সবার উপরে মানুষ সত্য

অভিমত

ফারহানা ইসলাম রুহী | শনিবার , ২৩ অক্টোবর, ২০২১ at ৮:৫১ পূর্বাহ্ণ

হাজার বছর ধরে এই উপমহাদেশে জনসাধারণ যার যার নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করে আসছে। এই বাংলায় ঈদ, পূজা, পার্বণ উৎসব, হাটবাজার, মেলা চিরকাল সকল ধর্মের মানুষদের ভালোবাসার মহামিলন কেন্দ্র। জাতি ধর্ম, বর্ণ কোনোদিন নাগরিক ও সামাজিক সম্পর্কের বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। আমার জন্ম রক্ষণশীল ধার্মিক মুসলিম পরিবারে হলেও কিন্তু বেশ কিছু স্বনামধন্য রক্ষণশীল হিন্দু পরিবারের সাথে গভীর সুসম্পর্ক ছিল এখনো বিদ্যমান। মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় বাড়ির পাশে মন্দির, মসজিদ দুটোই কাছাকাছি। জনতা ধর্ম পালনে কোনোদিন বাধাগ্রস্ত হয়নি। প্রয়াত বিজ্ঞ আইনজীবী চিত্তরঞ্জন দাসের ঈদের সেমাই নিয়ে বেড়াতে যেতাম। ঠিক তেমনি রমজান মাসে বিশেষ করে দক্ষিণ নালাপাড়া নিবাসী বিজ্ঞ আইনজীবী বনবিহারী বসু জেঠুর বাড়ি হতে ইফতারি ও ঈদের ঈদি পেতাম। পূজা উপলক্ষে প্রীতি উপহার স্বরূপ তিন ভাইবোনদের জন্য জামা-কাপড় আর বিজয়া শুভেচ্ছা হয়ে মিষ্টি আসতো, এখনো আসে। শুধু তাই নয় আমার খ্রিস্টান সমপ্রদায়ের সহকর্মীর কাছ থেকে নিয়মিত বড়দিনের কেকও উপহার পাই। আমার বাড়ি হতে কুরবানীর রান্না গোশত তাদের গৃহে যায়। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান উৎসব সব সময় ভালোবাসা প্রকাশের মেলবন্ধন ও সুসম্পর্ককে গভীর করেছে। ঈদুল ফিতরের মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজনে আত্মীয় স্বজন শুধু নয় পারিবারিক সৌহার্দ্য হিসেবে অতি ঘনিষ্ঠ বেশ কিছু অমুসলিম বন্ধুবান্ধবও নিমন্ত্রিত থাকেন।
পাথরঘাটা নিবাসী প্রয়াত ভ্রমর লাল জৈন যতদিন জীবিত ছিলেন বেশ বড় ইগলু আইসক্রিম বক্স পাঠাতেন। একবার আমার বাবা মরহুম অ্যাডভোকেট এস এম শামসুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালীন আইন অনুষদে মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষার সময় খুবই জ্বর হয়। শারীরিক অবস্থার এতই খারাপ ছিল পরীক্ষা সিটে বসার কোনো উপায় নেই। বাবার সিনিয়র বন্ধু রাঙ্গুনিয়ার মরিয়ম নগর নিবাসী ডাক্তার নীহার বড়ুয়া ও জেঠিমা হল থেকে তাঁদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করেছিলেন। তাদের যত্নে ও ভালোবাসায় আব্বা মাস্টার্স ফাইনাল এ ১৩তম হয়েছেন। এই মহান দম্পতি কাছে বাবা আজীবন চির কৃতজ্ঞ ছিলেন। ছোট ভাই সেন্ট প্লাসিডস হাই স্কুলে পড়ার কারণে সুশীল রাজগড়িয়ার সাথে তারা বাংলাদেশে যতদিন ছিলেন ততদিন পর্যন্ত পিতার সাথে সম্পর্ক খুব ভালো ছিল। এতো সমপ্রদায়ের সাথে সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছে। মুসলিম পরিবারসহ ভিন্ন সমপ্রদায় পরিবারগুলো অত্যন্ত আন্তরিক ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, প্রখর মানবতাবোধ ও সমমনা ছিলেন। তাঁরা সবাই সহজ সরল নির্ভেজাল শান্তিপ্রিয় মহৎ প্রাণ ও সুন্দর চিত্তের মানুষ ছিলেন। বন্ধুত্ব ও আত্মার বন্ধনে ধর্ম কোনোদিন বাধা হয়নি। মহানুভবতা ও মানবতার জয় হোক এই ছিল তাদের অন্তরের বাণী। অনেক সময় জীবনে রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় বিপদে উপকারে আসে না। অনাত্মীয় ভিন্ন সমপ্রদায়ের প্রতিবেশি ও বন্ধু জীবনের শ্রেষ্ঠ সমব্যথী হয়ে পাশে থাকেন। মনে পড়ে ঊনিশ শতকের ধর্ম ও সমাজ ভাবনা- ‘জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’। তাই বিগত কয়েকদিনের সামাজিক চিত্র মন কে ভীষণভাবে ব্যথিত করেছে। এই ভাবে চললে মানবিকতার মৃত্যু হয়ে অসহায় মানুষ মৃত্যুর ঘণ্টা বাজার আগেই মরে পড়ে থাকবে, ধীরে ধীরে গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হবে। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ও বিশ্ব দরবারে ঐতিহ্য সমৃদ্ধ ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখতে সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি রক্ষায় সকল জনসাধারণকে এগিয়ে আসতে হবে। বর্তমান প্রজন্মকে মানুষকে ভালোবাসার দীক্ষা দিতে হবে। যে কোন বিপ্লব, মুক্তিযুদ্ধ, ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, করোনা মহামারী সকলে মিলে জাতির দুঃসময়কে পার করেছি ও চলছি। সোনার বাংলায় প্রতিটি ধর্মের মানুষ স্বদেশ ভূমির জন্য হাতের পাঁচটি আঙুলের মত মুষ্টিবদ্ধ দৃঢ়শক্তি। এই শক্তিকে ধ্বংস করতে দেয়া যাবে না। দেশবিনাশী সেই অশুভ শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পরাস্ত করতে হবে।

লেখক : শিক্ষক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধপদ পদবী প্রতিষ্ঠানের সমূহ ক্ষতি
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে