বাংলাদেশে প্রচলিত সনাতনী হিন্দু আইনে বিয়ে কোনো চুক্তি নয়। সকল ধর্মীয় ও জাগতিক কার্যসাধনের উদ্দেশ্যে বিয়েকে স্বামী–স্ত্রীর অবিচ্ছেদ্য বন্ধন হিসেবে দেখা হয়। সে–কারণে হিন্দু নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদের অনুমোদন নেই। হিন্দু নারী কিংবা পুরুষ কোনো পক্ষই কোনো পরিস্থিতিতেই বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে সক্ষম নয়। তবে একজন হিন্দু পুরুষ ইচ্ছে করলেই স্ত্রী বর্তমান থাকা সত্ত্বেও যতবার ইচ্ছে বিয়ে করার অধিকার রাখেন। সেজন্য বিশেষ কারণ বা আগের স্ত্রীর/স্ত্রীদের বা কোনো কর্তৃপক্ষের অনুমতি–অনুমোদনের দরকার পড়ে না। প্রচলিত সনাতন হিন্দু আইনেই বহুবিবাহ অনুমোদিত। এর অর্থ হচ্ছে বহুবিবাহ ধর্মীয় ও সামাজিক দৃষ্টিতে অবৈধ বা অগ্রহণযোগ্য নয়, সেইসাথে হিন্দু পুরুষের বহুবিবাহ রাষ্ট্রীয় আইনেও শাস্তিযোগ্য নয়। অন্যদিকে একজন বিবাহিত হিন্দু নারী আদালতের মাধ্যমে বড়জোর স্বামী থেকে পৃথক বসবাস ও ভরণপোষণের অধিকার পেতে পারেন। কিন্তু প্রয়োজনীয়তা থাকলেও বিচ্ছেদ ও জৈবিক কারণে পুনরায় বিয়ের অধিকার তার নেই। হিন্দু আইন মূলত হিন্দু ধর্মশাস্ত্রেরই প্রতিরূপায়ন। হিন্দু আইনানুযায়ী কনের বাবা বরের হাতে কনেকে সম্পূর্ণভাবে ন্যস্ত করেন। কন্যা সম্প্রদানের মাধ্যমে পুরোপুরি দায়মুক্ত হন।
ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসকদের উদ্যোগে ঊনিশ শতকে এ– অঞ্চলে বিধিবদ্ধ আইনের সূচনা হয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক, দাপ্তরিক কাজের সুবিধার্থে ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ও কর্তৃত্বে রাখার প্রয়োজনে মূলত আইনগুলো তৈরির উপলক্ষ্য সৃষ্টি হয়। অথচ ধর্ম ও প্রথা থেকে উৎসারিত ব্যক্তিগত আইনগুলো বৈষম্যপূর্ণ, পীড়নসহায়ক ও পিতৃতান্ত্রিক চেতনাজাত। বলাবাহুল্য, এইসব আইনের প্রধান শিকার হয়েছে নারী।
দণ্ডবিধি, ফৌজদারি কার্যবিধি, দেওয়ানি কার্যবিধির মতো গুরুত্বপূর্ণ আইন তৈরি হলেও ব্রিটিশ শাসকগণ বিভিন্ন ধর্মজাতিগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের নিজ নিজ ধর্মীয় আইন তথা প্রচলিত প্রথাসিদ্ধ আইনের ব্যাপারে এবং সেগুলোর প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিষয়ে নীরব ভূমিকা পালন করে।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পাকিস্তানকাল ও ১৯৭১–এ স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশের জন্মের পঞ্চাশ বছর হলেও হিন্দুদের পারিবারিক আইনের সংস্কার সম্ভব হয়নি। হিন্দুদের বিবাহ বিচ্ছেদের আইনও তৈরি হয়নি। অথচ, দেশভাগের পর প্রতিবেশী দেশ ভারতে সেই ১৯৫৫ সালে হিন্দু বিবাহ আইন পাশ হয়েছে। যার মাধ্যমে হিন্দুদের বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এমনকি একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র নেপালেও বিবাহ বিচ্ছেদের আইন আছে। কিন্তু বাংলাদেশে অনুরূপ আইন তৈরির কার্যকর সরকারি উদ্যোগ অদ্যাবধি গ্রহণ করা হয়নি। ২০১২ সালে প্রণীত ‘হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন’ রাষ্ট্র কর্তৃক হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য সর্বশেষ আইনি সুরক্ষা। কিন্তু তাও একটা ফাঁক রেখে এই আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। আইনটিকে ‘ঐচ্ছিক’ করে রাখা হয়েছে। মানে দাঁড়াচ্ছে, আইন না মানলেও অসুবিধা নেই।
সংখ্যালঘু হিন্দুদের স্বার্থে আইন সংস্কার ও প্রণয়নে এই নীরবতা যতটা ধর্মীয় তারচেয়েও অধিক রাজনৈতিক।
১৯৪৬ সালের The Hindu Married Women’s Right to Separate Residence and Maintenance Act এর আওতায় হিন্দু আইনে বিবাহ বিচ্ছেদ না থাকলেও নির্দিষ্ট কিছু শর্তে স্বামীর কাছ থেকে আলাদা থাকার সুযোগ রয়েছে। শর্তগুলো নিম্নরূপ:
১. স্বামী যদি খুব নিষ্ঠুর প্রকৃতির হয় এবং যার ফলে তার সাথে থাকাটা অনিরাপদ।
২. স্বামী পুনরায় বিয়ে করলে। স্বামী পুনরায় বিয়ে না করে যদি উপপত্নী রাখে, সেক্ষেত্রেও স্ত্রী সেপারেশন করতে পারবে।
৩. স্বামী এমন কোন রোগে আক্রান্ত যার ফলে স্ত্রী আর স্বামীর সাথে থাকা সম্ভব নয়, তখন স্ত্রী সেপারেশনের জন্য আবেদন করতে পারবেন।
৪. স্বামী যদি হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে অন্য ধর্মগ্রহণ করে।
তাছাড়া অন্য কোন যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে যদি স্ত্রীলোকটি আদালতকে সন্তুষ্ট করতে পারে যে, তার সেপারেশন দরকার, আর আদালত সন্তুষ্ট হলে তবেই কেবল আদালত সেপারেশনের জন্য অনুমতি দিতে পারেন। উল্লেখ্য, সেপারেশনে থাকাবস্থায় স্ত্রীকে ভরণপোষণ দিতে বাধ্য স্বামী। তবে নারীটি ভরণপোষণ পাবেন ঠিকই, তার অন্যত্র বিয়ে করার অধিকার নেই।
কিন্তু সেই আইনে সেপারেশন চাইলে নারীকে চিরকাল তার প্রথম স্বামীকেই পতি স্বীকার করে একাকি বেঁচে থাকতে হবে। চাইলেও অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবে না। তবে স্বামী চাইলে যতগুলো ইচ্ছে বিয়ে করতে পারবেন। নারী যদি হিন্দু আইনের বিধানকে পাশ কাটিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করে তাহলে স্বামী তাকে ব্যভিচারিণী সাব্যস্ত করতে পারবেন এবং উক্ত নারীর নতুন স্বামীকে ব্যভিচারের দায়ে অভিযুক্ত করে ৭ বছর কারাবাসের দণ্ড চাইতে পারবেন।
যদি তিনি ব্যভিচারের মামলা নাও করেন, তবুও নারীটির নতুন বিয়েটা আইনের চোখে অবৈধ থাকবে। নতুন স্বামীর সংসারে সন্তান হলে তারাও আইনের চোখে অবৈধ সন্তান হিসেবে পরিগণিত হবে। হিন্দু আইনে বৈধ সন্তানের যে অধিকার আছে, অবৈধ সন্তানের তা নেই। এই আইনে বিয়ের ধরনের উপর সম্পত্তিতে সন্তানদের উত্তরাধিকার নির্ধারিত হয়। প্রজাপত্য বিবাহের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া সন্তানের যেমন অধিকার, আসুর বিবাহের (পণ নিয়ে বিবাহ) সন্তানের সে–সমান অধিকার নেই। হিন্দু আইনে বাসায় রক্ষিতা রাখা বৈধ। কিন্তু রক্ষিতার সন্তান সমান উত্তরাধিকার পাবে না। তেমনিভাবে দাসীর সন্তান এবং অবৈধ গোপন প্রণয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত সন্তানও (আইনের ভাষায় জারজ সন্তান) বৈধ সন্তানের মতো সম্পত্তিতে সমান উত্তরাধিকার পায় না। ওই শিশুদের কোনো দোষ না থাকলেও হিন্দু আইন তাদেরকে এই দণ্ড দিয়ে রেখেছে। ইংরেজ প্রণীত হিন্দু আইন অনুযায়ী ধর্মান্তরিত হওয়া অথবা যৌনকর্মীর খাতায় নাম লেখানো ছাড়া বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার নেই। দুঃখজনক সত্য হল, হিন্দু মেয়েদের বিবাহিত জীবন ছেড়ে বেশ্যাবৃত্তিতে প্রবেশের অধিকার এবং সুযোগ দেওয়া আছে। ধর্মান্তরিত হলে অথবা বেশ্যাবৃত্তিতে প্রবেশ করলে হিন্দু বিবাহ বিচ্ছেদ সম্ভব। কিন্তু পুনরায় বিয়ে করে স্বামী–সন্তান নিয়ে সুস্থ–স্বাভাবিক জীবন নিয়ে বাঁচার অধিকার আইনে নেই। একজন নারী যদি একবার কোনো পুরুষকে বিয়ে করে সেই পুরুষ যদি অসচ্চরিত্র কিংবা অত্যাচারী হয়, এমনকি তার সঙ্গে মতের অমিল হলেও নারীকে সারাজীবন ওই পুরুষের সেবা করে কাটাতে হবে । এমনকি বিয়ের পর যদি প্রমাণিত হয় ওই পুরুষটি সম্পূর্ণরূপে যৌনসামর্থ্যহীন তবুও ওই পুরুষকেই ধ্যানজ্ঞান করে বাকি জীবন কাটাতে হবে নারীকে। এটা পুরোপুরি হিন্দুধর্মের নারীর প্রতি সমাজের, রাষ্ট্রের বৈষম্য। সম্প্রতি হিন্দু বিবাহ আইনে নারীদের বিয়ে বিচ্ছেদের অধিকার, সম্পত্তিতে অধিকার কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। হিন্দু বিবাহ আইন বিয়ে রেজিস্ট্রেশন কেন বাধ্যতামূলক করা হবে না, রুলে তাও জানতে চাওয়া হয়েছে। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও মোট জনসংখ্যার কিছু অংশ পিছিয়ে পড়ে এবং দাসীর মতো জীবন যাপন করে তবে সে রাষ্ট্রের উন্নয়ন সম্ভব নয়। অনতিবিলম্বে বাংলাদেশের হিন্দু নারীদের কথা ভেবে বিবাহ বিচ্ছেদ আইন পাস করা উচিত, অন্য আইনের সময়োপযোগী সংস্কার জরুরি। যেখানে সেপারেশনের যে শর্তগুলো রয়েছে, সেই শর্তগুলোর কোন একটি ভঙ্গ হলে স্ত্রীলোকটি আদালতে বিবাহ বিচ্ছেদ চেয়ে আবেদন করতে পারবে। আদালত তখন বিচার বিবেচনা করে স্ত্রী লোকটিকে বিবাহ বিচ্ছেদের অনুমতি দিতে পারেন।
শিশু সুরক্ষা সমাজকর্মী
প্রবেশন কার্যালয়, সিএমএম কোর্ট
সমাজসেবা অধিদফতর, চট্টগ্রাম