লাশ হয়ে বাড়ি ফিরল আরমান

মুরাদপুরে মাদ্রাসা থেকে মরদেহ উদ্ধার, পরিবারের দাবি হত্যা

আজাদী প্রতিবেদন | বুধবার , ৯ মার্চ, ২০২২ at ৬:৫২ পূর্বাহ্ণ

ছয় মাস আগে হাফেজ হয়েছে আরমান হোসাইন (১৪)। তার বাবা আব্বাস উদ্দিনের স্বপ্ন ছিল আসন্ন রমজান মাসে ছেলের কোরান তেলাওয়াত শুনে তারাবির নামাজ আদায় করবেন। মুখস্থ করা কোরান যাতে ভুলে না যায় সে জন্য ছেলেকে গত ৫ ফেব্রুয়ারি ভর্তি করান নগরের পাঁচলাইশ থানার মুরাদপুর পিলখানা ডানকান হিলের আলী বিন আবী তালিব (রা.) মাদ্রাসায়। ভেঙে গেছে আব্বাস উদ্দিনের স্বপ্ন। কারণ লাশ হয়ে বাড়ি ফিরেছে আরমান। গতকাল সকাল ১১টার দিকে মাদ্রাসার সীমানা প্রাচীরের ভেতর থেকে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গত ৬ মার্চ বোয়ালখালী উপজেলার এক মাদ্রাসা থেকেও সাত বছর বয়সী এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, আরমান সোমবার বিকাল থেকে নিখোঁজ ছিল। সন্ধ্যার পর মাদ্রাসার পক্ষ থেকে আরমানের বাবাকে ফোন করে বাসায় গেছে কিনা জানতে চাওয়া হয়। মাদ্রাসা থেকে ফোনে ছেলের নিখোঁজের খবর পেয়ে রাতভর আত্মীয়-স্বজনের বাসায় খোঁজ করেও ছেলের সন্ধান পাননি তার বাবা।
তবে পুলিশ বলছে, খেলতে গিয়ে মাদ্রাসার ছাদ থেকে অসতর্ক অবস্থায় পড়ে গেছে বা লাফ দিয়েছে আরমান। তারপরও পুরো বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষও বলছে, ছাদ থেকে পড়ে যেতে পারে। নিহত আরমান পাঁচলাইশ মির্জাপুল এলাকার খলিলুর রহমান সর্দার বাড়ির আব্বাস উদ্দিন ও আমেনা বেগমের ছেলে। একমাত্র সন্তান হারিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন দুজনই। শোকে বিহ্বল মা কাঁদছিলেন চিৎকার করে। আত্মীয়-স্বজন কেউ থামাতে পারছিল না। তার একটাই কথা, আমার ছেলেকে তোমরা এনে দাও। বিলাপ করতে করতে তিনি বলেন, আমার ছেলেকে নির্যাতন করে মেরেছে। আমি এর বিচার চাই। আমি হুজুরের শাস্তি চাই।
উল্লেখ্য, আরমান আলী বিন আবী তালিব (রা.) মাদ্রাসায় হাফেজ শোয়াইবের তত্ত্বাবধানে পড়ত। মাদ্রাসাটিতে শোয়াইব ‘চকরিয়া হুজুর’ নামে পরিচিত। চার হাজার টাকা দিয়ে তাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করা হয়েছিল।
মাদ্রাসার পরিচালক হাফেজ আবদুল মান্নান সাংবাদিকদের বলেন, সন্ধ্যার পর তাকে না পেয়ে আমরা অভিভাবকদের খবর দিই। আমরাও খোঁজাখুঁজি করি। অনেক সময় মাদ্রাসা থেকে ছেলেরা পালিয়ে যায়। সেও পালিয়েছে, এমনটি মনে করেছিলাম। সকালে তার মরদেহ দেখতে পায় ছেলেরা। এরপর পুলিশকে খবর দেওয়া হয়।
মাদ্রাসাটির শিক্ষক হাফেজ আবদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, চারতলা মাদ্রাসা ভবনে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ভাগে পড়ে। আব্বাস নিচতলায় পড়ত। আসরের পর ছেলেরা মাদ্রাসার ছাদে খেলতে যায়। সোমবার বিকেলে অন্য ছেলেদের সঙ্গে সেও ছাদে খেলতে ওঠে। সন্ধ্যার পর আর ফিরে না আসায় খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ছাত্ররা গোসল করতে গেলে মাদ্রাসার পেছনে তার মরদেহ দেখতে পায়।
নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) মোখলেছুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, সুরতহাল প্রতিবেদনে তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। প্রাথমিকভাবে আমাদের কাছে মনে হয়েছে, বাচ্চাটা ছাদে উঠে দুর্ঘটনা ক্রমে নিচে পড়ে গেছে। বাকিটা পোস্টমর্টেম রিপোর্ট ও পারিপার্শ্বিক সবকিছু তদন্ত করে বলা যাবে। সিসিটিভি ফুটেজে আরমানকে ছাদে উঠতে দেখা গেছে। ছাদে কয়েকটা ছেলে খেলছিল। অন্য ছেলেদের নামতে দেখা গেলেও তাকে ছাদ থেকে ফিরতে দেখা যায়নি।
আরমানের পিতা আব্বাস উদ্দিন বলেন, গত রোববার বিকালে ছেলেকে দেখতে গিয়েছিলাম। তখন ছেলে বলেছিল, বাবা মাকেও বলেছি, তোমাকেও বলছি, আমাকে হুজুরটা বেশি মারধর করে, অত্যাচার করে। আমাকে হুজুরটা পাল্টাই দেন। নয়তো অন্য মাদ্রাসায় নিয়ে যান। আমি বলেছি, বাসায় তোমার মায়ের সঙ্গে কথা বলে একটা ব্যবস্থা করব। পরদিন রাতে শুনি আমার ছেলেকে পাওয়া যাচ্ছে না। আজকে (মঙ্গলবার) লাশ পাওয়া গেল। আমার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই।
জানা গেছে, চারতলা একটি ভবন ভাড়া নিয়ে মাদ্রাসা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন। যেখানে প্রথম ও চতুর্থ তলায় মাদ্রাসা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। আর দ্বিতীয় তলায় অফিস ও শিক্ষকদের থাকার কক্ষ। তৃতীয় তলায় পরিবার নিয়ে থাকেন মাদ্রাসা পরিচালক। ভবনের কয়েক ফুটের ব্যবধানে সীমানা প্রাচীর। সীমানা প্রাচীরের ভেতরেই ছিল আরমানের লাশ। ১৪০ জন শিক্ষার্থী আছে এ মাদ্রাসায়। ‘সাধারণ’ ও ‘ভিআইপি’ দুই ভাগে ভাগ করে শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়। মাদ্রাসার সাধারণ শাখায় আটজন এবং ভিআইপি শাখায় চারজন শিক্ষক আছে। মাদ্রাসার নিচতলায় থাকে প্রায় ৯০ জন। যেটি সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দ। চতুর্থ তলায় থাকে আরও প্রায় ৫০ জন। এটি ‘ভিআইপি’ শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দ। দুই শাখার শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেতনের ব্যবধানও দ্বিগুণ। মাদ্রাসা ভবনের বাইরে খালি স্থানে শিক্ষার্থীদের গোসলের ব্যবস্থার জন্য কল লাগানো হয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচবিতে ছাত্রলীগের দু’পক্ষের ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চূড়ান্ত মুহূর্তের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে