সাম্যবাদের কবি নজরুল

সুবর্ণা দাশ মুনমুন | সোমবার , ২৩ মে, ২০২২ at ৬:০৮ পূর্বাহ্ণ

মাত্র দুই দশকের ব্যবধানে দু দু‘টি মহাযুদ্ধের অবসানে যুদ্ধোত্তর সময়ের হতাশা, অবক্ষয় এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যেই বাংলা সাহিত্যে আবির্ভাব ঘটে কাজী নজরুল ইসলামের। যুদ্ধোত্তোর বিরূপ পরিবেশে দাঁড়িয়েও তিনি গেয়েছেন জীবনের জয়গান।

মাত্র ২৩ বৎসরের সাহিত্যিক জীবনে তাঁর সৃষ্টির সম্ভার তুলনা রহিত। ঔপোনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে শৃঙ্খল ভাঙার সাহস যুগিয়ে অমঙ্গল, অকল্যাণ আর অসত্যের রাহু গ্রাস থেকে মুক্তির জয়গান গেয়েছেন। মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও, শৈশবে ইসলামী শিক্ষায় দীক্ষিত হয়েও তিনি বেড়ে উঠেছিলেন এক ধর্মনিরপেক্ষ সত্তা নিয়ে। একই সাথে তাঁর মধ্যে বিকশিত হয়েছিল বিদ্রোহী সত্তাটিও। তাইতো তিনি লিখলেন-

‘আমি ভৃগু, বুকে এঁকে দিয়ে পদচিহ্ন
আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব বিদীর্ণ’।

১৮ মার্চ ১৯২৮ অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনকে এক চিঠিতে কাজী নজরুল ইসলাম লিখলেন, ‘দৈনিক বসুমতী’তে কয়েকদিন আগে একটা বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল যে, কোন এক ব্রাহ্মণ ভদ্রলোক মৃত্যু শয্যায় শায়িত, কোন সুস্থ যুবকের রক্ত পেলে তিনি বাঁচতে পারেন। তিনি কলকাতাতে থাকেন। আমি রাজী হয়েছি রক্ত দিতে। আজ ডাক্তার পরীক্ষা করবে আমায়, আমার দেহ থেকে রক্ত নিয়ে ওর দেহে দেবে। ভয়ের কিছু নেই এতে, তবে দু’চার দিন শুয়ে থাকতে হবে মাত্র। এক্ষুণি বেরুব ডাক্তারের কাছে।

এর তেরোদিন পর ৩১ মার্চ ১৯২৮ ইং তারিখে কাজী মোতাহার হোসেনকে আবার লিখলেন, ‘রক্ত দান করিনি…। ব্রাহ্মণ ভদ্রলোক মুসলমানের রক্ত নিতে রাজী হলেন না। হায়রে মানুষ, হায় তার ধর্ম ! কিন্তু কোন হিন্দু যুবক আজ পর্যন্ত রক্ত দিলোনা। লোকটা মরছে…. তবুও নেবে না ‘নেড়ে’র রক্ত।’
তিনি ১৯৩০ সালে জাত জালিয়াত শিরোনামে লিখলেনঃ

‘দিনকানা সব দেখিতে পাসনে, দণ্ডে দণ্ডে পলে পলে
কেমন করে পিষছে তোমায় পিশাচ জাতির যাতাকলে
(তোরা) জাতের চাপে মারলি জাতি, সূয্য ত্যাজি নিলি রাতি
ওরে মূর্খ ওরে জড় / শাস্ত্র চেয়ে সত্য বড়’।

বস্তুত মানুষকে, মানুষের ধর্মকে নজরুল বড় করে দেখেছেন আজীবন। তিনি চেয়েছেন মানুষের কল্যাণ, সমাজের মঙ্গল এবং স্বদেশের স্বাধীনতা।
তাইতো তিনি লিখলেন-

‘অবতার পয়গম্বর কেউ বলেননি আমি হিন্দুর জন্যে এসেছি, আমি মুসলমানের জন্যে এসেছি,আমি খ্রিস্টানের জন্যে এসেছি। তারা বলেছেন আমরা মানুষের জন্যে এসেছি- আলোর মত সকলের জন্যে। তিনি জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সকল মানুষকে ভালোবাসতেন। তাই যখন খণ্ডিতভাবে তাকে কোন ধর্মের সেবক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, তখন তাঁর কবি সত্ত্বাকে অপমান করা হয়।

বাংলা সঙ্গীতের প্রায় সবকটি ধারার পরিপুষ্টি সাধন করে বাণী ও সুরের বৈচিত্রে নজরুল বাংলা গানকে যথার্থ আধুনিক সঙ্গীতে রূপান্তর করেন। মানুষের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসার প্রতিফলন হিসেবে চরম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়েও লিখেছেন শ্যামাসঙ্গীত, রামপ্রসাদী, লিখেছেন গজল, হামদ, নাত, ব্যাখ্যা দিয়েছেন তৌহিদের একেশ্বরবাদের। মানবতার মুক্তিই ছিল নজরুলের সাধনার বিষয়বস্তু। ধর্মীয় কুসংস্কারকে তিনি অতিক্রম করেছেন মানবিকতার শক্তি দিয়ে।

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘বিদ্রোহী’ কবি নামে খ্যাত এই কবির ব্যতিক্রমধর্মী কবিতার জন্যই ত্রিশোত্তর আধুনিক কবিতার সৃষ্টি সহজ হয়েছিল। নজরুল সাহিত্য এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অবিভক্ত বাংলায় পরাধীনতা, সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, মৌলবাদ এবং দেশী বিদেশী শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। এ কারণে ইংরেজ সরকার তাঁর কয়েকটি বই এবং পত্রিকাও নিষিদ্ধ করে এবং তাঁকে কারাদণ্ডেও দণ্ডিত করে। নজরুলও আদালতে লিখিত রাজবন্দীর জবানবন্দী দিয়ে, টানা চল্লিশ দিন অনশন করে, ইংরেজ সরকারের জুলুমের প্রতিবাদ জানিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। ১৯২২ সালে তাঁর বিদ্রোহী কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার পর সমগ্র ভারতে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পরে। বিদ্রোহী কবিতাটিতে একদিকে যেমন কবি মানসের দ্রোহের রূপটি ফুটে উঠেছে, অন্যদিকে পরিস্ফুট হয়েছে কবির সরল-মানবিক রূপটিও। তাইতো বিদ্রোহী কবিতায় কবি নির্দ্বিধায় বলতে পারেন-

“আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন- শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশীর!
আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির-গৃহহারা যত পথিকের,
আমি অবমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা, প্রিয়-লাঞ্চিত বুকে গতি ফের’!

৫ এপ্রিল, ১৯৪১ কলকাতার মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির রজতজয়ন্তী উৎসবের সভাপতির ভাষণে তিনি বলেছিলেন- ‘আমি নেতা হতে আসিনি, আমি কবি হতে আসিনি, আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম নিতে এসেছিলাম। সে প্রেম পেলাম না বলে এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের মত বিদায় নিলাম’।

ঔপোনিবেশিক শোষণ- বঞ্চনার বিরুদ্ধবাদী কবি, সাম্যের কবি ১৯৪২ সাল থেকে দীর্ঘ ৩৪ বৎসর ধরে এক অসহনীয়, নির্বাক জীবনকাল অতিবাহিত করার পর ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আমাদের প্রেমের কবি, দ্রোহের কবিকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা।

লেখক : প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বস্তিহীনে স্বস্তি হারাই
পরবর্তী নিবন্ধবাঙালি জাতীয়তাবাদের টর্চ বেয়ারার আবদুল গাফফার চৌধুরী