হল্যান্ড থেকে

শারদীয় দুর্গোৎসব বুঝি আর ‘সার্বজনীন’ রইলো না : এ লজ্জা রাখি কোথায়?

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ২৩ অক্টোবর, ২০২১ at ৮:৫২ পূর্বাহ্ণ

সার্বজনীন শারদীয় দুর্গোৎসবের বোধকরি আর ‘সার্বজনীন’ থাকা হলো না। কথাটাকে এভাবেও বলা যেতে পারে, থাকতে দেয়া হলোনা। পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট অনুয়ারি এবারের দুর্গাপূজা উৎসবকে ঘিরে দেশে অন্তত ১০টি জেলায় ২২টি মন্দিরে হামলা, প্রতিমা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। তবে এতে অবাক হইনি মোটেও। বরঞ্চ এমনতর ঘটনা না ঘটলে অবাক হতাম, এই ভেবে এ কী করে সম্ভব। হিন্দু মন্দিরে, বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর, হিন্দু পুরোহিত, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আক্রমন হয়রানি- এই সমস্ত ঘটনা তো নতুন কিছু নয়। সে বিএনপি-জামাত আমলে যেমন ঘটেছে, তেমনি সেক্যুলার সরকার হিসাবে পরিচিত বর্তমান আওয়ামী লীগ আমলেও ঘটছে। রামু, নাসিরনগর, শাল্লা, সাঁথিয়া, গোবিন্দগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিগত দিনে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হয়েছে। অপরাধী ও অভিযুক্তরা বহাল তবিয়তে আছে, প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যে কটি মামলা হয়েছে তার কোন বিচার হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। আইন নিয়ন্ত্রণে যারা আছেন, ক্ষমতায় যারা অধিষ্ঠিত আছেন তারা বলছেন, হেন্‌ করেংগা, তেন করেংগা, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। ফলে অপরাধীদের সাহস বেড়ে চলেছে এবং এই ধরনের ঘৃণ্য সহিংস ঘটনা ঘটে চলেছে। এবং এর বিচার ও প্রতিকার না হলে এমন ঘটনা আগামীতেও যে ঘটবে তা বলা বাহুল্য। মজার ব্যাপার হলো, আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, এই সব সমস্ত ঘটনার পেছনে বিএনপি-জামাতের হাত। অন্যদিকে বিএনপি নেতারা বলছেন, এই সমস্ত অপকর্ম ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক চাল। জনগণের দৃষ্টি ভিন্নখাতে নেবার জন্যে এই ষড়যন্ত্র। দু-পক্ষ বাকযুদ্ধে লিপ্ত, মাঝখানে নিরীহ ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ভুগছে। গোটা পরিবেশ যে আশংকাজনক হারে ভয়ংকর হচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখেন।
অথচ এক সময় অর্থাৎ আমার স্কুল বয়সেও দেখেছি দুর্গাপূজাকে দেখা হতো সার্বজনীন উৎসব হিসাবে। ধর্মীয় দিকটা ছাড়াও এর ছিল একটি উৎসবের দিক। তাতে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল বিশ্বাসের লোকজন যোগ দিতো। মনে আছে দুর্গা পূজা শুরুর দিন-কয়েক আগে মহালয়ার দিন ভোর রাতে আকাশবাণী থেকে প্রচারিত হতো চন্ডীপাঠ। বাবা ভোররাতে আমাদের সবাইকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলতেন। রেডিওকে ঘিরে আমরা মা-বাবা, কটি ভাই-বোন এবং পাশের বাসা থেকে মুকুল আপা, তার ছোট ভাই বাবুল এসে আমাদের সাথে যোগ দিতো। আমরা গভীর আগ্রহ আর উৎসাহ নিয়ে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে চন্ডীপাঠ আর পঙ্কজ মল্লিকের সুরে গাওয়া গান শুনতাম। সংস্কৃত ভাষায় উচ্চারিত বন্দনার কিছুই বুঝতাম না। কিন্তু খুব ভালো লাগতো। ফি-বছর এমনটি হতো। অথচ আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ছিল ভিন্ন। আমরা যারা তখন স্কুল-কলেজে পড়তাম এবং মুকুল আপা যিনি ছিলেন আমার দিদির স্কুল-সহপাঠি (অপর্ণাচরণ বালিকা বিদ্যালয়), আমাদের মাথায় ঘুনাক্ষরেও আসেনি এই ভাবনাটা যে, আমরা কেন একটি ভিন্ন-ধর্মের ধর্মীয়-বন্দনা শুনবো, তাও গভীর রাতে ঘুম থেকে জেগে উঠে। চন্ডীপাঠ যখন শেষ হতো তখন সুবেহ সাদেক। সূর্য তখনও না উঠলেও দিনের আলো একটু একটু করে স্পষ্ট হচ্ছে। একটু একটু শীতও। গায়ে চাদর জড়িয়ে আমরা যেতাম পাড়ার শেষ-মাথায় যে বিহারী একটি পরিবার ছিল তাদের বাগান-সীমানায়। সেই বাগানে ছিল একটি শিউলী গাছ। তার নীচের সবুজ ঘাস কুয়াশায় ঢাকা। তাতে পড়ে থাকতো ঝরা শিউলী ফুল, যেন কোনো এক অজানা আহত অভিমানে। বাগানের সীমানা পেরিয়ে সেই ফুল ছড়িয়ে থাকতো বাগানের বাইরেও। আমরা বাইরে থেকে সে ফুল কুড়িয়ে বাসায় ফিরে সুই-সুঁতো দিয়ে মালা গেঁথে ভেতরে শোবার কামরায় যেখানে গৌতম বুদ্ধের বড় আকারের ছবি, তাতে ঝুলিয়ে দিতাম। পূজার সময় দল বেঁধে, যখন ছোট ছিলাম বাবা-মার সাথে রিকশা চড়ে পূজা মণ্ডপের দিকে যেতাম। যখন বড় হলাম তখন বন্ধু কিংবা গ্রাম থেকে পূজা দেখতে আসা নিকট-আত্মীয়দের সাথে এক মণ্ডপ ছেড়ে আর এক পূজা মণ্ডপের দিকে এগিয়ে যেতাম। কে কয়টা পূজা মণ্ডপ দেখেছি তার প্রতিযোগিতা চলতো আমাদের মাঝে। সাইফুল, ইউনুস, বাবুল এরা হতো সঙ্গী। এখন দিন বদলেছে। বদলেছে অনেক কিছু। আমাদের সময় পূজা মণ্ডপে পুলিশী পাহাড়া ছিলনা। থাকতো কিছু স্বেচ্ছাসেবীর দল, যারা মণ্ডপে আসা লোকজনদের সামাল দিতো, প্রসাদ দিতো। এখন পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব, অস্ত্র হাতে, দেখে মনে হয় যেন যুদ্ধক্ষেত্র। এখন পূজা দেখতে যেতে ভয় হয়। মনের ভেতরে আতংক, কখন না জানি কী বিপদ নেমে আসে। আগের সেই প্রাণ-ভরে পূজার আনন্দ করার দিন আর নেই, কথাটি মানতে কষ্ট হলেও বাস্তব সত্যি। তারপরও পূজা দেখতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা যান, যান মনের ভেতর শংকা নিয়ে। আগের সেই ভয়-হীন পূজা উৎসব হারিয়ে গেছে। এখন দুর্গা পূজা যেন ‘কেবল’ হিন্দুদের। গোটা বাঙালির আর নয়। ঠিক একই ব্যাপার হতো ঈদের সময়। কুরবানী ও রোজার ঈদের সময়, এখনো মনে আছে, অপেক্ষা করতাম কখন সাইফুল, ইউনুস কিংবা বাবুল, পলোগ্রাউন্ড মাঠে অনুষ্ঠিত ঈদ-জামাত শেষ করে বাসায় ফিরবে। ওরা ফিরে এলে একসাথে এ-বাড়ি ও-বাড়ি যাবার পালা আর খাওয়া। কষ্ট হয়, দুঃখ হয় যখন দেখি এই পূজাকে ঘিরে একটি মহল বরাবর দেশে ধর্মীয় সমপ্রীতি নষ্ট করতে চেয়েছে এবং এখনো করে চলেছে। এরা এখন সবকিছুতে খুঁজে বেড়ায়, ‘আমরা’ আর ‘ওরা’ কিংবা ‘আমাদের’ আর ‘ওদের’ এবং এই করে মানুষের মধ্যে ধর্মীয় বিষবাষ্প ছড়িয়ে বেড়ায়। শাহ আবদুল করিমের অতি জনপ্রিয় গানের কথা মনে পড়ে। এটিই যেন এখনকার বাস্তব চিত্র। ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম/ গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুলসমান/ মিলিয়া বাউলা আর মুর্শিদী গাইতাম/ হায়রে আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম।’ এই সমস্ত কথা মনে এলো এবারের দুর্গাপূজাকে ঘিরে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, গাজীপুর, কক্সবাজার সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পূজা মণ্ডপসহ কিছু মন্দিরে যে হামলা ও ভাঙচুর হয়েছে তারই পরিপ্রেক্ষিতে। এই হামলা নতুন কিছু নয়। পত্র-পত্রিকা খুললেই প্রায়শ চোখে পড়ে এমনতর ঘটনা। ধর্মকে ব্যবহার নয়, অপব্যবহার করে কিছু চেনা গোষ্ঠী দেশের বিরাজমান ধর্মীয় সমপ্রীতি নষ্ট করার অপচেষ্টায় লিপ্ত দীর্ঘদিন ধরে। এরা কেবল সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। দিন কয়েক আগে এক ভিডিও সম্মেলনে ঢাকা থেকে বিশিষ্ট সাংবাদিক সালিম সামাদ এই বলে তার অভিমত ব্যক্ত করেন, ‘দুঃখের বিষয় যে বিগত ২০ বছরে দেশে এই ধরনের অপরাধ যারা করেছে তাদের একজনকেও এখনো পর্যন্ত বিচারের সম্মুখীন করা যায়নি।’ তিনি আরো বলেন, গত ১০ বছরে এই ধরনের ১০টি ‘টার্গেট ইন্সিডেন্স’ বা ঘটনা ঘটেছে অথচ পুলিশ কোন ঘটনা রেজিস্টার করেনি। দেশে এক ধরনের ‘কালচার অব ইমপিউনিটির’ কারণে কাউকে বিচার করা যায়নি বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি আরো বলেন, নয় বছর আগে রামু বৌদ্ধমন্দির আক্রমণের শিকার হয়, কিন্তু বিগত নয় বছরে কাউকে বিচারের সম্মুখীন করা হয়নি এবং যিনি এই ঘটনার পেছনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি এখন নাইখ্যাংছড়ির ক্ষমতাসীন দলের নেতা।’ সালিম সামাদের বক্তব্য যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে বলতেই হয় এই ‘বিচারহীনতার’ কারণে সন্ত্রাসীরা একটির পর একটি ঘটনা ঘটাবে, সেটাই স্বাভাবিক। আশার বাণীও শুনি এই দুঃসময়ে। দেশের বিভিন্ন স্থানে দুর্গাপূজা মন্ডপ ও মন্দির আক্রমনের ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমপ্রতি জোরালো ভাষায় বলেছেন, “অপরাধীদের খুঁজে বের করে এমন শাস্তি দিতে হবে যেন আর কেউ এই ধরনের ঘটনা ঘটানোর সাহস না পায়।” তিনি বলেন, “বাংলাদেশ একটা অসামপ্রদায়িক চেতনার দেশ। বাংলাদেশে সব ধর্ম-বর্ণের সবাই একসঙ্গে বসবাস করবে। এবং যার যার ধর্ম সে সে পালন করবে। অর্থাৎ ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ এবং বাংলাদেশে কিন্তু এটা সব সময় ছিল, আছে। উৎসবের সময় প্রত্যেকে এক-সঙ্গে সামিল হয়ে আনন্দ উপভোগ করে। আমি চাই আমাদের দেশের মানুষ সুন্দরভাবে জীবনযাপন করবে, সব ধর্মের মানুষই তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করবে। সেটাই আমাদের লক্ষ্য।” বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার এই ব্যাপারে আন্তরিকতার অভাব নেই। এই ব্যাপারে কারো মনে কোন সন্দেহ নেই। তবে অনেকে ‘সর্ষের ভেতর ভূত’ রয়েছে। এই অভিযোগ করে বলেন, প্রশাসনের মধ্যে ঘাপটি মেরে আছে অসামপ্রাদয়িক চেতনার অনেকেই। যারা বর্তমান সরকারের লক্ষ্যকে ব্যর্থ করার জন্যে সর্বাত্মক অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানের ভূত অনেকের মাথায় গেড়ে আছে। বিচার হয়নি বলে অপরাধীরা আইনের হাত গলিয়ে কেবল বেরিয়ে পড়ছে না, দাপটে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং তাদের অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে। এই অপশক্তি আজকে দেশে নতুন নয়। পাকিস্তান আমল থেকে এরা সচেষ্ট থেকেছে ধর্মকে অপব্যবহার করে দেশের শান্তি, উন্নয়ন ব্যাহত করতে এবং তাদের রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে। সুখের বিষয়, বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এদের প্রত্যাখ্যান করেছে। সাধারণ জনগণ ধর্মীয় উন্মাদনাকে কোন কালেই তেমন প্রশ্রয় দেয়নি। দেয়নি বলে মাঝে যে রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি হতে চলেছিল তা আজ একেবারে নির্বাসিত না হলে থেমে আছে। ধর্মীয় উন্মাদনা দেশে দেশে অশান্তি সৃষ্টি ছাড়া, অরাজকতা সৃষ্টি ছাড়া ভালো কিছু করতে পারেনি, পারেনা। তাই একে প্রতিহত করতে হবে জনগণকেই।
মানবাধিকার নেত্রী এডভোকেট সুলতানা কামাল এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা যাঁরা নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের মানুষ বলে দাবি করি, তাঁদের সবার জন্য এ রকম সহিংসতার ঘটনা লজ্জাজনক।’ বাস্তবিক, এ লজ্জা আমাদের সবার, লজ্জা গোটা জাতির। এ লজ্জা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগিয়ে যাওয়া দাবিদার বাংলাদেশের, বর্তমান সরকারের। এ লজ্জা রাখি কোথায়?
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধসবার উপরে মানুষ সত্য
পরবর্তী নিবন্ধঅসাম্প্রদায়িক সমাজমানস