হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ১ এপ্রিল, ২০২৩ at ৫:২৫ পূর্বাহ্ণ

‘The magic think about home is that it feels good to leave, and it feels even better to come back.’

অনেকটা সময় এবার কেটে গেল দেশে। প্রায় হপ্তা তিনেক। এর আগে আড়াই মাস দেশে থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি হল্যান্ড ফিরে গিয়েছিলাম। আবার আসতে হলো বিশেষ কাজে তার প্রায় এক মাস পর। গেল বছর ডিসেম্বরে যখন দেশে এসেছিলাম তখনকার আবহাওয়া ছিল চমৎকার, যেন ইউরোপের সামার।

 

তবে গত কদিন ধরে গরম পড়তে শুরু করেছে, যদিওবা এখনো সহনীয় পর্যায়ে। আগামীদিনগুলিতে যে এর তীব্রতা বাড়বে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এখন মনে হয় ফিরে যেতে পারলেই বাঁচি। কিন্তু চাইলেই কি আর হয়? মানুষ তো কত কিছুই চায়। প্রায় ক্ষেত্রে চাওয়া আর পাওয়ার মাঝে যোজন ফারাক থেকে যায়।

কথায় আছে ‘ম্যান প্রোপোজেস, গড ডিসপোজেস’, অর্থাৎ মানুষ পরিকল্পনা করে বটে, কিন্তু উপরওয়ালা নির্ধারণ করেন কীভাবে তা ঘটবে। কদিন ধরে কিছুটা ‘হোমসিকনেসে’ ভুগছি। অথচ যে ‘হোমের’ জন্যে দিন কয়েক ধরে ‘সিকনেসে’ ভোগা সেটি আমার ‘হোম’ নয়। সেটি আমার দীর্ঘ তিন যুগেরও বেশি

দিনের আবাস বটে, বলা যায় স্থায়ী আবাস, কিন্তু ‘হোম’ বলতে যা বুঝি তা তো কিছুতেই হবার নয়। তাহলে ‘হোম সুইট হোম’সেটি আমার কোথায়? সাত সমুদ্দুরের এপাড়ে? না ওপাড়ে? ক’দিন ধরে মনে হচ্ছে কোথায়, কী যেন ফেলে এসেছি। পিছু ফেলে এসেছি পটেআঁকা ছবির মত দেশ, নিশ্চিত পরিকল্পিত

একটি জীবন। দেশে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যে অনিয়ম, অনাচার, অব্যবস্থা তার কতা পরিমাণ অবস্থান নেই সে দেশে। সেখানে সবকিছু চলে নিয়মের ভেতর দিয়ে, ‘সিস্টেমের’ মধ্যে দিয়ে। এই সবকিছুর, আমার জন্ম ও বেড়ে উঠা দেশে, আকাল বলে কি ওই ভিন দেশের জন্যে মনের কোনায় আকুলিবিকুলি হচ্ছে?

একটা সময় ঠিক করেছিলাম, কাজ থেকে অবসর নিয়ে বছরের অনেকটা সময় দেশে এসে কাটাবো, এদিকওদিক ঘুরবো। এই ভেবে অবহেলা আর অযত্নে বেড়ে উঠা এই দেশটিকেই তো ভালো করে দেখা হয়নি। এ যেন সেই ‘বাড়ির কাছে আরশিনগর, আমি একদিনও না দেখিলাম তারে’। কথাটা হল্যান্ডের এক

আড্ডায় তুল্লে আমার এক বিদেশি কূটনীতিক বন্ধু বলেছিল, ‘পারবে না, একটা সময় তুমি হাঁফিয়ে উঠবে। বত্রিশ বছর তুমি রয়েছো এমন একটি দেশে যেখানে সবকিছু হাত বাড়ালেই পাও, এমন কী চাইবার আগেও। বাংলাদেশে গিয়ে তুমি যখন প্রতিটি ক্ষেত্রে এর অভাব দেখবে তখন তুমি হতাশ হয়ে পড়বে’। দ্বিমত

পোষণ করে বলেছিলাম, ‘না আমার ক্ষেত্রে এমনটা হবে না’। এখন নিজের ডেরায় রয়েছি, খাচ্ছি দাচ্ছি, ঘুরে বেড়াচ্ছি, আড্ডা দিচ্ছি কাজের ফাঁকেভালোই কেটে যাচ্ছে। কিন্তু কদাচিৎ নিজের কিংবা পরের কোন কাজে যখন বিশেষ করে কোন সরকারি অফিস বা কারো দ্বারস্থ হচ্ছে, তখন মনে হয় বন্ধুর উপলদ্ধিই

সঠিক– ‘কিছুদিনের জন্যে দেশ ভালো লাগবে, যখন চারিদিকে দেখবে অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থা তখন তোমার আর ভালো লাগবে না’। ফিরে আসতে চাইবে। তবে কি আমার মন ফিরে যেতে চাইছে? জানিনে। আসলে এই মনটাই তো করে যত গোলমাল।

এদিকে দেশে আমার এই একাথাকা নিয়ে নিকটজনদের উদ্বেগ আর চিন্তার শেষ নেই। অথচ রান্নাবান্না করা, ঘরপরিষ্কার রাখার জন্যে কাজের মেয়ে আছে। সকালের দিকে যে স্বল্প সময়টুকু বাসায় থাকি তখন সে এসে তার কাজ করে চলে যায়। যাবার সময় ব্যাগভর্তি বেঁচেযাওয়া খাবার সাথে নিয়ে যায়। সে যে

পরিমান রান্না করে তাতে তিনজন খেতে পারে। হেঁসেলের দিককার খোঁজ কখনো রাখিনি, রাখার প্রয়োজন হয়নি বলে। সেটি কাজে মেয়েটির জন্যে সুবিধের হয়েছে বলে ধারণা। বাসায় এসে সে প্রথমে হাতমুখ ধোবে। তেমন নির্দেশ রয়েছে। তারপর ফ্রিজ থেকে পাউরুটি আর ডিম বের করে খাবে। কখনো জেলি

দিয়ে। ঘরের মালিক খায় দিনে বড়জোর একটা মুরগির ডিম। একদিন রান্না ঘরে গিয়ে দেখি সে দুটি ডিম পোজ করে তিন স্লাইস পাউরুটি নিয়ে খাচ্ছে। তাকে কিছু বলিনা। অভাবী মানুষ। একটু না হয় বেশি খেলো। তবে খুবই নির্ভরশীল। তার মালকিন, সুমনা তাকে মাঝে মধ্যে ফোনে অনলাইন ট্রেনিং দেয়। বলে

‘এইভাবে রানবা, ঐভাবে রানবা, মরিচ কম দেবা, তোমার মামা (অর্থাৎ আমি) ঝাল কম খায়’ ইত্যাদি ইত্যাদি। সুফিয়া অর্থাৎ মেয়েটি সুমনার নির্দেশ পালন করে অক্ষরে অক্ষরে। আশ্বাস দিয়েছে সামনের মাসে দেশে এলে তার (সুফিয়া) জন্যে স্মার্ট ফোন নিয়ে আসবে। যাই হোক, বলছিলাম নিকটজনদের উদ্বেগের

শেষ নেই। ভাইয়ের খবর সাধারণত বোনেরা বেশি নিয়ে থাকে। বিশেষ করে যখন আমার মত অসহায় দশায় থাকে ভাইটি। আমার দুবোনের বড় জন (মাধুরী) অনেক বছর ধরে ঢাকাবাসী। ছোট যে ছিল (মনিকা) সেও স্বামী, সন্তান নিয়ে ঢাকায় স্থায়ী আবাস গড়েছে বছর দুয়েক আগে। দুবোনের চিন্তার শেষ নেই

ঠিকমত খাচ্ছি কিনা, খেতে পারছি না, কী খাচ্ছি ইত্যাদি ইত্যাদি। বৌদি আছেন, থাকেন একা তিন কামরার একটি ফ্ল্যাটে। কোভিড সময়ে দাদা মারা যাবার পর থেকে দানধর্ম, ধ্যানভাবনা নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকেন।

আমি সৌভাগ্যবান, এই অর্থে ঘরের বাইরেও আমার হিতার্থীর ঘাটতি নেই। ওনারা প্রায়শ ফোন করে খোঁজখবর নেন। দয়া করে, নাকি করুনা করে, জানিনে, তাদের বাসায় নেমন্ত্রণ করেন। গাড়িও পাঠিয়ে দেন। আবার ফেরার পথে ড্রাইভারের হাতে খাবার গছিয়ে দেন। প্রতিবারের মত এবারও চাটগাঁ পৌঁছার পরদিন

ভাগ্নি শিউলি ফোন করে বলে, ‘মামা, আজ রোজা শুরু হলো, ইফতারির পর খাবার পাঠিয়ে দেব। গোমাংস পছন্দ করি, একটু বেশি করেই করি। সেটি সে জানে। কেবল সে কেন, আমার আত্মীয়স্বজন, বন্ধু কারো তা অজানা নয়। শিউলিকে ‘না’ করলে সে জোর করে, বলে, একটু গরুর গোস্ত পাঠিয়ে দেই। শিউলি

মুন্নী আপার মেয়ে। রেলওয়ের যে সরকারি পাড়ায় (বয়লিউ এভিনিউ) বড় হয়েছি, ওই একই পাড়ায় বড় হয়েছে শিউলিও, তার আর চার বোনের সাথে সাথে। তারা সব বোন দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি সুন্দর তাদের আচারব্যবহার। শিউলিকে যখন ওই পাড়ায় শেষ দেখি তখন তার বয়স বড়জোর ১০/১২। বছর

দেড়েক আগে হঠাৎ দলবল নিয়ে শিউলি হাজির আমার গ্রামের বাড়ি, এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে। শিউলি, তার স্বামী, এমন কী তার মা যাকে মুন্নী’পা বলে ডাকি, তিনিও। সাথে তার বাবা আনোয়ার ভাই, শিউলির আরো তিন বোনসবাই উপস্থিত। সে এক হুলুস্থুল কান্ড। মুন্নী আপা আমার দিদির সমবয়সী। মাস

দেড়েক আগে হল্যান্ড ফিরবো। যাবার আগে ওর খুলশীর বাসায় যেতে হয়েছিল। যেতে হয়েছিল বলছি এই কারণে বেড়াতে যাবার মত সময় হাতে ছিলনা। কিন্তু তার আন্তরিকতা, আবদারকে পাশ কেটে যেতে পারিনি। প্রচুর খাবার আয়োজনের পাশাপাশি সুমনার জন্যে সে জোগাড় করে রেখেছিল খেজুর রস ও গুড়।

আমাকে বাধ্য করেছিল ওসব হল্যান্ড নিয়ে যেতে। সাধারণত আমি খাবার সাথে বহন করি না। কখন ঝামেলায় পড়তে হয় সে কারণে। কিন্তু শিউলির আবদার, অনুক্ষণ ‘মামা’ ‘মামা’ ডাক আমাকে সেই আবদার এড়িয়ে যেতে দেয়নি। এমনই শিউলি।

এর সাথে আর দু’জনের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। আমার পরম সৌভাগ্য যে তাদের একজন আমাকে মাঝে মধ্যে নিজ থেকে ফোন করে আমি কেমন আছি, কী খাচ্ছি তার খোঁজখবর নেন। তার বাসায় ডাকেন, তার শত ব্যস্ততার মাঝেও। তিনিও তার স্বামীর মত অতি ব্যস্ত, সংসার ছাড়াও নানা সামাজিক কর্মকান্ডে।

নাম কামরুন মালেক। দৈনিক আজাদী সম্পাদক, একুশে পদক প্রাপ্ত প্রবীণ সাংবাদিক এম এ মালেকের সহধর্মিণী। প্রাক্তন লায়ন গভর্নর মিষ্টভাষী কামরুন ভাবি এই কিছুক্ষণ আগেও ফোন করে খোঁজখবর নিয়ে জানতে চাইলেন, কোথায় আছি। উত্তরে হেসে বলি, ‘ভাবি, ম্যারিডব্যাচেলর, কোথায় আর যাবো’।

শুনে উনি মিষ্টি হাসি হাসেন। প্রাণ জুড়িয়ে যায়। বাসায় যাবার জন্যে, ওনাদের সাথে একসাথে ইফতার করার জন্যে জোর করতে থাকেন। অথচ দিন কয়েক আগেও খেয়ে এলাম। এমনটি ফিবার হয় দেশে এলে। বিষয়টা হয়তো তেমন কিছু নয়, কিন্তু আবার অনেক কিছু। আমি বা সুমনা ভাবি ও মালেক ভাইয়ের

জন্যে এমন কিছু করিনি যে তার ‘বদলা’ স্বরূপ ওনারা আমাদের জন্যে এমনটি করবেন। কেবল তারা দু’জন নন, এই পরিবারের প্রতিটি সদস্যতাদের দুই সন্তানওয়াহিদ ভাই ও শিহাব, তাদের দুই স্ত্রীর আচরণ ভুলিয়ে দেয় আমরা ওই পরিবারের বাইরের একজন। সব চাইতে যে বিষয়টি ভালো লাগার তা হলো

পরিবারের সবার একসাথে বসে খাওয়া। খাওয়া তো বড় বিষয় নয়, কিন্তু যে বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করার মত, শিক্ষণীয় এবং অনুকরণীয় তা হলো পরিবারের সকল সদস্যের অতিথিদের সাথে একত্রে বসে, গল্প করতে করতে কেবল খাওয়া নয়, সময়টুকু উপভোগ করা। এতে অতিথিরা ‘আপন’ বোধ করে।

এমনটি খুব কম ঘটতে দেখি, অন্তত আমিদেশে বিদেশে, দুদিকেই।

শেষ করবো আর একজনের কথা বলে। দেশে পৌঁছার সংবাদ পাবার সাথে সাথে হাজারো ব্যস্ততার মাঝেও ফোন করে উচ্চস্বরে বলে উঠবেন, ‘দাদা, অনে কডে’। তার এই জিজ্ঞাসায় থাকে আন্তরিকতার ছোঁয়া। তারপর তার ক্লাব ও বাসায় নেমন্ত্রণ। তিনি চিটাগাং সিনিয়র্স ক্লাবের এক নাগাড়ে ষষ্ট বারের মত

নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডাক্তার সেলিম চৌধুরী। ওকে বাইরেও তার অনেক কিছুর সাথে সংশ্লিষ্টতা। দিন কয়েক আগে তার বাসায় ছিল ইফতারির দাওয়াত। ফেরার সময় ড্রাইভারের হাতে তার স্ত্রী লিজা ভাবি ধরিয়ে দিলেন তিন প্যাকেটভর্তি খাবার। সাথে ঈদের আগাম উপহার, চমৎকার একটি পাঞ্জাবি। এত খাবার

আমার একার পক্ষে সাবাড় করা সম্ভব নয়। আমার পাশাপাশি লাভ হলো সুফিয়ারও। আরো কয়েক নিকট বন্ধুর কথা বলা যেত। স্থান সংকুলান হবে না ভেবে তা থেকে বিরত রইলাম। বাবা বলতেন, ভালো বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আমার ভাগ্য বরাবর ভালো। আমার এই জীবনে তেমন কষ্ট পাইনি। যে দাদা মারা

গেছেন তিনি প্রায়শ বলতেন, ‘তোর প্রতি মায়ের আশীর্বাদ আছে’। সে আমি জানি, বিশ্বাস করি। কেননা প্রতিটি সন্তানের জন্যে সকল মায়ের আশীর্বাদ থাকে।

লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধু একাই ইতিহাস
পরবর্তী নিবন্ধগণতন্ত্র-মানবাধিকার বিতর্কের অবসান জরুরি