লাল শার্ট

শাকিব হুসাইন | বুধবার , ২৭ এপ্রিল, ২০২২ at ১০:৫৭ পূর্বাহ্ণ

আজকে সকাল থেকেই হঠাৎ বৃষ্টি। সারাদিন ধরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হল। এখন সন্ধ্যা। এখন একটু হালকা। কিন্তু বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আর মাঝে মাঝে দূরের কোথায় থেকে গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ আসছে। ঘরে কোন আলো নেই। সোহান হারিকেনের আলো জ্বালিয়ে বই পড়ছে। সোহান এবার ক্লাস ফাইভে পড়ে। পড়াশোনায় বেশ মনোযোগী।

আর দুদিন পরেই ঈদ। সোহানের বাবা বলেছে মন দিয়ে পড়াশোনা করলে এবার ঈদে তাকে ভালো দেখে লাল রঙের একটা শার্ট কিনে দেবে।
রাত দশটা। রমিজ মিয়া ঘরে ঢুকল। সারা শরীর ভিজে গেছে। ঘামে না বৃষ্টিতে সোহান আন্দাজ করতে পারল না। সম্ভবত বৃষ্টিতেই হবে। ঘামেও হতে পারে।
বাবা আসায় সোহানের মুখটা চকচক করে উঠল। একটা ছেঁড়া তোয়ালে এগিয়ে দিল। আর বলল…

– বাবা, আমার লাল শার্ট এনেছ?
শার্টের কথা শুনেই রমিজ মিয়ার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায় । কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল…

– আনতে পারে নাই রে বাপ। সারাদিন বৃষ্টি ছিল। কেউ আজ ভ্যানে ওঠেনি। এক টাকাও আজ কামাই করতে পারিনি বাপ।
নিমিষেই সোহানের মুখটায় রাজ্যের সব অন্ধকার নেমে এল। আর একটা কথাও বলল না সে। রমিজ আলি ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে ঘরে চলে যায়।
কিছুক্ষণ পর সোহান বাবার ঘরের কাছে যেতেই শুনতে পেল বাবার কান্নার শব্দ।

বাবা কান্না ভেজা কণ্ঠ নিয়ে মাকে বলছে…
– জানো সোহানের মা, সোহানের জন্য একটা লাল রঙের শার্ট দেখে রাখছিলাম। ভেবেছিলাম ঈদের দুদিন আগে শার্টটা কিনে দেবো। দুদিন থেকে ভ্যানে কেউ আর চড়তে চাচ্ছে না। আমি না-কি চালিয়ে নিয়ে যেতে পারব না। দুদিন থেকে মাত্র সত্তর টাকা কামাই করেছি। এই সত্তর টাকা দিয়ে শার্ট কিনব না চাল কিনব ভেবে কোন কূল খুঁজে পাই না। আজ দেখলাম শার্টটা একজন ভদ্রলোক নিয়ে যাচ্ছে। ওনার পা পর্যন্ত ধরেছি সোহানের মা, তবুও উনি শার্টটা দিল না।
কথাগুলো বলতে বলতে রমিজ মিয়া কান্না শুরু করে দিল।

বাবার কান্না শুনে সোহানও আর কান্না থামাতে পারল না। কাঁদতে কাঁদতে পাশের ঘরে চলে গেল। আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল আর বাবার কাছ থেকে শাটের্র বায়না ধরবে না।
পরেরদিন সোহান মাঠে গেল। সেখানে হঠাৎই রাদিবের সাথে দেখা হল। রাদিব সাহানের ক্লাস ফোরের বন্ধু ছিল। রাদিবের বাবার বদলি হওয়ায় তারা শহরে চলে যায়। সোহানকে দেখে রাদিব খুশিতে আটখানা। দুজনের অনেক কথা হল। একসময় রাদিব বলে উঠল…

– আমি তখন থেকে লক্ষ্য করছি তোর মুখটা কেমন জানি ফ্যাকাশে হয়ে আছে। কি হয়েছে বল?
– তেমন কিছু হয় নাই বন্ধু।
– আমাকে বলবি না? আমি তো বন্ধু না।

– আজ বাদে কাল ঈদ। বাবা এবার কোন নতুন পোশাক কিনে দিতে পারে নাই। একটা লাল শার্ট কিনতে চেয়েছিলাম। সেটাও টাকার অভাবে কিনতে পারেনি বাবা। বাবা না আমার জন্য অনেক কষ্ট করে বন্ধু।
– ও ও ও এই কথা। চিন্তা করিস না। দেখিস আজকেই পেয়ে যাবি।

– পাবো না বন্ধু।
– আরে আমি বলছি না। পাবিই…. আচ্ছা বন্ধু এবার আমাকে যেতে হবে।
– আচ্ছা যা।
রাদিব মাঠ থেকে চলে যায়। বাসায় গিয়ে তার বাবাকে পুরো বিষয়টা খুলে বলে।
রাদিব সোহানের পরিবারকে ঈদে নতুন পোশাক দিতে চায়। কিন্তু সেটা প্রকাশ্যে না গোপনে দেবে রাদিব। বাবার এতে কোন অমত নেই। তারা দু’জন যায় কাপড় কিনতে।
রাতেরবেলা হারিকেন জ্বালিয়ে জানালার পাশে বই পড়ছে সোহান। এমন সময় একটা আচমকা কাণ্ড ঘটল। একটা লাল রঙের শার্ট জানালার পাশে ঝুলছে। আর বলছে…

– রাদিব এই যে তোমার লাল শার্ট।
শার্টের কথা বলা দেখে ভয় পেয়ে যায় সোহান। ভয়ে ভয়ে বলে…
– কে তুমি? তুমি শার্ট হয়ে কথা বলছ কি করে?
– ভয় পেয় না। আমাকে তোমার বন্ধু ভাবতে পারো। তুমি তোমার বাবার কাছে লাল
রঙের শার্ট চেয়েছিলে না?

– হ্যাঁ, চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি কি করে জানলে?
– আমি সব জানি। এখন শার্টটা নাও। সাথে তোমার বাবা-মায়ের জন্যও নতুন পোশাক এনেছি। জানালার পাশ থেকে নতুন চকচকে লাল রঙের শার্ট আর পাঞ্জাবি ও শাড়ি এনে পড়ার টেবিলে পরে। সোহান জানালার দিকে তাকাল। কিন্তু কাউকেই দেখতে পেল না। সোহান বাবা-মাকে ডাকল। বাবা-মা সঙ্গে সঙ্গে সোহানের কাছে ছুটে এল।

সোহান সবকিছু খুলে বলল। সোহানের বাবা-মা খুব খুশি হয়েছে। তারা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছে। সোহান চিন্তা করে কে দিল এই পোশাক? ভাবতে ভাবতে এক সময় উত্তর পেয়ে যায়। সোহানের আর বোঝার বাকি থাকে না যে এগুলো সব তার বন্ধু রাদিবের কাজ। সোহান রাদিবকে মনে মনে অনেক ভালোবাসা জানায়।

ওদিকে রাদিব আর তার বাবা অন্ধকার রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। মাঝে মাঝে দুজনের কণ্ঠ থেকে ‘মানুষ মানুষের জন্য / জীবন জীবনের জন্য / সেই বিখ্যাত গান ভসে বেড়াচ্ছে অন্ধকার রাতের আকাশে-বাতাসে। দূরের কোন হিজল গাছ থেকে হুতুম পেঁচার আওয়াজ ভেসে আসে। মিষ্টি বাতাস বইতে শুরু করে চতুর্দিকে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদারুল ইরফান রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মতবিনিময়
পরবর্তী নিবন্ধঈদ মানে তো