সিডও (CEDAW ) সনদের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সময়ের দাবি

জান্নাতুল ফেরদৌস | শনিবার , ২৮ মে, ২০২২ at ৮:৩২ পূর্বাহ্ণ

‘নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও)’ ইংরেজিতে যা ‌‌‌‌‌‌Convention on the Elimination of All forms of Discrimination against Women”(CEDAW) নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়। ১৯৮১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর থেকে সনদটি কার্যকর হতে শুরু করে। এ পর্যন্ত ১৮৫ টিরও বেশি দেশ সিডও সনদ গ্রহণ করেছে। এদের মধ্যে প্রায় ১৬০ টি দেশ সিডও সনদের ধারাগুলো তাদের জাতীয় সংবিধান ও আইনে যুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে। এই স্বাক্ষরকারী দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। সিডও সনদে মোট ত্রিশটি ধারা আছে। এই সনদের মূল বিষয় হচ্ছে, নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ বা দূরীকরণ। যেখানে রাজনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক সব ক্ষেত্রে নারীর মানবাধিকার নিশ্চিত করার বিষয়টি স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। এটি আইনগত ভিত্তি নিয়ে একটি কনভেনশন আকারে রূপ লাভ করেছে। এ সনদটি মূলত তিনটি প্রেক্ষিত থেকে সমস্যা সমাধানের নির্দেশ দেয়। এই তিনটি মৌলিক নীতি হল:
ক. নারীর নাগরিক অধিকার ও আইনি সমতা নিশ্চিতকরণ, যার মাধ্যমে নারী গণজীবনে ও সমাজে পুরুষের সমপর্যায়ে সব সুবিধা ভোগ করতে পারবেন।
খ. নারীর প্রজনন ভূমিকাকে সামাজিক ভূমিকা হিসেবে গণ্য করা, যাতে প্রজননের কারণে নারীকে কোণঠাসা না করে এ ক্ষেত্রে নারীর অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া।
গ. আচার-প্রথা, সংস্কার ও বিধি যা নারীর জেন্ডার ভূমিকা নির্ধারণ করে, তা বাতিল করা। পরিবার ও সমাজে শুধু ‘মানুষ’ হিসেবে নারীকে গণ্য করা এবং পুরুষের ক্ষমতা ভিত্তিতে তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।
সিডও নয়টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংক্রান্ত সনদের মধ্যে অন্যতম। এই সনদ জাতিসংঘ কর্তৃক অনুমোদিত। তাই বাস্তবায়নের সব দায়-দায়িত্ব হলো অনুমোদনকারী সকল রাষ্ট্র বা সরকারের। আর তাতে সহায়ক হিসেবে ভূমিকা রাখবে দেশের জনগণ, সুশীল সমাজ, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংগঠন। এই সনদে রাষ্ট্রীয় মূল দায়-দায়িত্বগুলো সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। দায়-দায়িত্বের মধ্যে রাষ্ট্র কর্তৃক নারীর প্রতি বৈষম্যহীনতার নীতি রাষ্ট্রীয় সংবিধানে ঘোষণা করা। এখানে উল্লেখ্য যে বাংলাদেশ উনিশশ ছিয়ানব্বই সাল পর্যন্ত এই সনদের ত্রিশটি ধারার চারটি ধারা সংরক্ষিত রাখে। ক্রমাগত নারী আন্দোলন ও মানবাধিকার আন্দোলনের ফলে বাংলাদেশ সরকার ছিয়ানব্বই সাল সিডও সনদের ধারা ১৩ (ক) এবং ১৬-১(চ)-এর সংরক্ষণ প্রত্যাহার করে নেয়। কিন্তু সিডও সনদের আরো দু্‌ইটি ধারা যথাক্রমে ধারা ২ এবং ধারা ১৬-১ (গ)-এ এখনও সংরক্ষণ প্রত্যাহার করেনি।
গত এক দশকে বাংলাদেশে নারী উন্নয়নের বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সূচকে অভাবনীয় উত্তরণ ঘটেছে এ-কথা অনস্বীকার্য। এর জন্য দেশের সুশীল সমাজ, সরকারি-বেসরকারি সংস্থাসহ সরকারের ভূমিকা প্রশংসনীয়। তবুও সিডও সনদের যে অধিকাংশ ধারাসমূহ সরকার অনুমোদন করেছে সেগুলোর বাস্তবায়নও খুব দুর্বল। সিডও কমিটি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নারী-পুরুষের বৈষম্য নিরসন ও নারী নির্যাতন বন্ধ করার লক্ষ্যে গৃহীত ইতিবাচক আইন-নীতিমালা এবং কার্যক্রমের প্রশংসা করার পাশাপাশি সঠিক বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে উদ্বেগও প্রকাশ করে যাচ্ছে। এই প্রসঙ্গে সিডও সনদের দুইটি ধারার ২ নং এবং ১৬-১(গ) সরকারের সংরক্ষণে বড় রকমের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। উল্লেখ্য সনদের ২ নং ধারাটিকে বলা হয় এই সনদের প্রাণ। যে ধারায় নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক রীতিনীতি, প্রথা, আচার-ব্যবহার, নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং বৈষম্য বিলোপ করে নারী-পুরুষের মধ্যে সমতার নীতিমালা গ্রহণের উপর জোর দেয়া হয়েছে এবং ধারা ১৬-১(গ)-এ বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান অবস্থা ও বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের একই অধিকার থাকবে বলা হয়েছে। দুশ্চিন্তার বিষয়, বাংলাদেশ সরকার এই দুইটি ধারা সংরক্ষণ প্রত্যাহারের স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারছে না। প্রাসঙ্গিকভাবেই উল্লেখ্য যে জর্ডান, কুয়েত, লেবানন, মালদ্বীপ, ওমান, সিরিয়া, তিউনিসিয়া, তুরস্কসহ অনেক মুসলিম দেশই ২ নং ধারায় কোনো আপত্তি না রেখেই সিডও সনদ অনুমোদন করেছে। তাছাড়া বাংলাদেশের সংবিধানের ১০, ১৯, ২৭, ২৮ ও ২৯ ধারায় জীবনের সকল ক্ষেত্রে ও নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠার বিষয়টি নারীর মানবাধিকার হিসেবেই স্বীকৃত হয়েছে। নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সমাজ এবং রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সিডও সনদ সংরক্ষণ প্রত্যাহার এবং অনুমোদন আজ সময়ের দাবী। আমরা চাই ধারা দুটির শর্তাবলী প্রয়োগে বাংলাদেশ তার সংবিধান ও প্রচলিত আইনের বিধানবলির সঙ্গে সামঞ্জস্য ঘটাবে। বাংলাদেশের নারী সমাজ এবং সচেতন নাগরিকগণ উদ্বেগের সঙ্গে অপক্ষায় রয়েছে কখন সিডও সনদ পূর্ণাঙ্গভাবে গৃহীত হবে এবং বিদ্যমান বৈষম্যমূলক ব্যবধান ঘুচাবে।
তথ্যসূত্র:
* উইকিপিডিয়া/সিডও
* CEDAW Convention Article

পূর্ববর্তী নিবন্ধসুবর্ণভূমিতে সুবর্ণের সাথে ভ্রমণ
পরবর্তী নিবন্ধসীমান্ত আছে দুই দেশের মাঝে, জনগণের মাঝে নয়