শব্দ দূষণে অতিষ্ঠ নগরবাসী

বাড়ছে বধিরতাসহ নানা রোগ

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ১ অক্টোবর, ২০২২ at ৬:২০ পূর্বাহ্ণ

বন্দর নগরী চট্টগ্রাম এখন শব্দ দূষণের নগরীও। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত যানবাহনের উচ্চ শব্দে নাগরিক জীবন রীতিমতো অতিষ্ঠ। সহনীয় মাত্রার ২২ থেকে ৩৮ ডেসিবল বেশি শব্দের দূষিত সমুদ্রে রাতদিন হাবুডুবু খাচ্ছেন নগরবাসী। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে এ দূষণকে অনেকে বলছেন ‘শব্দ সন্ত্রাস’। শব্দ দূষণ প্রতিনিয়তই নাগরিক জীবনকে প্রভাবিত করছে। সকালে ঘর থেকে বের হয়ে কর্মস্থলে, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া থেকে আবার ঘরে ফিরে আসা অবধি শব্দ দূষণের যন্ত্রণায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে নানান স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বয়স্ক ও শিশুরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সব থেকে বেশি।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নগরী চট্টগ্রামে এখন আর চারদিকে পাখির কিচিরমিচির শোনা যায় না। শোনা যায় গাড়ির বিকট হর্নের শব্দ (বাসের শব্দ ৯৫ ডেসিবল ও মোটরসাইকেলের ৮৭ থেকে ৯০ ডেসিবল), কলকারখানার মেশিনের শব্দ (৮০ থেকে ৯০ ডেসিবল) এবং বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ড থেকে সৃষ্ট শব্দ। শুধু যে বাইরের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে শব্দ দূষণ হয়, তা নয়; বরং আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেও শব্দ দূষণ হয়।
প্রায়শই দেখা যায়, নগরীর বিভিন্ন সড়ক ও মহাসড়কে কেবল গাড়ি চলমান অবস্থায়ই নয়, যানজটের সময়ও চালকরা অহরহ হর্ন বাজিয়ে চলেন। হর্নের শব্দে রাস্তার পাশে চলা কিংবা দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। তেমনই একটি দৃশ্য দেখা যায় গত ২৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় সিআরবি সাত রাস্তার মোড়ে। শুধু এই মোড়েই নয়, নগরীর সকল সড়কে বিকট শব্দে হর্ন বাজিয়ে চলেন চালকরা, যার বেশিরভাগই বাজানো হয় অপ্রয়োজনে। কিন্তু চালকরা মনে করছেন, বিকট শব্দে হর্ন বাজানোর প্রয়োজন আছে।
কেন অপ্রয়োজনে হর্ন বাজানো হয়, এমন প্রশ্নের উত্তরে নিউমার্কেট মোড়ে গতকাল বিকেলে আলম শেখ নামে এক প্রাইভেটকার চালক বলেন, নিজেই দেখেন, বাসগুলো মোড়ে কীভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সাথে আছে রিকশা। এটা নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে যে কয়েকবার হর্ণ না বাজালে কিছুতেই সামনে যাওয়া যাবে না।
অন্যান্য শহরের মতো চট্টগ্রামে রয়েছে আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা। এছাড়া রয়েছে কিছু নীরব ও মিশ্র এলাকা। সব এলাকার শব্দ দূষণের মাত্রা সমান নয়, আবার প্রতিটি এলাকার শব্দের জন্য নির্ধারিত মানমাত্রাও সমান নয়। চট্টগ্রাম নগরীতে শব্দ দূষণের মাত্রা কোন পর্যায়ে আছে সেটা জানতে একটি গবেষণা করেছিলেন প্রয়াত নগর পরিকল্পনাবিদ ও প্রকৌশলী আলী আশরাফ। তাঁর এ গবেষণায় শব্দ দূষণের ভয়াবহতার চিত্র আরও স্পষ্ট হয়ে উঠে। তিনি ও তাঁর টিম নগরীর ৩২টি জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানে ডিজিটাল সাউন্ড মিটারের (ডিবি মিটার) সাহায্যে শব্দের মাত্রা পরিমাপ করেন। এসব স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে মেট্রোপলিটন হাসপাতাল, আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, হাজেরা তজু ডিগ্রি কলেজ, সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম কলেজ ও মহসিন কলেজ, ডা. খাস্তগীর গার্লস হাই স্কুল, অর্কিড স্কুল, বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল, অক্সিজেন বাস টার্মিনাল, বটতলী রেলওয়ে স্টেশন, কদমতলী বাস টার্মিনাল, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল, জিইসি মোড়, কাপ্তাই রাস্তার মাথা, বহদ্দারহাট মোড়, মুরাদপুর মোড়, বন্দর মোড়, চকবাজার মোড়, গুলজার মোড়, দেওয়ানহাট মোড়, এ কে খান মোড়, ২ নং গেইট মোড়, নিউমার্কেট মোড়, আন্দরকিল্লা মোড়, আগ্রাবাদ মোড়, নিউমার্কেট বাণিজ্যিক এলাকা ও আগ্রাবাদ বানিজ্যিক এলাকা। এসব স্থানে শব্দের গড় তীব্রতা ৯০ ডেসিবল, যা আমাদের শ্রবণশক্তি নষ্ট করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
সমীক্ষা চালানো নগর পরিকল্পনাবিদ ইঞ্জিনিয়ার আলী আশরাফ তাঁর সেই গবেষণা পত্রে মন্তব্য করেছিলেন, বাস টার্মিনালগুলোতে গিয়ে ড্রাইভারদের নিয়মিত কাউন্সেলিং, শব্দ দূষণের কুফল সম্পর্কে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত সেমিনার করা সর্বোপরি আইনের প্রয়োগ ও সচেতনতার সমন্বয়ের মাধ্যমেই শব্দ দূষণ প্রতিরোধ সম্ভব। নয় তো ধীরে ধীরে বধির নগরীতে পরিণত হবে চট্টগ্রাম নগরী। নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ ডা. চন্দন কান্তি দাশও এ কথায় সায় দিয়ে বলেন, সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি শব্দের মধ্যে থাকলে উচ্চ রক্তচাপ, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, ঘুমের সমস্যা হওয়া, মাইগ্রেন, বধির হওয়া এমনকি ব্রেইন স্ট্রোকও হতে পারে। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (হু) এর তথ্যমতে শব্দের মাত্রা ৮০ ডেসিবলের উপরের হলে তা বিপজ্জনক। এর অর্থ হলো চট্টগ্রাম শহরের প্রত্যেকটি মানুষ নিজের অজান্তে বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যে জীবন কাটাচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সহজলভ্যতা, সহজপ্রাপ্যতা ও দণ্ডের মাত্রা অতি সহনশীল হওয়ায় থামানো যাচ্ছে না নিষিদ্ধ হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার। শব্দ দূষণের শাস্তি হিসেবে অর্থদণ্ড ও কারাদণ্ডের বিধান থাকলেও নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করেই হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও আবাসিক এলাকাসহ সবখানে চলছে শব্দ দূষণ। পুলিশ শব্দ দূষণের বিরুদ্ধে মাঝে মধ্যে সপ্তাহব্যাপী অভিযান চালায়, জব্দ করা হয় হর্ণ, মামলাও হয় এসব যানবাহনের বিরুদ্ধে। কিন্তু কমে না যন্ত্রণাদায়ক এ হর্ণের ব্যবহার। পুলিশ কর্মকর্তারা মনে করছেন, জরিমানা কম হওয়ায় যানবাহন মালিক চালকদের মধ্যে হাইড্রোলিক হর্ণ ব্যহারের প্রবণতা কিছুতেই রোধ করা যাচ্ছে না। তবে অভিযানের কারণে পরিবহন মালিক শ্রমিকদের মধ্যে সচেতনতা কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সিএমপির উপ কমিশনার (ট্রাফিক-পশ্চিম ও বন্দর) তারেক আহমেদ আজাদীকে বলেন, নগরীতে যানবাহন বাড়ছে, তার সাথে হাইড্রোলিক হর্ণের কারণে শব্দ দূষণও বাড়ছে। আমরা জরিমানা করার পাশাপাশি হাইড্রোলিক হর্ণ জব্দ করছি। পাশাপাশি মালিক শ্রমিক নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করে তাদের বুঝানোর চেষ্টা করছি।
জানা যায়, শব্দ দূষণের গুরুত্ব বিবেচনায় রেখে ১৯৯৭ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে শহরকে ৫ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। নীরব, আবাসিক, মিশ্র, শিল্প ও বাণিজ্যিক এলাকা। এসব এলাকায় দিন ও রাত ভেদে শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আবাসিক এলাকায় ৫০ ডেসিবেল, বাণিজ্যিক এলাকায় ৭০, শিল্প এলাকায় ৭৫, নীরব এলাকায় ৪৫, আবাসিক কাম বাণিজ্যিক এলাকায় ৬০ ও রাতের জন্য সর্বত্র ১০ ডেসিবেলের কম। আইন অনুযায়ী হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকার নির্ধারিত কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। এসব জায়গায় মোটরগাড়ির হর্ন বাজানো বা মাইকিং করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, নগরীতে প্রায় দেড় লাখ যানবাহন চলাচল করছে। চলাচলকারী যানবাহনের প্রায় ৩৫ শতাংশই ফিটনেসবিহীন। এসব যানবাহন কালো ধোঁয়া সৃষ্টি করছে ও হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরীর বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্কুল-কলেজের পাশে জোরে হর্ন বাজানো এবং মাইক বাজানো নিষেধ-সংবলিত সাইনবোর্ড টাঙানো আছে। কিন্তু তা কেউ মানছে না। হাসপাতালকে নীরব এলাকা ঘোষণা করে শব্দের মানমাত্রা ৪৫ ডেসিবলের নিচে রাখার কথা থাকলেও তা মানছে না কেউ। আইনের তোয়াক্কা না করইে চট্টগ্রাম মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালের একশ মিটারের মধ্যে দ্বিগুণ মাত্রায় হর্ন বাজিয়ে প্রতিনিয়ত চলছে যানবাহন। আর সেবা নিতে এসে শব্দ দূষণের কারণে রোগী ও স্বজনদের পড়তে হচ্ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। শব্দ দূষণ থেকে রেহাই নেই বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনের রাস্তাগুলোর। যানবাহনের কানফাটা শব্দে অতিষ্ঠ শিক্ষার্থীরাও।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিদেশিদের কাছে বিএনপির অপশাসনের চিত্র তুলে ধরুন : প্রধানমন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধপুরোদমে উৎপাদনে আসছে ২০২৪ সালে