সুবর্ণভূমিতে সুবর্ণের সাথে ভ্রমণ

শরণার্থী, নারীবাদ এবং একজন নারী ভ্রমণকারীর গল্প

রূপা দত্ত | শনিবার , ২৮ মে, ২০২২ at ৮:২৩ পূর্বাহ্ণ

চ্যাং মাই শহরে যাওয়ার আগে হাতিয়াই শহর ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। দেড় বছরে টুকিটাকি করে অনেক জিনিস হয়ে গেছে ঘরে। সেগুলোর বিলি-বন্টন করে, কেবল একটা ব্যাকপ্যাকে নিজের যাবতীয় জিনিস গুছিয়ে নেয়া অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। অন্তত একটা লাগেজ দেশে পাঠিয়ে দিতে পারলে আরাম করে নিজের মতো যতদিন ইচ্ছা ঘুরে বেড়াতে পারতাম। কুরিয়ারে করে পাঠালে অনেক খরচ, পোস্ট অফিসের মাধ্যমে পাঠানো যাবে কিনা ভাবছিলাম। কোন জায়গার পাট গুছানো অত সহজ নয়। মাথায় হাত বসে পড়ার মত যখন অবস্থা, বন্ধু সুবর্ণ জানালো অফিসের কাজে তাকে ব্যাংকক আসতে হবে। বন্ধুকে তখন এঞ্জেল মনে হতে লাগলো। ওর সময়ের সাথে মিলিয়ে আমার বাড়তি ব্যাগ প্যাঁটরা নিয়ে হাতিয়াই এর পাট চুকিয়ে রওনা হয়ে গেলাম ব্যাংকক। ব্যাংকক থেকেই চ্যাং মাই যেতে হবে। তাই সবদিক থেকেই ভাল হল।
সুবর্ণ উঠেছে কাছাকাছি আলাদা হোস্টেলে। দু’জনে মিলে ভাবছিলাম কোথায় যাওয়া যায়। সব ঘেঁটেঘুটে ঠিক করলাম ওয়াত ফো নামের বৌদ্ধ মন্দির দেখতে যাবো। আর ওইদিকেই কাছাকাছি রাজার বাড়ি, আরও মন্দির আছে। ২০১৭ সালের ব্যাংকক ছিল পর্যটকদের স্বর্গ। সব কিছু সস্তা, আবার সরকার পর্যটকদের জন্য অনেক সুযোগ সুবিধাও রেখেছে। এর মধ্যে অন্যতম হল ব্যাংককের নির্দিষ্ট কিছু জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখার জন্য বিনামূল্যের পর্যটকদের জন্য বাস। আমাদের হোস্টেলের কাছ থেকেই বাস পাওয়া যায়। আমরা সেই বাস ধরে গেলাম ওয়াত ফো দেখতে। মন্দিরের দেয়ালের, ভেতরের স্তম্ভের কারুকাজ দেখে মাথা ঘুরে যাবার অবস্থা। এত নিখুঁত করে কীভাবে এত বিশাল কাজ করা সম্ভব! মাটি থেকে আকাশে মাথা উঠা নামা করে দেখতে দেখতে ঘাড় ধরে গেলেও মন চাইল আরও দেখতে। এ মন্দির ও মন্দির করে আশেপাশের বেশ কয়েকটি মন্দির ঘুরলাম আমরা। সুবর্ণ না এলে ব্যাংককের এই দিকে হয়ত আসাই হত না। সন্ধ্যার মুখে ফিরে এসে জমিয়ে আড্ডা দিলাম। এর মাঝে আমার হোস্টেলের সাথে কথা বলে পরের দিনের একটা ভ্রমণ প্যাকেজ ঠিক করে নিলাম আমরা। সারাদিনের প্যাকেজে আমরা যাবো অযোধ্যা। নামটা শুনে আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। অযোধ্যা বলতে আমি জানি রামায়নে বর্ণিত ভারতবর্ষের সেই অযোধ্যাকে। সেই অযোধ্যা যেখানকার বাবরী মসজিদকে ঘিরে ভারতের মুসলিমদের আর বাংলাদেশের হিন্দুদের হারাতে হয়েছিল নিজ দেশে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। তাই ব্যাংককের কাছাকাছি অযোধ্যার কথা শুনে বেশ অভাব হয়েছিলাম। পরে গুগল জানিয়েছিল, ভারতের অযোধ্যার নামেই থাইল্যান্ডের অযোধ্যার নামকরণ করা হয়েছিল। থাইল্যান্ডের নাম যখন থাইল্যান্ড ছিল না, ছিল সিয়াম, তখন এই অয্যোধ্যাকে গড়ে তোলা হয়। ইউ থং নামের সিয়ামের রাজা রাজধানী থেকে পক্সের ভয়ে চলে আসেন অযোধ্যায়। একে তখন দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে গণ্য করা হত। আমার এক থাই সহকর্মীর কাছে শুনেছিলাম বার্মার এক রাজা প্রায় তিনশ বছর আগে অযোধ্যা দখল করে নিয়েছিল। তখন বার্মা আজকের মত দরিদ্র দেশ ছিল না। এই অঞ্চলের পরাক্রমশালী দেশগুলোর একটি ছিল। এই অযোধ্যা নিয়ে বার্মা আর থাইল্যান্ডের মানে সিয়ামের রাজাদের মাঝে বেশ সংঘাত হয়েছিল।
ট্যুর কোম্পানির গাড়ি করে চলে গেলাম সেই বিখ্যাত অযোধ্যা দেখতে যেটি ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। পুরাতন সব মন্দিরের ভগ্নাবশেষ টিকে আছে। বট গাছের শেকড়ে আটকে থাকা বুদ্ধের বিখ্যাত মস্তক দেখলাম। ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে মনে হল, সবকিছুই নশ্বর এই পৃথিবীতে। আমরা বোকা মানুষ কেবল শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই করি, দু’দিনের জীবন নিয়ে মেতে থাকি হিংসা আর যুদ্ধ বিদ্রোহে। বট গাছের শেকড়ে আটকে পরা বুদ্ধ দেখে বুকের ভেতর মুচড়ে উঠলো, এমন জটিল মোহের শেকড়ে আটকে আছি আমরা, মানুষেরা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রার্থনা
পরবর্তী নিবন্ধসিডও (CEDAW ) সনদের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সময়ের দাবি