শিশুর কোলাহল

নাসের রহমান | বুধবার , ৪ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৬:৪৮ পূর্বাহ্ণ

ছোটো-ছোটো ছেলেমেয়েরা বিকেলে ছাদে খেলা করে। ফ্ল্যাটের ছাদটা বেশ বড়ো। ছোটরা ফুটবল নিয়ে ছুটাছুটি করে। দুপাশে ইট দিয়ে গোলের সীমানা বসায়। ছেলে-মেয়ে উভয়ে একসাথে খেলে। দুভাগ হয়ে খেলা শুরু করে। খেলতে খেলতে কখনো গোল হয়ে যায়। তখন তাদের আনন্দের সীমা থাকে না। আবার কখনো ক্রিকেটও খেলে। ছাদের চারপাশের রেলিং খানিকটা উঁচু। তাই বল সহজে বাইরে যায় না। এখনো তাদের হাতের পায়ের জোর তেমন বেশি হয়নি, বল যে বাইরে চলে যেতে পারে। তবু মাঝেমধ্যে চলে যায়। তখন বল খেলা ছেড়ে সাইকেল চালাতে শুরু করে। তবে বল খেলা শেষ করেও সাইকেল চালায়। ছোটো-ছোটো সাইকেল, ছাদের একপাশে গেইটের কাছে থেকে যায়। তারা সাইকেল নিয়ে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলে। শেষসীমায় গিয়ে গতি শ্লথ করে মোড় ঘুরে ফিরে আসে। কেউ কেউ দ্রুতগতিতে চলার সময় হঠাৎ ব্রেক করে থেমে যায়। যেন সাইকেলটা মুহূর্তের জন্য স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। এতেও তারা একধরনের আনন্দ পায়। কারো কারো মা আশেপাশে থাকে। এসময়টা তারাও ছাদে এসে কাটায়।

খেলার সময় ছেলেমেয়েদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি হয়, কথা কাটাকাটি হয়। গোল হয়েছে কি না তা নিয়ে তর্কাতর্কি হয়। কিছুক্ষণের জন্য খেলাও বন্ধ হয়ে যায়। একজন আরেকজনকে বলে, ‘খেলতে এসে ঝগড়া করছো কেন?’ তখন দুপক্ষের বিবাদ থেমে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে খেলা আবার শুরু হয়। গোল করার জন্য বল নিয়ে ছুটে চলে। কেউ কেউ নিয়মকানুন মানতে চায় না। বল পেলেই ছুঁড়ে মারে। অনেকে আবার খেলার এসব নিয়ম বুঝে উঠতে পারে না। পায়ে-পায়ে বল ছুঁড়ে মারতে পারলে আনন্দ পায়। গোল দিতে পারলে কথাই নেই। ‘গোল, গোল’ করে চিল্লিয়ে ওঠে। মায়েরা তখন ছেলেমেয়ের দিকে তাকায়। সন্তানের আনন্দ উল্লাসে তারাও উৎফুল্ল হয়। তবে খেলায় কখনো মাথা ঘামায় না। ঝগড়াঝাটি করলেও না-শোনার মতো হয়ে থাকে। এতে ছেলেমেয়েরা নিজেদের মতো করে খেলা করতে পারে।

খেলতে খেলতে সন্ধ্যা নেমে আসে। আটতলা ফ্ল্যাটটির ছাদ থেকে আকাশটা ভালো করে দেখা যায়। পড়ন্ত বিকেলের সূর্যের আলো ছেলেমেয়েদের চোখেমুখে এসে পড়ে, নানা রঙের খেলায় মেতে ওঠে। মাঝে-মাঝে সাঁঝের আকাশটা অপূর্ব সুন্দর দেখায়। পশ্চিম-আকাশে রক্তিম আভা ছড়িয়ে সবার মনটাকে রাঙিয়ে দিয়ে যায়। শিশুরাও রঙিন এ সময়টাতে খুব উৎফুল্ল থাকে। ছাদের এপাশ থেকে ওপাশে ছুটাছুটি করে। ছুটতে ছুটতে পড়ে গিয়েও কান্না করে না। তাড়াতাড়ি উঠে আবার দৌড়াতে শুরু করে। খেলাধুলা, সাইকেল চালানো আর ছুটাছুটি সব যেন একসাথে চলতে থাকে। কেউ কাউকে বাধা দেয় না। যে যার মতো করে ছুটে। এ-সময়ে ছাদ থেকে সহজে কেউ নামতে চায় না। সবাই চায় আরেকটু সময় যদি থাকতে পারে। কিন্তু সন্ধ্যার পর আর ছাদে থাকা যায় না। চারিদিক থেকে আযানের ধ্বনি ভেসে এলে সবাই ছাদ থেকে নামতে শুরু করে।

ছাদের পূর্বপাশে করোনার সময় নামাজের জন্য একটি ঘর তৈরি করা হয়েছে। এখানে নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জামাত হয়। বড়দের সাথে ছেলেরাও নামাজ পড়ে। ছোটো-ছোটো কয়েকজন ছেলে কোনো-কোনো ওয়াক্তে নামাজ পড়তে আসে। নামাজ ঠিকমতো পড়তে শিখেনি এখনো। রুকু সেজদা কোনোটাই ঠিকমতো দিতে পারে না। কখনো সেজদা দিতে গিয়ে লুটিয়ে পড়ে। একজায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারে না। আশেপাশে নড়াচড়া করে। তারপরও অনেকে তাদেরকে খুব উৎসাহ দেয়। এতে করে তাদের নামাজে আসার আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। কেউ কেউ বলে, পড়তে পড়তে একদিন শিখে যাবে।

আযান হলে তাড়াতাড়ি খেলা শেষ করে নামাজের ঘরে ঢুকে যায়। এদের দেখাদেখি ছোটো মেয়েও দুএকজন এসে নামাজ পড়তে চায়। ছোট্ট মেয়ে মারিহা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ভেতরে তাকিয়ে থাকে। এখানে নামাজ পড়তে পারবে কি-না জানতে চায়। হুজুর সায় দেয় না। ছোট্ট মেয়েটি মাথায় উড়না পেঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার খুব ইচ্ছা এখানে নামাজ পড়ার। বাসায় সে মায়ের সাথে পড়ে। ‘এখানে শুধু ছেলেরা নামাজ পড়তে পারে’। ‘মেয়েরা কেন পড়তে পারে না?’ বাবা ভাইকে বলে, ‘মসজিদে নামাজ পড়লে সওয়াব অনেকগুণ বেড়ে যায়’। ‘তাহলে মেয়েরা কেন এই সওয়াব পাবে না?’ এসব প্রশ্নের উত্তর কেউ দেয় না। সে সুযোগ খুঁজতে থাকে। কোনো একসময়ে ঢুকে গিয়ে পেছনের কাতারে দাঁড়িয়ে যাবে। কিন্তু আবার ভয় করে, অন্যরা যদি কিছু বলে।

এই বিল্ডিংয়ে বত্রিশটা ফ্ল্যাট। একত্রিশটিতে মারিহা, নাবিল, রাফিত, জারাদের মতো অনেকে থাকে। আর একটিতে অজররা থাকে। সবার জন্য ছাদ খোলা থাকে। কাপড়চোপড় শুকানোর চেয়েও ছেলেমেয়েরা বিকালের সময়টা বেশ উপভোগ করে। ছেলেমেয়েরা সবাই একসাথে খেলে, একসাথে ছুটাছুটি করে। আনন্দ উল্লাসও একসাথে করে। এখানে কোনো বাধা নেই। কোনটা কোন ধর্মের আলাদা করা যায় না। নাবিল আর অজরের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না। তারা একসাথে পড়ালেখা করে, একসাথে খেলাধূলা করে। ঝগড়াঝাটি হলেও মিলেমিশে যেতে দেরি হয় না। সঙ্গীসাথীরা যা করে অন্যারাও তা করতে চায়। খেলাতেও একজন একদিকে দৌড়ালে সবাই সেদিকে ছুটে যায়। কখনো তারা লুকোচুরি খেলে। আবার কখনো চোরপুলিশ খেলে। ছাদের আনাচে-কানাচে, ফুলের টবের আড়ালে কোথাও লুকাতে চেষ্টা করে। ছাদের একপাশে মিটিংরুমের ওখানেও লুকায়। আবার কখনো নামাজের ঘরের আশেপাশেও লুকিয়ে পড়ে। তখন অন্যরা খুঁজে বের করলে হৈচৈ করে সবাই আনন্দে মেতে ওঠে। তবে একদিন নাবিল নামাজের ঘরের পাশের দরজা খোলা পেয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে। দরজাটা আবার টেনে দেয়। তাকে আর কেউ খুঁজে পায় না। অনেক খোঁজাখুজি করে বিফল হয়ে তারা নাবিলকে শব্দ করতে বলে। এটাই খেলার নিয়ম। এতে যে লুকিয়ে থাকে তার জয় হয়। নাবিল যখন শব্দ করে ওঠে তখন অন্যরা বুঝতে পারে সে কোথায় আছে।

সেদিন সবাই নামাজের ঘরের ভেতরে ঢুকে যায়। ছেলেদের সাথে মেয়েরাও। সবার সাথে অজরও ঢুকে পড়ে। একে একে সবাই নাবিলকে ছুঁয়ে দেয়। খুঁজে পাওয়ার আনন্দে মেতে ওঠে। তারা ভাবতেও পারেনি, সে এখানে লুকাবে। এরা খেলার সময় কেউ এখানে ঢোকে না। এখন যখন ঢুকে পড়েছে কী করবে ভাবতে পারে না। এখানে হৈচৈ করা যায় না। শব্দ করে কথা বলা যায় না। বেশিক্ষণ এখানে থাকা ঠিক হবে না ভেবে আবার তাড়াতাড়ি করে বের হয়ে যায়। কিছুটা চুপচাপ হয়ে যায়। কোনোরকম শব্দ করে না। নামাজ পড়া ছাড়া এখানে ঢোকা নিষেধ। এটা তারা মনে রাখতে পারেনি। নাবিলকে খুঁজতে গিয়ে সবাই ঢুকে পড়েছে। এখন কেউ দেখে ফেললে তাদেরকে হয়তো আর ছাদে খেলতে দেবে না।

তারা বাইরে এসে এদিক-ওদিক তাকায়। কেউ নেই। এ-সময়ে ছোটরা ছাড়া আর কেউ থাকে না। তারপরও তাদের মনে হচ্ছে কেউ না কেউ দেখে ফেলেছে। তারা নিশ্চিত হতে পারছে না। ছাদে ছুটাছুটি করে এদিক-সেদিক দেখে। কেমন যেন চিন্তায় পড়ে যায়। কী করবে ভেবে কূল পায় না। কিসের যেন শব্দ শুনতে পায়। একজন আরেকজনের দিকে তাকায়। কেউ যেন তাদেরকে কানের কাছে এসে কী যেন বলছে। খুব নরম স্বরে বলছে। তারা সবাই কান পেতে শোনে। ‘তোমরা ভয় পাচ্ছো কেন? তোমরা তো শিশু। শিশুদের মধ্যে ছেলেমেয়ে কোনো পার্থক্য নেই। ধর্মের কোনো ভেদাভেদ নেই। সব শিশুরা একই। শিশুরা সবখানে যেতে পারে।’ তখন তারা সবাই মৌনতা ভেঙে আবার আনন্দে হৈ চৈ করে ওঠে। আবার কোলাহল করতে শুরু করে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিয়ে
পরবর্তী নিবন্ধকি ছু জা না কি ছু অ জা না