে পারে। ঘণ্টায় ৪০/৫০ কি.মি দৌড়াতে পারে।
কিডনি খুব শক্তিশালী। প্রশ্রাবে পানি খুব কম বের হয় এবং তা ঘন সিরাপের মত। মল এত শুকনা যে, তা দিয়ে আগুন জ্বালানো যায়। স্তন্যপায়ীর লোহিত কণিকা গোলাকার। শুধু উটের লোহিত কণিকা ডিম্বাকৃতির। যা পানি শূন্য অবস্থায় রক্ত চলাচলে সহায়তা করে। এর আবরনীও বেশ মজবুত, যা অল্প সময়ে অধিক পানি পান করার ক্ষমতা রাখে এবং আবরণী ফেটে যায় না। বাহিরের তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে উটের শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়।
উটের দুধ অত্যধিক পুষ্টিকর। এতে পটাশিয়াম, আয়রন, গরুর দুধের চেয়ে তিনগুণ পুষ্টি সমৃদ্ধ। উটের দুধ মানুষের ভিটামিন চাহিদা পূরণ করে। উট শাবক যথেষ্ট পরিমাণ দুধ পান করার পরেও উটনী ৪ থেকে ১০ লিটার দুধ বেশি দেয়। উটের দুধ অত্যধিক দাম, যা ভাবিয়ে তুলে। পবিত্র মক্কায় বিন দাউদসহ বড় বড় সুপার মার্কেটে মাত্র ২৫০ কিলোগ্রাম এক বোতল উটের দুধের দাম ১০০ রিয়ালের উপরে তথা ১ লিটার দুধের দাম আমাদের দেশীয় মূল্য প্রায় ৮/১০ হাজার টাকা।
অপরদিকে, গরু, ছাগলের তুলনায় উটের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রবল। সহজে রোগ ব্যাধি হয় না। উট ভোরে মরুভূমির বালি গরম হওয়ার আগে মাটিতে বসে। বসার সময় পাগুলো তার শরীরে বসিয়ে দেয় যেন মাটি তার শরীরে না লাগে। উটের গড় বয়স ৪০ বলে জানা যায়।
ব্যবসায়ী হিসেবে বিশ্বে আরবীয়গণের অত্যধিক সুনাম। এতে স্থলপথে মালামাল নিয়ে দূরযাত্রায় ব্যবসায়ীগণের প্রধান মাধ্যম উট। ধূ-ধূ মরুভূমিতে যাত্রাকালে উট ৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। এতে উট ঘামাক্ত হবে না। উটের খাদ্যাভাস অন্য যে কোন প্রাণী থেকে ভিন্ন। উট যে কোন কাঁটাযুক্ত খাদ্য তথা গাছ পালা চিবিয়ে খেতে পারে যা অন্য কোন প্রাণীর ক্ষেত্রে সহজতর নয়। অর্থাৎ উটের এমন জিব আছে যা কাঁটা ছেদ করতে পারে না। এর হজম শক্তিও অসাধারণ। নিমিষেই হজম করে ফেলতে পারে। আরও অবাক করা ব্যাপার, একটি উট ইচ্ছা করলে প্রতি মিনিটে ১০/১৫ লিটার পানি পান করে ফেলতে পারে। হঠাৎ অতিরিক্ত পানি পান করার ফলে শরীরে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয় না। তেমনিভাবে দীর্ঘদিন প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও পানি শূন্যতা সহ্য করতে পারে। মরুভূমিতে যেখানে সেখানে পানি পাওয়া দুষ্কর। ফলে উটই বাহনে একমাত্র সহায়ক। অর্থাৎ উট নিজের শরীরের ভিতর পানি ধরে রাখার ক্ষমতাবান।
মরভূমির কঠিন পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য মহান আল্লাহ পাক উটকে বিশেষভাবে সৃষ্টি করেছেন। উটের ভিতর যদি উপরোক্ত বিষয়গুলো এক সাথে না থাকত তা হলে উটের পক্ষে এ প্রখর রৌদ্রে বেঁচে থাকা, দূরযাত্রায় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়া অসম্ভব হত।
উট সম্পর্কে পবিত্র কুরআন মজিদে মহান আল্লাহ পাক বলেন, তারা কি উটের প্রতি লক্ষ্য করে না যে, তা কিভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে? (সূরা আল গাসিয়াহ, আয়াত -১৭)
এক অভিধানে উট ও উষ্ট্রকে একই পশু ভিন্ন প্রকার উল্লেখ দেখা যায়।
বস্তুত এ উট আমাদের নবী পাক (স.)’র প্রধান বাহন। সে সময়ও জজিরাতুল আরবে খচ্ছর ও ঘোড়া ছিল। কিন্তু নবী পাক (স.) উটই ব্যবহার করেছিলেন। যেমন-ছোটকালে চাচা আবু তালেবের সাথে সিরিয়া গমন করেছিলেন উটে করে (সিরিয়া বলতে মূলকে শাম, এর কেন্দ্রস্থল ছিল জেরুজালেম)। যৌবনকালে হযরত খাদিজাতুল কোবরার (পরবর্তীতে উম্মে খাতুন মুমেনীন) প্রতিনিধি হয়ে দু’বার সিরিয়া গমন করেন ব্যবসার উদ্দেশ্যে। বাহন হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন এ উট। শুধু তাই নয়, মক্কা মোকাররমা থেকে মদিনা মুনাওয়ারা লোমহর্ষক হিযরত করেন উট ব্যবহার করে। কুবা পল্লীতে যাত্রা বিরতি দেন ক’দিনের জন্য। সাহাবাগণের সহযোগিতা নিয়ে নিজে শ্রম দিয়ে মসজিদে কুবা নির্মাণ করেন। ইহা মুক্ত ইসলামের প্রথম মসজিদ। অতঃপর ক্বাচওয়া নামক প্রিয় উট নিয়ে মদিনা শরীফের দিকে যাত্রা করেন। অসংখ্য আনসার সাহাবার আতিথেয়তা গ্রহণের আবদারের স্থলে কোথায় গিয়ে থামবেন অবস্থান নিবেন তা এ উটের উপর ছেড়ে দেন। ফলে এ উটই গিয়ে বর্তমান মসজিদে নববীর নিকটে বসে পড়ে। পার্শ্বস্থ হযরত আবু আইয়ুব (র.)’র বাড়ীতে অবস্থান নেন, নিকটে মসজিদে নববীর নির্মাণ করেন। মদিনা মুনাওয়ারা থেকে ওমরাহর উদ্দেশ্যে পবিত্র মক্কা মোকাররমার দিকে আসেন এ উট দ্বারা। পবিত্র মদিনা থেকে পবিত্র মক্কা বিজয়ের উদ্দেশ্যে আসেন উট ব্যবহার করে। সর্বশেষ বিদায় হজ্বের জন্য পবিত্র মক্কায় আসেন উটকে ব্যবহার করে। মিনায় ১০০ টি উট হজ্বে কোরবানী করা হয়। অর্থাৎ ইসলামের বিজয়ে উটের অবদান অতুলনীয়। উট প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক আরও বলেন, আমি তোমাদের জন্য (কোরবানীর) উটগুলোকে আল্লাহ তাআলার (নির্ধারিত) নিদর্শনসমূহের মধ্যে (শামিল) করেছি, এতে তোমাদের জন্যে মঙ্গল নিহিত রয়েছে, অতএব সারিবদ্ধভাবে বাঁধা অবস্থায় (যবাই করার সময়) তাদের ওপর আল্লাহ তাআলার নাম নাও, অতঃপর (যবাই শেষে) তা যখন একদিকে পড়ে যায় তখন তোমরা তার (গোশত) থেকে নিজেরা খাও, যারা এমনিই (আল্লাহর রিযিকে) সন্তুষ্ট আছে তাদের এবং যারা (তোমার কাছে) সাহায্য প্রার্থী হয়, এদের সবাইকে খাওয়াও; এভাবেই আমি এ (জন্তু)দের তোমাদের অধীন করে দিয়েছি, যাতে তোমরা (আল্লাহ তাআলার) শোকর আদায় করতে পার। (সূরা হজ্ব, আয়াত-৩৬)। উটকে স্বাভাবিকভাবে জবাই করা হয় না। জবাইয়ের সময় উটের সামনের বাম পা বেঁধে জবাই করা হয়। উটের জবাই (নহর) হবে গলার নিচের দিকে। উট গরুর মত কোরবানীতে ৭ বরাত দেয়া যাবে। অতএব মহান আল্লাহ পাকের বিস্ময়কর সৃষ্টি উট আমাদের কাছে সর্বোচ্চ মূল্যায়নে থাকার কথা। তথ্য সূত্র: পবিত্র কোরআন; মধ্য প্রাচ্য অতীত ও বর্তমান; মধ্য প্রাচ্যের ইতিহাস; ইসলামী বিশ্বকোষ; ইন্টারনেট, সীরত বিশ্বকোষ; আরব জাতির ইতিহাস।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধকুলসুম আবার স্কুলে যাবে