বঙ্গবন্ধু একাই ইতিহাস

বঙ্গবন্ধুর জীবনব্যাপী কর্মপ্রক্রিয়ার আন্তরিক মূল্যায়ন

সৌভিক চৌধুরী | শনিবার , ১ এপ্রিল, ২০২৩ at ৫:২১ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু একই সূত্রে গ্রথিত। বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে যেমন বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা হয় না তেমনি রাজনীতির বাইরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর চিন্তা ভাবনা, দর্শন এবং সেই সূত্রে তাঁর কর্মসম্পাদনের ইতিহাস এড়িয়ে যাওয়া যায় না।

 

 

তাঁর ভাবনা, জীবনব্যাপী কর্মপ্রক্রিয়া নিয়ে রচিত হয়েছে প্রাবন্ধিক ও অধ্যাপক পিংকু দাশের গ্রন্থ ‘বঙ্গবন্ধু একাই ইতিহাস’। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী দেশ গঠনে তাঁর ভূমিকা এসব বিষয় নিয়ে সরল ভাষায় লিখিত প্রবন্ধ সন্নিবেশিত হয়েছে এই গ্রন্থে। লেখাগুলো বিভিন্ন সময় স্থানীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে।

বইটিতে মোট নয়টি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে। প্রতিটি প্রবন্ধের বিষয় বস্তু নির্বাচনে লেখক বঙ্গবন্ধুর বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা, অসাম্প্রদায়িকতা, মানবতাবাদ, ভাষা চিন্তা, সাহিত্য এবং তাঁর উত্তরসূরির বিভিন্ন অবদান নিয়ে আলোকপাত করেছেন। ‘বাঙালি জাতির স্বপ্নের ধারক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু’ প্রবন্ধে একটি

জাতির স্বকীয়তা, স্বপ্ন, জাতিগত উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা উৎসারিত হয়েছে। একই প্রবন্ধে তিনি মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের বিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুর সক্রিয় অবদানের কথা উল্লেখ করেছেন। বঙ্গবন্ধু মাটি ও মানুষের অবদানের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের যে নজীর স্থাপন করেছিলেন তা উল্লেখপূর্বক লেখক এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন প্রবন্ধে।

ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর সম্পৃক্ততা সর্বজনবিদিত। ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলা ভাষার বিশ্ব বিজয়’ প্রবন্ধে ১৯৪৭ সাল থেকে ভাষার দাবীতে সংগ্রামের বিবরণ উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক ছাত্রলীগ ‘গঠিত হবার পর থেকেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব এবং সংগ্রামের কথা লেখক বিবৃত করেছেন নিপুনভাবে।

১৯৪৭ সালে বঙ্গবন্ধুর কারাগার যাপন এবং ১৯৫২ র ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে বন্দী জীবন অতিবাহিত করার বিষয়টি তিনি উল্লেখ করেছেন। শুধু তাই নয়, এই বন্দীদশা থেকে মুক্ত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তীব্র আন্দোলনে তাঁর অংশগ্রহণের বিভিন্ন পর্যায় বর্ণনা করা হয়েছে।

১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর বঙ্গবন্ধু দেশের খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবার জন্যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। লেখকের ‘বঙ্গবন্ধুর কৃষি উন্নয়ন ভাবনা’ প্রবন্ধে যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে কৃষি খাতকে বিশেষ অগ্রাধিকার দেয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। কৃষি উন্নয়নের জন্য অবকাঠামো প্রতিষ্ঠার যে উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন তার বিস্তারিত বিবরণ লেখক এই প্রবন্ধে দিয়েছেন।

অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং মানবতাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন বঙ্গবন্ধু। সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করা বঙ্গবন্ধুর একটি বড় গুণ ছিল তিনি অন্য ধর্ম ও মানুষের প্রতি সহনশীলতা ও ভালোবাসা দেখাতে পারতেন। ‘বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও মানবতাবাদ’ প্রবন্ধে তাঁর সেই চেতনার সবিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন লেখক।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্গঠনে মনোযোগী হয়েছিলেন। নিরক্ষরতা দূরীকরণে তাঁর উদ্যোগ, শিক্ষা কমিশন গঠন এবং নানামুখী উদ্যোগের মাধ্যমে একটি সমৃদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নে তাঁর চিন্তাভাবনার বিস্তারিত বর্ণনা ‘বঙ্গবন্ধুর বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা’ প্রবন্ধে লেখক তুলে ধরেছেন। জাতির মেরুদণ্ড হিসেবে শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয়ার যে চিন্তা বঙ্গবন্ধু করেছিলেন সেই চিন্তাকে বাস্তবে রূপায়িত করার প্রচেষ্টার বর্ণনা তুলে ধরেন লেখক এই প্রবন্ধে।

বঙ্গবন্ধুর সাহিত্য প্রেম ও সংস্কৃতিপ্রীতি’ একটি সমৃদ্ধ প্রবন্ধ। সমাজকে বাদ দিলে যেমন সাহিত্য হয় না, সাহিত্যকে বাদ দিয়েও সমাজ হয় না। একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে আমরা বঙ্গবন্ধুকে জানি। কিন্তু তাঁর ভেতরে সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতি যে অনুরাগ ছিল, তার একটি অনন্য বিবরণ দিয়েছেন লেখক। শত কাজের ব্যস্ততার মাঝেও বাংলা সাহিত্য এবং বাঙালি সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার যে সংকল্প বঙ্গবন্ধু করেছিলেন, সেই বিষয়টি নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন লেখক।

বঙ্গবন্ধু যে দর্শন নিয়ে দেশ গড়ার জন্য প্রত্যয়ী হয়েছিলেন, ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট ঘাতকের হাতে নির্মমভাবে শাহাদাতবরণ করায় তাঁর কাজ থমকে যায়। এই লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পর থেকেই বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার প্রত্যয়ে দীপ্ত হয়েছেন এবং বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়েছেন। তারই ধারাবাহিক ঘটনাপ্রবাহ লেখক বিবৃত করেছেন ‘বঙ্গবন্ধু থেকে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা’ প্রবন্ধে।

১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এবং শেখ রাসেলের হত্যাকাণ্ড ইতিহাসের এক নিন্দনীয় ঘটনা। এ ঘটনা নিয়ে বেদনাবিধুর এক বর্ণনা দিয়েছেন লেখক তাঁর ‘ইতিহাসের কালো অধ্যায়’ এবং ‘শেখ রাসেল : কলিতেই ঝরে গেল যে ফুল’ প্রবন্ধ দুটিতে। লেখক বঙ্গবন্ধু তনয় শেখ রাসেলের ১১ বছরের ছোট্ট জীবন সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন, তিনি দেখিয়েছেন একটি ছোট শিশুর বোধ, আচরণ এবং পিতার প্রতি গভীর অনুরাগের দৃশ্যাবলী।

লেখক পিংকু দাশ বঙ্গবন্ধুর সার্বিক কর্মকাণ্ড অত্যন্ত সহজ ভাষায় সাবলীলভাবে বর্ণনা করেছেন বিভিন্ন প্রবন্ধে। একজন বঙ্গবন্ধুর পরিচয় শুধুমাত্র রাজনীতিবিদ হিসেবে নয়, এর বাইরেও তাঁর ভাবনা এবং কাজের বৈচিত্রের যে স্ফুরণ ঘটেছিল, তা এক ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে অনিবার্যভাবে, তাইতো বঙ্গবন্ধু একাই

ইতিহাস। নান্দনিক প্রচ্ছদ এবং ছাপায় বইটির দাম রাখা হয়েছে ২২০ টাকা। বইটি প্রকাশ করেছে চট্টগ্রামের খ্যাতনামা গ্রন্থ প্রকাশক ‘শৈলী প্রকাশন’। সহজ, প্রাঞ্জল ভাষায় প্রতিটি প্রবন্ধ রচিত হওয়ায় বইটি পাঠক সমাদৃত হবে বলে আশা করা যায়।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও আবৃত্তিকার

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে