স্পাইসি রোড

শরণার্থী, নারীবাদ এবং একজন নারী ভ্রমণকারীর গল্প

রূপা দত্ত | শনিবার , ১১ জুন, ২০২২ at ৭:১১ পূর্বাহ্ণ

এক পাঠক প্রশ্ন করেছিলো, ভ্রমণ কাহিনীর শিরোনাম এত ভারিক্কী কেন? শরণার্থী, নারীবাদ এর মতো গুরুগম্ভীর বিষয় কেন ভ্রমণ কাহিনীতে? এই প্রশ্ন হয়ত আরও অনেকের মনেই এসেছে। প্রায় ৭/৮ মাস আগে আমার ভ্রমণ কাহিনী যখন লেখা শুরু করেছিলাম, তখন কিছুটা বলেছিলাম এই শিরোনামের কারণ। পরিকল্পনা ছিল স্পাইসি রোডের সাথে ভ্রমণের সময় নিয়ে লেখার। পরে মনে হল, লিখছিই যখন তখন অন্যান্য ভ্রমণের গল্পও করতে পারি। যে উদ্দেশ্যে এই লেখার সূত্রপাত, এতদিন পর সেই স্পাইসি রোডের সদস্যদের সাথে অবশেষে দেখা হল থাইল্যান্ডের চ্যাংমাইয়ে। স্পাইসি রোড হল কয়েকজন ভ্রমণকারীর একটি উদ্যোগ। মূল উদ্যোগটা দক্ষিণ কোরিয়ার মেয়ে ইয়া’র। সে যখন জার্মানিতে ছিল, তখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শরণার্থীদের দেখে এবং বিশেষত নারীদের দেখে তার ইচ্ছে হল ওদের জন্য কিছু করার। তার মতে, বেশিরভাগ নারী শরণার্থী তাদের দেশের প্রথাগত কারণে বা ভাষাগত সমস্যার কারণে, ঘরের বাইরে খুব একটা বের হয় না। পুরুষেরাই ঘরের বাইরের কাজ করে, অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রেও অনেক পিছিয়ে থাকতে দেখেছে নারীদের। বেশিরভাগ শরণার্থী যেসব দেশ থেকে গিয়েছে, সেখানে নারীরা সবকিছুতেই অনেক পিছিয়ে আছে সুযোগের অভাবে। নারীরা তাদের নিজ দেশে তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়ার বা আফ্রিকার দেশ থেকে জার্মানির মতো পশ্চিমা দেশে গিয়ে কিছু করা নারীপুরুষ কারো জন্যেই সহজ নয়। বেশিরভাগ শরণার্থী নারীদের জন্য পরিস্থিতি ছিল সমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়ায় মতো। কীভাবে এই শরণার্থী নারীদের, যারা কখনই ঘরের বাইরে কাজ করেনি, বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে স্বল্পজ্ঞান, তাদের জন্য সম্মানজনক উপায়ে অর্থ উপার্জনের ব্যবস্থা করা যায়, এবং কীভাবে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা যায়, এই নিয়ে ভাবতে শুরু করল ইয়া। ইয়া খেয়াল করল যে জার্মানিতে মধ্যপ্রাচ্যের বা এশিয়ার খাবারের ভালোই চাহিদা তৈরি হয়েছে। তখন ওর চিন্তায় এলো, এই শরণার্থী নারীদের বেশিরভাগ খুব ভালো রান্না করে, যদি এমন একটা রেস্টুরেন্ট চালু করা যায়, যেখানে শরণার্থী নারীরা নিজেদের ঐতিহ্যবাহী খাবার রান্না, পরিবেশনা এবং পরিচালনা করবে, তাহলে কিছু নারীর অন্তত কর্মসংস্থান হবে। আবার সেখানে তাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিকেও তুলে ধরার ব্যবস্থা করা যায়। এতে করে শরণার্থীদের সংস্কৃতির সাথে স্থানীয় জার্মানদের পরিচয় হবে। এক অংশের জার্মানেরা শরণার্থীদের ভালো চোখে দেখে না। তারা ভাবে, শরণার্থীরা জার্মানিকে নষ্ট করতে সেখানে গিয়েছে। আবার বেশিরভাগ শরণার্থী দিন মজুরি বা আপাতদৃষ্টিত নিম্নগোত্রের কাজ করে বলেও, তাদের খুব একটা সম্মানজনকভাবে দেখা হয় না। জার্মান সমাজে যে একটা শরণার্থীবিরোধী মনোভাব ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে, শরণার্থীদের জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানলে, হয়ত শরণার্থী এবং স্থানীয় মানুষের মধ্যকার দূরত্ব কমে আসার সম্ভাবনা তৈরি হবে। তাই ভ্রমণপিপাসু ইয়া ভাবল, তার ভ্রমণকে কীভাবে কাজে লাগানো যায় এই বিষয়ে। ভাবতে গিয়ে মাথায় এলো কেবল ভ্রমণ করার জন্য ভ্রমণ না করে ভ্রমণের মাধ্যেমে শরণার্থী এবং নারীবাদকে প্রচার করতে পারে ভ্রমণের সময়। যত মানুষ সমস্যাগুলো নিয়ে জানবে, তত ভাববে আর ততই সমাধানের সম্ভাবনা তৈরি হবে। এবার ইয়া ভাবতে বসলো কীভাবে কি করবে! তার জার্মান ছেলেবন্ধু ইয়ান্নিকের সাথে বিষয়গুলো আলোচনা করল। অবশেষে তারা ঠিক করল, জার্মান থেকে তারা ভিয়েতনাম পর্যন্ত ভ্রমণ করবে। ম্যাপের এই অংশেই অনেক দেশ আছে যেখান থেকে শরণার্থীরা জার্মানি গিয়েছে। সেই দেশগুলোতে নিজেরা একবার গেলে অন্তত একটা ধারণা তৈরি হবে, আর একটা উদ্দেশ্য হল, এইসব দেশে ভ্রমণের সময় সেখানকার ঐতিহ্যবাহী খাবারের রেসিপি সংগ্রহ করবে। সেইসব রেসিপি নিয়ে পরবর্তীতে সুযোগ হলে বই প্রকাশ করবে আবার ওরা যে রেস্টুরেন্টের কথা ভেবেছে, সেখানেও এইসব রেসিপির খাবার তৈরি করতে পারবে। ইয়া এবং ইয়ান্নিক পরিকল্পনা করল, ওরা যে দেশেই যাবে, সেখানকার স্থানীয় ব্যাক্তি, সংগঠন এবং সংস্থা যারা শরণার্থী এবং নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করে তাদের সাথে দেখা করবে, কথা বলবে, বোঝার চেষ্টা করবে তাদের কাজের ধারা যেটি পরবর্তীতে ওদের কাজে সহায়তা করবে। কিন্তু, এই ভ্রমণের টাকা কোথা থেকে আসবে? সিদ্ধান্ত হল, আগ্রহী আরও কয়েকজন ভ্রমণকারীকে নিয়ে একটা দল গঠন করে তারা ভ্রমণ করবে যার যার নিজের খরচে। যে কোন জায়গার স্থানীয়দের সম্পর্কে ভালো করে জানা এবং ভ্রমণের খরচ কমানোর জন্য, তারা ঠিক করল হিচ হাইকিংএর মাধ্যমে ভ্রমণ করবে, এতে গাড়ি ভাড়া লাগবে না, আর থাকার জন্য কাউচসারফিং ওয়েবসাইট ব্যাবহার করবে।

সেই লম্বা ভ্রমণ এবং প্রচারণার অংশ হিসেবেই ওরা থাইল্যান্ডে এসেছে, এবং আমি ওদের সাথে যুক্ত হয়েছি। ২০১৭ সালের জুলাইয়ে আমার সাথে দেখা হওয়ার প্রায় দেড় বছর আগে থেকে ওরা ভ্রমণ করছে। এই পর্যায়ে দলে আছে ওরা তিনজন ইয়ান্নিক, এলিনা এবং নিনা। ইয়া গেছে ওর দেশে পরিবারের প্রয়োজনে, ও দলের সাথে যুক্ত হবে লাওস নামক দেশে।

নিনা এবং এলিনা একই বয়সী। ওরা যখন ভ্রমণ শুরু করে সবে হাই স্কুল পাস করেছে, ১৬/১৭ বছর বয়েস। জীবনে কি করবে এই সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে, একটু পৃথিবী ঘুরে দেখতে চায়। একে ওরা বলে গ্যাপ ইয়ার। হাই স্কুল শেষে এক বছরের একটা গ্যাপ নিয়ে ভ্রমণ করা বা নিজের ইচ্ছেমত কিছু করা। তারপর, সিদ্ধান্ত নেয়া, আরও পড়বে কিনা, কি নিয়ে পড়বে, নাকি একাডেমিক পড়ালেখা ছেড়ে অন্য কিছু করবে। এত অল্পবয়সী মেয়েদের তাদের পরিবার থেকে একা ছেড়েছে দেশবিদেশ ঘুরতে, এটা আমার মতো বাঙালির মাথায় কাজ করতে সময় নিয়েছিল। এর আগে আরেকজন অ্যামেরিকান কিশোরীর সাথে পরিচয় হয়েছিল ব্যাংককের হোস্টেলের আড্ডায়, সেও ১৭ বছর বয়সে একা ঘুরতে বের হয়েছে। সে বলেছিল, তার জন্য সুবিধা হয়েছিল কারণ তার বাবাও একজন ভ্রমণকারী ছিল, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন মেয়ের মনের ভেতর কি চলছে। যদিও তার বাবাও তার সাথে আসতে চেয়েছিল, কিন্তু মেয়ে রাজি হয়নি। আমার খালাতো ভাই, যে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির জন্য অপেক্ষা করছে, সে যখন একা দুই ঘণ্টা দূরের তার শহর থেকে চট্টগ্রাম আসে, তাতেই সবার টেনশান শুরু হয়ে যায়, ঠিক মতো আসতে পারবে তো? সব ঠিকমতো সামলাতে পারবে তো? আমাদের অনেক অভিভাভক তাদের ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া মেয়েদেরও বাসা থেকে ইউনিভার্সিটি/ কলেজে আনানেয়া করে। বেশিরভাগের কথা, আমাদের দেশের পরিস্থিতি ভালো না। কিন্তু, তারা এইটা চিন্তা করে না, চুরিডাকাতিরাহাজানি সব দেশেই আছে। আমাদের সমস্যা হল আমরা সন্তানকে পরনির্ভরশীল করে তৈরি করি, ওদের মনের সাহস মেরে ফেলি। উৎসাহ দেবার পরিবর্তে, ভয় দেখাই। বাঙালি অভিভাবক কেবল একটা জিনিসই শেখায় তাদের সন্তানদের, বাঁচ আর মর ভালো রেজাল্ট করতে হবে, ভালো স্কুল কলেজে পড়তে হবে, কেন? ভালো শিক্ষার জন্য? না, ভালো রেজাল্ট বা ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ার সাথে শিক্ষা গ্রহণের কোন সম্পর্ক নেই। এই অভিভাকেরা চায় তাদের সন্তানেরা কাড়ি কাড়ি টাকা কামাবে, আর অভিভাবকেরা খুব গর্ব করে মানুষের কাছে তাদের সন্তানেরা কে কী করে সেই গল্প করে বেড়াবে। সন্তান আসলে কি চায় সেটি খুবই অবিবেচ্য বিষয়, সন্তান কীসে সুখি হবে সেটি সন্তানের চেয়ে অভিভাবকেরা বেশি বোঝেন। বাঙালি অভিভাবকের সন্তানদের মগজে চিন্তা ক্ষমতা বলে কিছু আছে, বেশিরভাগ অভিভাবকেরা বিশ্বাস করেন না, তাদের কাছে তাদের সন্তানেরা এমিবার মত মগজবিহীন এককোষী প্রাণী।

সে যাই হোক, ইয়ান্নিক, নিনা আর এলিনার সাথে পরিচয় হয়ে খুব ভালো লাগলো। আমাদের মধ্যকার বয়সের ফারাক কোনও দূরত্ব তৈরি করতে পারেনি। ওদেরকে সাথে নিয়ে ঘুরতে ভালোই লাগবে।

** এই ভ্রমণগল্প ২০১৭ সালের

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৪ হাজার মেট্রিক টন কাগজ দ্রুত বিক্রি করার নির্দেশ
পরবর্তী নিবন্ধরেত সমাধি