বাঙালি জাতীয়তাবাদের টর্চ বেয়ারার আবদুল গাফফার চৌধুরী

কুমার প্রীতীশ বল | সোমবার , ২৩ মে, ২০২২ at ৬:০৯ পূর্বাহ্ণ

অবশেষে কিংবদন্তি সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরীও চলে গেলেন। তাঁকে প্রথম দেখেছিলাম চট্টগ্রামের মুসলিম হলে। একজন সাংবাদিকের কথা শুনতে এতো মানুষের আগমন এর আগে কখনও দেখিনি, আজ অবধিও দেখিনি। আবদুল গাফফার চৌধুরী ছিলেন একমাত্র বক্তা। জননেতা মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন সভাপতি। তিল ধারণের জায়গা ছিল না। ঘন্টা খানেক বা আরও বেশি সময় তিনি বক্তৃতা করেছিলেন। মানুষ মুগ্ধ হয়ে শুনেছিল তাঁর কথা। কী অদ্ভুদ মোহিনী শক্তি ছিল তাঁর কথায়! শক্তিও ছিল। ছিল আগুণ। আবদুল গাফফার চৌধুরী লেখাতে যেমন আগুন ঝড়াতেন, ঠিক তেমনি কথাতেও। এখনও মনে আছে, ভাঙা ভাঙা স্বরে কথা বলে কী অদ্ভুদ শিহরণ জাগিয়ে তুলেছিলেন শরীরে। তখন ছিল শেখ হাসিনার সরকারের প্রথম মেয়াদ। এরপর আরও একবার তিনি এসেছিলেন। সে বার তাঁকে দেখেছি ঢাকাতে। তখন আমার কর্মক্ষেত্র ছিল প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র নামে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। এ সংস্থার পরিচালক প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুর বর ছিলেন আবদুল গাফফার চৌধুরীর একই গ্রামের বাসিন্দা এবং প্রশিকার উপদেষ্টা সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের বন্ধু। সে সূত্রে তিনি প্রশিকার অতিথি হয়েছিলেন। তখনও তাঁর কথা শুনেছি মন্ত্র মুগ্ধের মতো।

আবদুল গাফফার চৌধুরীর কথায় আগুণ ছিল। আগুণ ছিল কলমে। নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময়ে সাপ্তাহিক যায় যায় দিন পত্রিকার তৃতীয় মত কলামের মাধ্যমে আমাদের প্রজন্ম প্রথম তাঁর আগুনমুখা কলমের মুখোমুখি হয়। সপ্তান্তে মুখিয়ে থাকতাম পত্রিকাটির জন্য। তৃতীয় মত কলাম পড়ে উজ্জীবিত হতাম। কোনো সাংবাদিকের কলাম এতো জনপ্রিয় হতে আজ অবধি দেখিনি। একটা সময় তাঁর লেখা বাংলাদেশের অনেক পত্রিকা পুণর্মুদ্রিত হতেও দেখেছি। একই লেখা এক সপ্তাহে একাধিক পত্রিকা ছাপিয়েছে। এগুলোতে জনপ্রিয়তার মাপকাঠি বিবেচনা করলে তাঁর কাছাকাছি দ্বিতীয় কেউ ছিল না। অনেকটা হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের মতো। একজনের মাত্র কলামিস্টের কারণে পত্রিকার কাটতি বেড়ে যেতে আবদুল গাফফার চৌধুরীর ক্ষেত্রে একমাত্র দেখেছি।

আবদুল গাফফার চৌধুরী ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের টর্চ বেয়ারার। তিনি এ কারণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রিয় ছিলেন। আবদুল গাফফার চৌধুরী এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চিন্তাগত ঐক্যমত ছিল। এই সত্যতা প্রমাণের জন্য স্বাধীনতার রজত জয়ন্তী বর্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিজয় দিবস উদযাপন কমিটি যে স্মারক গ্রন্থ প্রকাশ করে, এখানে বাংলাদেশের বিজয় দিবসের কথা লিখতে গিয়ে যে কথা লিখেছেন, তার কিছু অংশ পাঠকের উদ্দেশ্যে নিবেদন করছি। আবদুল গাফফার চৌধুরী’র লেখার শিরোনাম ছিল-‘বিজয় দিবসের ট্রি অব লিবার্টি কেন দেশপ্রেমিকের রক্তে রঞ্জিত’। এখানে তিনি লিখেছেন- ‘জাতির পিতা জাতির জীবনের একান্ত প্রয়োজনটি সঠিক সময়েই বুঝেছিলেন। বাঙালিরা মিশ্র ধর্ম, মিশ্র বর্ণ, মিশ্র সংস্কৃতির একটি জাতি। আমেরিকানদের মতো তাদের এক সূত্রে বেঁধে রাখার জন্য একটি সিভিল রিলিজিয়ন প্রয়োজন। অতীতেও বাঙালি জাতিসত্তার জন্য এই সিভিল রিলিজিয়নের প্রয়োজনেই সুফিবাদ, বৈষ্ণববাদের অভ্যুদয়। এ যুগে শেখ মুজিব আমেরিকার জেফারসনের মতো বাঙালির ঐক্যবিধায়ক একটি সিভিল রিলিজিয়ন সাংবিধানিকভাবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন। জেফারসন যেমন আমেরিকানদের সিভিল রিলিজিয়নদের তিনটি মূলমন্ত্র দিয়েছিলেন, লিবার্টি, ন্যাশালিজম এবং ফেইথ; তেমনি শেখ মুজিবও বাঙালিকে দিয়েছিলেন মূলত তিনটি মূলমন্ত্র ডেমোক্রাসি, ন্যাশনালিজম এবং সেক্যুলারিজম। এই তিনটি মূলমন্ত্রের ভিত্তিতে তৈরি সিভিল রিলিজিয়ন যদি বাঙালির জীবনে প্রতিষ্ঠা করা যায়, তার পরিচয় ও ঐক্য নিশ্চিত হয়। ফলে তার স্বাধীনতা ও সমৃদ্ধিও স্থিতিশীল না হয়ে পারে না। ব্যক্তি জীবনের ব্যক্তিধর্মের বা ধর্মাচরণের তাতে কোনো ক্ষতি হয় না।’ তাঁর এমন পর্যবেক্ষণ আজও ভাবনার দাবি রাখে এবং বাস্তবায়নযোগ্য।

আমার এক অগ্রজ কলাম লেখক বন্ধু আবদুল গাফফার চৌধুরীকে বলেছিলেন, আপনি বড্ড বেশি মাত্রায় আওয়ামীলীগার। তার উত্তরে আবদুল গাফফার চৌধুরী হেসে বলেছিলেন, ‘ তোমরা কমিউনিস্টরা যদি সঠিক পথে থাকতে, তাহলে আমি কমিউনিস্টই হতাম।’ উল্লেখ্য আমার সেই অগ্রজ কলাম লেখক বন্ধু ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। আমৃত্যু আবদুল গাফফার চৌধুরী ‘বাংলাদেশে তিনি আওয়ামী লীগপন্থী কলামিস্ট হিসাবে পরিচিত এবং সমালোচিত’ হয়েছেন। অনেকে বলেছেন, তিনি ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ প্রচারক হিসাবে তিনি রাজনৈতিক বিষয়াবলী ব্যাখ্যা’ করছেন। উত্তরা পূর্বাচলে প্লট পাওয়ার জন্য, কিংবা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফর সঙ্গী কিংবা বিদেশের দূতাবাসে প্রেস মিনিস্টার হওয়ার জন্যে আবদুল গাফফার চৌধুরী এসব করেননি। তিনি একটি বিশেষ লক্ষ্য অর্জনের জন্য এ কাজ করেছেন। তাঁর সেই লক্ষ্য হলো ‘একটি সিভিল রিলিজিয়ন’ তৈরি করা। গাফফার চৌধুরী তাঁর এ কাজে যাকে যখন সাথী হিসাবে পেয়েছেন তাকেই বুকে ঠাঁয় দিয়েছেন কিংবা সেই বাহনে নিজেই আরোহী হয়েছেন। এ কারণে বাঙালির মানস গঠনের কাজে বঙ্গবন্ধু বিহীন আওয়ামীলীগকে যখনই লক্ষ্যচ্যুত হতে দেখেছেন, তখনই আবদুল গাফফার চৌধুরীকে আওয়ামীলীগের নীতি বা পদক্ষেপের বিরুদ্ধেও কলম ধরেছেন। বঙ্গবন্ধুর দর্শন প্রচারে এমন সিদ্ধহস্ত পুরুষ খুব কমই ছিলেন। কথা ছিল বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীর অনুলেখক হবেন। স্ত্রী চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার আগ পর্যন্ত কিছুদিন দুপুরবেলা গণভবনে বসে বসে নোট নেওয়ার কাজটি শুরুও করেছিলেন। তখন তিনি বঙ্গবন্ধুর অনেক স্বপ্ন ও ভাবনার সঙ্গে পরিচিত হন, যা পরবর্তীকালে আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলা এবং বাঙালির ইতিহাস ছিল ত্রিকালদর্শী সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরীর নখদর্পনে। ইতিহাসের দিনক্ষণ উল্লেখ করে ঘটনার চরিত্রগুলোকে কেমন জানি জীবন্ত করে তুলতেন। আবার সে চরিত্রের সঙ্গে সাযুহ্যপূর্ণ চরিত্রকে মিলিয়ে ঘটনার পরিণিতি বিশ্লেষণ করতেন স্বকীয় বৈশিষ্ঠ্যে। তাঁর লেখার উপস্থাপনা শৈলী ছিল প্রাণঞ্জল এবং নিজস্ব একটি স্টাইলও ছিল। তাঁর লেখনী শৈলীর কারণে মনে হতো, প্রতিটি ঘটনার তিনি প্রত্যক্ষ সাক্ষী। সাত দশকের সাংবাদিকতা জীবনের কোনো কোনো ঘটনার সাক্ষী যে ছিলেন না। এমনও নয়। ইতিহাসের অনেক বাঁক বদলের সাক্ষী যে ছিলেন, তা তিনি অকপটে স্বীকারও করেছেন বন্ধু সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের কাছে।

আমাদের সমকালে ‘একটি সিভিল রিলিজিয়ন’ গঠনের কাজে অগ্রসৈনিক ছিলেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। কিন্তু এ জনপদে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটিয়ে ‘একটি সিভিল রিলিজিয়ন’ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা মোটেই সহজ ছিল না। এই কাজটি করতে গিয়ে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছেন। আবদুল গাফফার চৌধুরী সবই দেখেছেন, জানতেন। তাই তিনি বাঙালির জাতীয়তাবাদী মানস গঠনের সচেষ্ট ছিলেন। ৭৫ পরবর্তী ‘বাঙালি না বাংলাদেশী’ বিতর্কে বাংলাদেশী পক্ষের সাম্প্রদায়িক মুখোশ উন্মোচনে আবদুল গাফফার চৌধুরীর কলম সচল ছিল। একাজে বিচ্যুতি দেখলে আওয়ামীলীগকেও ছেড়ে কথা বলেননি।

১৯০৫ সালে অনুষ্ঠিত বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন প্রথম জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ইতিহাসে পরিচিতি লাভ করেছে। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেপথ্য চেতনা হিসাবে কাজ করেছিল বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনা। আবদুল গাফফার চৌধুরীর জন্মের চার বছর আগে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ হয়ে গেছে। পন্ডিতরা বলে গেছেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রায় চার হাজার বছরের প্রাচীন। এসব কিছু আবদুল গাফফার চৌধুরীর মানস গঠনে ভূমিকা রেখেছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশে বাহান্নের ভাষা আন্দোলনের যে অবিসংবাদিত ভূমিকা রয়েছে, সে আন্দোলনের একজন লড়াকু সৈনিক ছিলেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে বিকশিত জাতীয়তাবাদী চেতনায় শাণিত হয়ে সেদিন তিনি ১৯৫২ সালের ২৩ ফ্রেব্রুয়ারি ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফ্রেবুয়ারী আমি কি ভুলিতে পারি’র মতো কালজয়ী গানের মাধ্যমে আগুন ঝড়িয়েছিলেন।

আবদুল গাফফার চৌধুরী কিন্তু ধর্মীয় পশ্চাৎপদতার কারণে সরল রৈখিকভাবে এগুতে পারেননি। তাঁর বিরুদ্ধেও কুপমন্ডুকেরা ফতোয়া দিয়েছে। ধর্মীয় পশ্চাৎপদতা থেকে এ জনপদের মানুষকে বের করে আনা সম্ভব হয়নি। আবদুল গাফফার চৌধুরী শত প্রচেষ্টার পরও বাঙালি জাতীয়তাবাদের ‘টচ বেয়ারের’ সংখ্যা অসংখ্য করতে পারেননি। সাম্প্রদায়িকতা থেকে বাঙালি জাতির আজও উত্তোরণ ঘটেনি। এসব বেদনাহত ইতিহাস আজ আবদুল গাফফার চৌধুরীর মহাপ্রয়াণ তর্পনে আরও বেশি করে মনে পড়ে। তাই মৃত্যু অনিবার্য জানার পরও বেদনাহত হয়ে উঠি। বুদ্ধদেব বসু যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিণত বয়সে মৃত্যুর পরও যেমন বলেছিলেন, ঠিক তেমনি বলতে ইচ্ছে করে, বড় অসময়ে চলে গেলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের টর্চ বেয়ারার ছিলেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। কারণ পশ্চাৎপদ চেতনা থেকে বাঙালি জাতিকে বের করে আনার মতো সঠিক অর্থে অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের সংখ্যা ক্রমেই ফুরিয়ে যাচ্ছে। আমাদের টর্চ বেয়ারারগুলো একে একে ফুরিয়ে যাচ্ছে সব।

আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, একদিন আবদুল গাফফার চৌধুরীর স্বপ্ন পূরণ হবে। একটি সিভিল রিলিজিয়ন তৈরি হবে। যদি আমাদের স্বদেশের স্বপ্ন লুঠ হয়ে যায়, আবদুল গাফফার চৌধুরীর কলম আবার জেগে উঠবে। যেমন রংপুরে নুরলউদ্দীন জেগে উঠেছিল, বাংলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সে প্রত্যাশায়, আজ গুডবাই বাঙালি জাতীয়তাবাদের টর্চ বেয়ারার আবদুল গাফফার চৌধুরী।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার

পূর্ববর্তী নিবন্ধসাম্যবাদের কবি নজরুল
পরবর্তী নিবন্ধ১৯৩৭ থেকে এ পর্যন্ত জাতির ১৭টি সাধারণ নির্বাচন : একটি পর্যবেক্ষণ