একজন রত্নগর্ভার দিনলিপি

সালমা বিনতে শফিক | শনিবার , ১০ জুন, ২০২৩ at ৫:২৮ পূর্বাহ্ণ

পটভূমিকা

শিউলি বেগমের আজ একটুও দম ফেলার ফুরসৎ নেই। সকাল থেকে ছুটে বেড়াচ্ছেন এঘর থেকে ওঘরে। একদিকে ঘর গোছানো, অন্যদিকে রান্নার আয়োজন। রান্না করার বাঁধা লোক থাকলেও আজ তিনি নিজেই রান্না করছেন। ঘরদোর গোছগাছ করছেন নিজ হাতে। বাক্সবন্দী রঙিন পর্দা, সোফার খোল, বিছানার চাদর সব বের করছেন। কাঁচের আলমারিতে সাজিয়ে রাখা ছবি আর মেডেলগুলোকে শাড়ির আঁচলে মুছে রাখছেন। ক্ষণে ক্ষণে ভিজে উঠছে চোখের কোনা। মাঝে মাঝেই বেরিয়ে আসছে বন্যার ধারা।

অনেক অনেক দিন, মাস, বছর পর আজ এবাড়ির ছেলেমেয়েরা সব একত্রিত হচ্ছে। ‘চাঁদের হাট’ বসবে আজ তাঁর প্রাচীন ঘরে। চলচ্চিত্রের ফ্ল্যাশব্যাকের মতো মনটা তাঁর হারিয়ে যেতে চায় দূর অতীতে। ডুব দেন তিনি স্মৃতির অতলে।

অচেনা এক তরুণের সাথে গাঁটছাড়া বেঁধে দিয়েছিলেন বাবা। দেখতে দেখতে পাঁচ পাঁচটি দশক পার হয়ে গিয়েছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি সেদিনের কথা!

বেনারসি, জড়োয়া আর কাঁচা ফুলের মালার ভারে পা ফেলতে পারছে না কিশোরী শিউলি। ভাবী চাচীরা মিলে একরকম টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তুলে দেয় ওকে। রঙবেরঙের ফুল আর ফিতায় সাজানো গাড়িতে বসে আছেন অচেনা তিনি। ভয়ে লজ্জায় কাঠ হয়ে থাকে শিউলি। একটু যেন সরে আসে মানুষটা ওর দিকে। হঠাৎই কি যেন হয়ে গেল ? মনে হচ্ছিল, এই মানুষটার ওপর নির্ভর করা যায়। আচমকা হালকা বোধ হতে থাকে।

মানুষটা চলে যাবার আগ পর্যন্ত এই নির্ভরতায় ছেদ পড়েনি কোনদিন।

বছরের পর বছর ‘মা’ না হতে পারার অপবাদে আশপাশের সবাই যখন তাকে আঘাত করেছে, মানুষটা তখন শক্ত করে ধরে রেখেছেন তাকে। আত্মীয়দের পরামর্শে আজমির শরিফ নিয়ে গেলেও সেখানের পাট দ্রুত চুকিয়ে ওকে নিয়ে গিয়েছে তাজমহল দেখাতে। টানা দুই রাত্রি দুই দিন রেলগাড়িতে চেপে চষে ফেলেছেন তাঁরা ভারতের এমাথা থেকে ওমাথা। ঠিক যেন ‘হারিয়ে যাবার নেই মানা’। দোকানের খাবার খেয়ে সিনেমায় যাওয়া, মুক্ত বিহঙ্গের মতো ঘুরে বেড়ানো, সবকিছু যেন স্বপ্নেই ঘটেছিল।

মাসাধিক কালের ভারত সফর শেষে বাড়ি ফেরার পর মাস না ঘুরতেই তাঁদের ঘরে ছড়িয়ে পড়ে অপার্থিব আনন্দ। সে আসছে। বিশেষ কেউ; যার অপেক্ষায় কাটিয়েছিলেন তাঁরা এতগুলো বছর। সেই বিশেষ কেউ, যে তাঁকে মুক্তি দেবে নানান কথার বান থেকে। পরের দশটি বছর এমন অপার্থিব সুখ এসেছে ফিরে ফিরে, চার চার বার। এখন তাঁর দম ফেলবারও সুযোগ নাই। থাকতো যদি দশটা হাত ! আরতো এদের দেশগ্রামে ফেলে রাখা যায় না। বুড়ো বাবামা’র দেখভালের জন্য গিন্নীকে দেশের বাড়িতে রেখে মানুষটা কাজে যেতেন দূরের শহরে। সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে কতো হাঙ্গামা করে বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে মধ্যরাত হয়ে যেতো। গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত নিয়ে বসে থাকতো ‘মালা’ পাটভাঙা শাড়ি পরে। শিউলিকে তিনি ‘মালা’ বলে ডাকতেন। নজরুলের ‘শিউলিমালা’ থেকে ধার করেছিলেন নামটা। চব্বিশটি ঘণ্টা কোনমতে কাটিয়ে ভোরের আলো ফোটার আগেই বেরিয়ে পড়তে হতো তাঁকে। সীমাহীন কষ্ট দুর্ভোগ সবকিছুর মাঝেও মনটা ভরে থাকতো ওদের। অপেক্ষার সময়গুলো স্বপ্নের জাল বুনে বুনে পার করে দিতেন শিউলিমালা। এরমধ্যে বড় ছেলেটা স্কুলে যেতে শুরু করেছে। মেঝকেও দেবার সময় হয়ে এলো বলে। ছোট দুই জনকে নিয়ে একা হাতে কেমন করে সবদিক সামাল দেবেন শিউলি? বাবামা ও বিদায় নিয়ে চলে গেছেন একে একে। আত্মীয় পরিজন, পাড়াপ্রতিবেশী ছুটে আসেন বিপদে আপদে। কিন্তু এভাবে আর কতোদিন ! মেঝ ছেলেটা একটু বেশী দুরন্ত। ওকে চোখে চোখে রাখা যায় না। একদিন পুকুরে পড়ে যায়। এক ভিখিরিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে টেনে ওঠায়। ঘুম নেই শিউলি বেগমের চোখে। শহরে অস্থির সময় কাটে ছেলেমেয়েদের বাবার।

গ্রামের পাট চুকোতে হোল শেষমেশ। দুই কামরার ছোট্ট বাসা ভাড়া করে বউ ছেলেমেয়েকে শহরে নিয়ে আসেন তিনি। সৎ, আদর্শবান, নিষ্ঠাবান, হৃদয়বান মানুষটা দারুণ রুচিবানও ছিলেন। টুকিটাকি জিনিস কিনে ঘরটাকে সাজিয়ে রেখেছিলেন ওদেরকে আনতে যাবার আগে। তবুও খোলা আকাশের পাখি কি আর খাঁচায় থাকতে পারে ! সবকিছু তিনি তাই ভেবেই রেখেছিলেন। তিল তিল করে জমানো টাকা আর কিছু ধারকর্জ করে এক টুকরো জমিও কেনেন।

রাজধানীর বুকে এক খণ্ড জমি হলো। টিনের ছাউনি আর ইটের দেয়ালে ঘেরা ঘরও হলো। উঠোন দেয়া বাড়ির বড় শখ ছিল শিউলির। সেই শখও পূরণ হলো। নানান জাতের ফল ফলাদি, শাক সবজি আর রঙ বেরঙের ফুলে ফুলে দিনে দিনে ভরে ওঠে শিউলি বেগমের আঙিনা। ফল গাছগুলোর মতো চোখের পলকে বড় হতে থাকে তাঁর ছেলেমেয়েরাও। দুই ছেলের পর এক মেয়ে। তারপর আরেক ছেলে। দেখতে সবাই একেকটা দেবশিশু। দুরন্তপনায় ভাইদের চেয়ে এগিয়ে বোনটা। লেখাপড়ায় কেউ কারও চেয়ে কম যায় না। গান, ছবি আঁকা, খেলাধুলো চলে সমানতালে। পরীক্ষার সাফল্যের স্মারক, আর নানা প্রতিযোগিতায় পাওয়া পুরস্কারে ভরে ওঠে তাঁর ঘর। প্রথম দিকে পদকগুলো একসঙ্গে সাজিয়ে রাখার কিছু ছিল না। একদিন ওদের বাবা কাঁচ দেয়া আলমারি গড়িয়ে দেন। বসার ঘরের দেয়ালজোড়া সেই আলমারিও একদিন ভরে ওঠে কানায়কানায়। শিউলিমালার নীড়ে সুখের সীমা নেই।

মূল গল্প

আলমারি গোছানো শেষ হতে না হতেই বাড়ির সামনে হাঁক দেয় গাড়ি। ঐ বোধ হয় এল ওরা। নানান মহাদেশের নামীদামি শহরে বাস ওদের। গতকাল দুপুর, বিকেল, রাতে একেএকে অবতরণ করে ওরা দেশের মাটিতে। মায়ের ঘরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র নেই বলে রাতটা বিলাসবহুল হোটেলে কাটিয়ে আজ বাড়ি এসেছে ওরা। ওদের আর দোষ কি! মায়ের ঘরে যন্ত্রটা বসাবার অনেক চেষ্টা করেছিল ওরা। মা কিছুতেই মত দেননি। অনেককাল শীতের দেশে থেকে থেকে বাংলাদেশের গরম আর ওরা সইতে পারে না। ওদের ছেলেমেয়েদের তো জন্মই ওখানে। দু’চার বছরে দু’চার দিনের জন্য এলেও ঠাণ্ডা যন্ত্র বসানো ভাড়া করা গাড়ি নিয়ে দাদিকে দেখে যায়, আর দিনশেষে ফিরে যায় হোটেলে। শিউলি বেগম ওদের জোর করেন না।

আজও ওরা তাই করবে। তবে আজ মায়ের সঙ্গে একটু বেশী সময়ই কাটাতে আসছে ওরা। মাকে নিয়ে আজ এক বিশেষ জায়গায় যাবে সবাই মিলে। সেজন্যইতো ভাড়া করা হয়েছে বেশ বড় একটা গাড়ি।

খাবার টেবিলে ছেলেমেয়ের পছন্দের সব কিছুই থাকে। মা ভুলে যান সময়ের সাথে অনেকটাই বদলে গিয়েছে ওদের রুচি। এখন ওরা অনেক হিসেবী, সচেতন। তাছাড়া নিজেরাওতো বাবা মা হয়েছে। হরেক রকমের ভর্তা, ভাজি, আচার, শুঁটকি, বড়া পোলাও কোর্মা, পায়েসপড়ে থাকে একইভাবে। কোনটা ছুঁয়ে দেখে, কোনটা চেখে দেখে। যে যার সন্তানের খাবার পানি সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছে। একমাত্র সাদা বউটাই হাত ডুবিয়ে খেতে বসেছে প্রাণ ভরে। অনেক কসরত করে শাড়িও জড়িয়েছে গায়ে। মেয়ে অবশ্য গরমের জন্য ফতুয়াই বেছে নিয়েছে।

খাবার পালা সাঙ্গ হল। এবার মাকে সাজাবার পালা। মায়ের জন্য উপহারের ডালি খুলে বসে ছেলেমেয়েরা। তিনি অবশ্য জীবনসঙ্গীর দেওয়া অনেকদিন আগের প্রিয় একটা শাড়ি বেছে নেন আজকের অনুষ্ঠানে পরবার জন্য। আজকের অনুষ্ঠানটা সত্যিই অনেক বিশেষ। আহা এই দিনে মানুষটা যদি থাকতেন তাঁর পাশে !

ছেলে মেয়ে জামাতা পুত্রবধু আর নাতি নাত্নি নিয়ে পনের জনের বিশাল বহর নিয়ে রওনা করেন তিনি পড়ন্ত বিকেলে। রাত নামলেই অনুষ্ঠান। নিয়ন আলোয় সাজানো মঞ্চ। কত নামী দামী মানুষ চারদিকে! পরিপাটি পোশাকে সুখি সুখি চেহারা নিয়ে হেঁটে বেড়ায়, জটলা পাকিয়ে আলাপে মাতে। কেবল তাঁর মুখেই কথা সরে না।

যথাসময়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। অভ্যর্থনা আর বৃক্ততা পর্ব শেষে ঘোষকের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় তাঁর নামএ পর্যায়ে রত্নগর্ভার পুরস্কার গ্রহণ করতে মঞ্চে আসছেন

পা জড়িয়ে আসে শিউলি বেগমের। মেয়েই দাঁড় করিয়ে দেয় হাত ধরে। মুহুর্মুহু করতালির মধ্য দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে যান তিনি মঞ্চের দিকে। স্বনামধন্য এক তারকা অভিবাদন জানান তাঁকে হাসিমুখে। পুরস্কার তুলে দেন শ্রদ্ধাবনত চিত্তে। করতালি আর আলোর ঝলকানির মাঝে ছবি তোলার যন্ত্রগুলোর বিরামহীন ক্লিক ক্লিক। ঘোরের মতো কেটে যায় কয়েকটি ঘণ্টা।

এবার ঘরে ফেরার পালা।

কোথায় ঘর ? কার ঘর?

মাকে তাঁর ঘরে নামিয়ে দিতে আসে ছেলেমেয়েরা। তার আগে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সবাই মিলে রাতের খাবার সেরে নেয় এক নামী রেস্টুরেন্টে। এখানেও চলে আলোর খেলা আর ক্রমাগত ক্লিক ক্লিক। পুরস্কার স্মারক নিয়ে ছবি তোলা হয় সপরিবারে। সুখি পরিবারের দুর্লভ স্থিরচিত্র মুহূর্তেই ছড়িয়ে যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। একজন রত্নগর্ভার স্বীকৃতি পাওয়া মা শিউলি বেগমকে নিয়ে গর্বের শেষ নেই ছেলেমেয়েদের।

শেষের গল্প

রাত গভীর হয়। নিজ হাতে সাজানো গৃহে একা বসে নির্ঘুম রাত পার করেন রত্নগর্ভা মা। গর্ভে ধরা তাঁর রত্নরা সব আলো ছড়িয়ে চলেছে পৃথিবীময়। তাঁর ঘরে ভর করে আছে নিঃসঙ্গ অন্ধকার। তবে একেবারেই নিঃসঙ্গ নন তিনি। কুড়িয়ে পাওয়া আদুরীর পিতৃপরিচয়হীন সন্তান সুরুজই এখন তাঁর ঘরের আলো, হাতের লাঠি।

ছেলেমেয়েদের ওপর কোন রাগ নেই শিউলি বেগমের। ওরাতো তাঁকে সঙ্গেই নিয়ে যেতে চায়। এতো দিনের তিল তিল করে গোছানো সংসার ছেড়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে যেতে মন সায় দেয় না তাঁর। যদিও বেশ বুঝতে পারেন চোখ বোজার পর তাঁর হাতে গড়া এসংসারের কোন অস্তিত্বই থাকবে না। রাত্রিযাপনের জন্য ছেলেমেয়েরা তাদের স্ত্রীকন্যা, স্বামীপুত্র নিয়ে ফিরে যায় পান্থনিবাসে। কাল দুপুরে আবার আসবে ওরা। বিদায় নিতে। না, কালই ওরা দেশে ছাড়ছে না। নিজ নিজ বাসস্থানে ফিরে যাওয়ার আগে পরিবার পরিজন নিয়ে দেশের দর্শনীয় স্থানগুলো পরিদর্শন করবে, ছেলেমেয়েদেরকে বাংলাদেশ চেনাবে। ফিরে যাবার আগে আবারও আসবে। ভাই বোনেরা মিলিত হবে বিশেষ বৈঠকে। এ বাড়ি ভেঙে নির্মিত হবে বহুতল ভবন। আলোচনা তাই নিয়ে।

প্রভাতের আলো ফোটে একই নিয়মে। প্রতিদিনের মতো শিউলি বেগম নামাজ দোয়া কোরআন পাঠ শেষে উঠোনের দিকে পা বাড়ান। দরজা খোলার আগে চোখে পড়ে যায় গত রাতের স্মারকটিরত্নগর্ভার পুরস্কার। ছুঁয়ে দেখেন কাঁপা হাতে। এ পুরস্কার তিনি কোথায় রাখেন! ভাবনায় পড়ে যান মা। কোনটা বেশী মূল্যবানছেলেমেয়েদের পাওয়া মেডেলগুলো, না কি বেলাশেষে পাওয়া তাঁর এই পুরস্কার? পুরস্কার কি সত্যিই তাঁর ! পুরস্কারের ভারই বা কতদিন বয়ে বেড়াবেন তিনি?

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিগগিরই শুরু হবে নতুন ব্রিজ নির্মাণের কাজ
পরবর্তী নিবন্ধ‘যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব’