২০২২ সালের জনশুমারি এবং বাংলাদেশের জনসংখ্যা

ড. নারায়ন বৈদ্য | শনিবার , ১৩ আগস্ট, ২০২২ at ৮:১৩ পূর্বাহ্ণ

জনসংখ্যা অর্থনীতিতে কোন দেশের জনসংখ্যা গণনাকে বলা হতো আদমশুমারি। স্বাধীনতার পর চারটি আদমশুমারি শেষ করে ২০১১ সালে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় জনশুমারি। একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের সকল মানুষকে বিভিন্ন দিক বা শ্রেণিতে ভাগ করে যখন গণণা করা হয় এবং সামগ্রিক চিত্র যখন পাওয়া যায় তখন তাকে জনশুমারি বলে। বাংলাদেশে জনসংখ্যা সম্পর্কিত সামগ্রিক চিত্র পাওয়ার জন্য ২০২২ সালের জুন মাসে বাংলাদেশে ষষ্ঠ জনশুমারি করা হয়। এ শুমারির ফলাফলে দেখা যায়, সাধারণভাবে জনসংখ্যা সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণাগুলো ভুল ছিল। সাধারণত বলা হয়ে থাকে যে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা বর্তমানে বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ২০ কোটি হয়েছে। এ ধারণা ছিল ভুল। ২০২২ সালের জুন মাসে পরিচালিত জনশুমারিতে দেখা যায়, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬। তৎমধ্যে পুরুষ হচ্ছে ৮ কোটি ১৭ লাখ ১২ হাজার ৮২৪ জন। আর নারী হচ্ছে ৮ কোটি ৩৩ লাখ ৪৭ হাজার ২০৬ জন। অর্থাৎ ২০২২ সালের জনশুমারি অনুসারে পুরুষের তুলনায় নারী ১৬ লাখ ৩৪ হাজার ৩৮২ জন বেশি। মোট জনসংখ্যার অংশ হিসেবে তৃতীয় লিঙ্গের লোক হয় ১২ হাজার ৬ শত ২৯ জন।
২০১১ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম জনশুমারিতে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ছিল ১৪ কোটি ৪০ লাখ। আর ২০২২ সালের জনশুমারিতে মোট জনসংখ্যা হয় ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন। অর্থাৎ গত এক দশকে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বেড়েছে ২ কোটি ১১ লাখ ১৪ হাজার ৯২০ জন। এবারই প্রথম দেশে নারীর সংখ্যা পুরুষের চেয়ে বেশি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্টাটিসটিক্স (বিবিএস) দ্বারা পরিচালিত প্রথম ডিজিটাল জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ এর প্রাথমিক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া যায়। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত জনসংখ্যা গণনার জন্য ছয়টি শুমারি হয়েছে। এ ছয়টি জনশুমারি বিশ্লেষণ করলে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির ধারাবাহিক প্রবণতা সম্পর্কে ষ্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম শুমারিতে দেশের মোট জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ১৫ লাখ। যদিও লোকেমুখে প্রচলিত ছিল, সেই সময়ে এ দেশের জনসংখ্যার পরিমাণ ছিল সাড়ে সাত কোটি। এরপর ১৯৮১ সালে বাংলাদেশে দ্বিতীয় আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয়। এ শুমারি অনুসারে তখন বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল ৮ কোটি ৭১ লাখ ১৯ হাজার ৯৬৫ জন। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে তৃতীয় আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয়। এ শুমারি অনুসারে এদেশের মোট জনসংখ্যা পাওয়া যায় ১০ কোটি ৬৩ লাখ। ২০০১ সালে চতুর্থ আদমশুমারি ও গৃহগণনা অনুষ্ঠিত হয়। এ শুমারি অনুসারে বাংলাদেশের জনসংখ্যা দাঁড়ায় ১২ কোটি ২৪ লাখ। ২০১১ সালে পঞ্চম জনশুমারি করা হয়। উক্ত জনশুমারি অনুসারে বাংলাদেশের লোকসংখ্যা দাঁড়ায় ১৪ কোটি ৪০ লাখ। আর ২০২২ সালে ষষ্ঠ ডিজিটাল জনশুমারি ও গৃহগণনায় বাংলাদেশের জনসংখ্যা দাঁড়ায় ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জনে। অর্থাৎ বিগত এক দশকে (২০১১-২০২২) বাংলাদেশের জনসংখ্যা বেড়েছে ২ কোটি ১১ লাখ ১৪ হাজার ৯২০ জন।
বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে সাধারণত ঘনবসতি দেখা যায়। সর্বাধিক ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা হয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। এ এলাকায় প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৩৯ হাজার ৩৫৩ জন লোক বাস করে। আর পৌর কর্পোরেশনগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা হয় রংপুর সিটি কর্পোরেশন। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৩ হাজার ৪৪৪ জন লোক বসবাস করে। আর বিভাগওয়ারী বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা রয়েছে। এ বিভাগে বাস করে ৪ কোটি ৪২ লাখ ১৫ হাজার ১০৭ জন। আর সবচেয়ে কম বাস করে বরিশাল বিভাগে। এ বিভাগে ৯১ লাখ ১০২ জন বাস করে।
বিবিএস এর প্রতিবেদন অনুসারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায় নারী ও পুরুষের অনুপাত বিশ্লেষণে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, দেশে প্রতি ১০০ জন নারীর বিপরীতে পুরুষ হচ্ছে ৯৮ জন, প্রায় এক দশকে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস পেয়েছে। ২০১১ সালে জনশুমারি অনুসারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১.৪৬ শতাংশ। আর ২০২২ সালে এ জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস পেয়ে তা দাঁড়িয়েছে ১.২২ শতাংশ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি ছিল ঢাকা বিভাগে। এ হার ছিল ১.৭৪ শতাংশ। বরিশালে ছিল জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সবচেয়ে কম। এখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ০.৭৯ শতাংশ। বাংলাদেশের সামগ্রিক বিবেচনায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমলেও পূর্বের তুলনায় জনসংখ্যার ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১১ সালে যেখানে বাংলাদেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব ছিল প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৯৭৬ জন সেখানে ২০২২ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ১১৯ জন। সবচেয়ে বেশি ঘনত্ব হয় ঢাকা বিভাগে। এখানে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৬৮৮ জন লোক বসবাস করে।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিভাজন করলে দেখা যায়, দেশের মোট জনসংখ্যার ৯১.০৪ শতাংশ হয় মুসলিম। ৭.৯৫ শতাংশ হিন্দু। ০.৬১ শতাংশ বৌদ্ধ। ০.৩০ শতাংশ হয় খ্রিস্টান এবং ০.১২ শতাংশ হয় অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। বর্তমানে দেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশ।
বাংলাদেশে মোট স্বাক্ষরতার হার হয় ৭৪.৬৬ শতাংশ। তবে ঢাকায় স্বাক্ষরতার হার বেশি। এ হার হয় ৭৮.৭৯ শতাংশ। সর্বনিম্ন হয় ময়মনসিংহ বিভাগে। এ বিভাগে স্বাক্ষরতার হার হয় ৬৭.০৯ শতাংশ। মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। পাঁচ বছর থেকে ১৭ বছর বয়সীদের মধ্যে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী হয় ৫৫.৮৯ শতাংশ। আর ১৮ বছর থেকে তৎঊর্ধ্বে বয়সীদের মধ্যে এ হার হয় ৭২.৩১ শতাংশ। বিবিএস এর তথ্যে বলা হয় যে, দেশের শতভাগ মানুষ বিশুদ্ধ পানি পান করে। এর মধ্যে গভীর/অগভীর টিউবওয়েলের পানি পান করে ৮৫ শতাংশ। সাপ্লাই পানি পান করে ১১.৭৪ শতাংশ। বোতলজাত পানি পান করে শূন্য দশমিক ৫৯ শতাংশ, কূপের পানি পান করে শূন্য দশমিক ৩৫ শতাংশ।
পারিবারিক শান্তি প্রকাশ পায় সুশৃঙ্খল পারিবারিক জীবন ব্যবস্থা দ্বারা। এদিক থেকে বরিশাল বিভাগকে সুখী বিভাগ বলা যায়। এ বিভাগে সংসারী মানুষের সংখ্যা বেশি। তাছাড়া তালাক ও বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা তুলনামূলক কম। অপরদিকে সবচেয়ে অসুখী বিভাগ বলা যায় খুলনাকে। এ বিভাগে বিবাহবিচ্ছেদের পরিমাণ অধিক। এ বিভাগে বিবাহবিচ্ছেদের পরিমাণ হয় শূন্য দশমিক ৪৬ শতাংশ।
বাংলাদেশের জনমিতিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ দেশে মোট জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও জন্মহার ক্রমাগত হ্রাস পেয়েছে। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের জন্মহার ছিল ২ দশমিক ১৭ শতাংশ। আর ২০২২ সালে তা হয়েছে ১ দশমিক ২২ শতাংশ। এ প্রবণতাকে উন্নয়নের সোপান বলা যায়।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক
বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ

পূর্ববর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে
পরবর্তী নিবন্ধশ্রমিকদের দাবি আদায়ে সরব ছিলেন সিরাজ মিয়া