রেত সমাধি

আগুন পাখি থেকে

কাজী রুনু বিলকিস | শনিবার , ১১ জুন, ২০২২ at ৭:১২ পূর্বাহ্ণ

Tomb of Sand (রেত সমাধি) এবারে অর্থাৎ ২০২২ সালের সাহিত্যে মর্যাদাসম্পন্ন আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার জিতে নিল। লেখক এই উপমহাদেশেরই। ভারতের হিন্দি ভাষার লেখক। সম্ভবত হিন্দি সাহিত্যের কোনো উপন্যাসের এটিই প্রথম আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার অর্জন। গীতাঞ্জলি শ্রী ১৯৪৭ সালের দেশভাগের প্রেক্ষাপটে এক বয়স্কা নারীর মনস্তাত্ত্বিক চাপ নিয়ে লিখেছেন। যে নারী ৮০ বছর বয়সে এসেও তার ফেলে আসা কৈশোরের দেশভাগের যন্ত্রণার স্মৃতি বহন করেন। দেশটা ভাগ হয়েছিল ধর্মের দোহাই দিয়ে। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে। ১৯৪৭ সালে বৃটিশ শাসকেরা তাদের রাজত্বের পাততাড়ি গুটানোর আগে এই উপমহাদেশে যে বিষ ছড়িয়ে দিয়ে গেছে তা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। ধর্ম নিরপেক্ষ ভারতকে হিন্দুত্ববাদী সরকার এখন অসহিষ্ণু উগ্র সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। ভারতের বহু জাতির, বহু সম্প্রদায়ের উদার ধর্ম নিরপেক্ষ চেহারাটা এখন খুঁজে পাওয়া মুশকিল। মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা ছড়ানোর কাজটা রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে নিয়েছে বিজেপি সরকার। সেই পুরনো ক্ষত, সেই পুরনো কৌশল আমাদের দেশেও মাঝে মাঝে উসকে দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করা হয়। ক্ষতিটা বয়ে বেড়ায় খুব সাধারণ মানুষ! ভারত ভাগ হলো, বাংলা ভাগ হলো অসংখ্য মানুষ আজন্মের ভিটেমাটি ছেড়ে গেল নিজের নতুন দেশের খোঁজে। যে দেশকে তার নিজের দেশ জানতো সেই দেশ, সেই মাটি তার পর হয়ে গেল রাতারাতি!

বইটি পড়ার সুযোগ হয়নি। নিউজ ফিডে যেটুকু পড়েছি তাতে আমাদের হাসান আজিজুল হকের আগুন পাখির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। উপন্যাসের কথক বলছে, ‘কুন দোজখীরা দ্যাশ ভেঙেছে তাতে আমার কি? আমার মাটিটা ক্যানে কেড়ে লিবি? আমার পুকুর ঘাটটো,আমার বাগানটো ক্যানে লিবি? আমার চাঁদ সুরুজ ক্যানে লোকে কেড়ে লিবে?’ ভাঙাভাঙির নীলনকশায় যে হৃদয় ভেঙেছে তাতে আজও ক্ষরণ চলছে একান্তে, নিভৃতে। তাই আগুন পাখির কথক এক প্রান্তিক নারী তার সমগ্র অতীত নিয়ে তারই সংসার, সমাজ,ধর্ম ও দেশের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠে দাঁড়ায়। স্বাধীনতার বোল তোলে হিন্দু মুসলিমের মধ্যে যে ধর্মীয় বিভাজন তৈরি করে দেওয়া হয়েছে, যে উন্মাদনার সৃষ্টি করা হয়েছে তা নিদারুণ দুঃখে আগুন পাখির কথক প্রত্যক্ষ করেছেন। তার প্রতিবেশী হিন্দু মুসলমানেরা যারা প্রতিদিন পরস্পরের পাশে দাঁড়িয়েছে সবসময়, হয়েছে সুখে দুঃখের সাথী তারাই কীভাবে রামদা ছুরি নিয়ে লিপ্ত হচ্ছে মারামারিতে! ভারত দুই টুকরো হয়, বাংলা দুই টুকরো হয়! বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লেখায়,‘বাংলা হচ্ছে নদীর দেশ, প্রায় সব নদী ওপর থেকে নীচে নেমেছে, নদী তো কাটা যায় না, তবু কাটা হয়েছে এবং তাতেই বোঝা গেছে কেমন অবস্থা ছিল ঘটনাটা! ভাটি তো শুকিয়ে মরে উজানকে না পেলে, উজান তো প্লাবিত হবে ভাটিতে নামতে না পারলে, দশা হয়েছে সেরকমই। ভাটিরই কষ্ট বেশি। কারণ উজান পানি ছেড়ে দেয়, প্লাবনের কালে!’ আবারও ফিরে আসি আগুন পাখির কথকের কাছে ‘চারাগাছ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় লাগাইলে হয়। এক দ্যাশ থেকে আরেক দ্যাশে লাগাইলে বোধহয় হয়। কিন্তু গাছ বুড়িয়ে গেলে আর কিছুতেই ভিনমাটিতে বাঁচে না।’

গীতাঞ্জলি শ্রীর ‘রেত সমাধি’ ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ডেইসি রকওয়েল। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র কৈশোরের দেশভাগের সেই দগদগে স্মৃতি তিনি টেনে নিয়েছেন তার অবসাদগ্রস্ত জীবনকে উজ্জীবিত করার অভিপ্রায়ে। তাঁর উপন্যাসের মূল সুর মানুষ, ভালোবাসা ও দেশপ্রেম। বুকারের চেয়ার অব জাজেস ফ্রাঙ্ক ওয়াইন বলেছেন, ‘ক্ল্যালোডোস্কোপের কাচের মধ্য দিয়ে সম্পর্ক, বয়স, নারী,পুরুষ, পরিবার এবং সর্বোপরি একটি দেশ, একটি জাতিকে দেখানো হয়েছে। এই উপন্যাসে ভারত এবং দেশভাগের প্রেক্ষাপটে একটি জ্বলন্ত দলিল। আমি অকপটে স্বীকার করছি এমন উপন্যাস আগে কখনো পড়িনি।’ গীতাঞ্জলি শ্রীর জন্ম ১৯৫৭ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশে। বর্তমানে দেশটির রাজধানী নয়া দিল্লিতে বসবাস করছেন। বাবা ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। তাঁরই কাজের সূত্রে শৈশবের বড় একটা সময় কাটিয়েছেন উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন এলাকায়। নতুন দিল্লির লেডি শ্রীরাম কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আধুনিক ভারতীয় ইতিহাসের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন। বুকার পুরস্কারের আগেও তিনি কয়েকটি ভারতীয় পুরস্কার অর্জন করেন। তাঁর রেত সমাধি বিভাজনের সেই সময়টাকে একজন মা, একজন কন্যা নারীর চোখ দিয়ে দেখেছেন। যেমনটা দেখতে পাই আগুন পাখির কথকের কথায়, ‘আমাকে কেউ বুঝাইতে পারলানা, ক্যানে আলাদা একটি দেশ হয়েছে, এদেশটি আমার লয়?’

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্পাইসি রোড
পরবর্তী নিবন্ধলোহাগাড়ায় নারীসহ তিন ইয়াবা পাচারকারী আটক