মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে প্রয়োজনীয় সংযোজন যুদ্ধ ও নারী

কাজী রুনু বিলকিস | শনিবার , ৪ জুন, ২০২২ at ৫:২৪ পূর্বাহ্ণ

বইটি একাত্তরের বাংলাদেশে সংঘটিত নারী নির্যাতন ও ক্ষতিগ্রস্তসহ নারীদের সাক্ষাৎকারভিত্তিক লেখা। এম এ হাসান দেশের ৪২ টি জেলার ৮৫ টি থানার অসংখ্য সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। তার থেকে বেছে নেওয়া হয়েছে ৭২টি সাক্ষাৎকার। সংগত কারণে সাক্ষাৎকারে কয়েকজনের নামপরিচয় গোপন রাখা হয়েছে। এই বইয়ে আরও রয়েছে যুদ্ধের নয় মাসে ভারত ও পার্শ্ববর্তী অন্যান্য দেশে আশ্রয় গ্রহণকারী নির্যাতিত শরণার্থী নারীদের সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান। সামগ্রিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে একাত্তরের নয়মাসে চার লাখেরও বেশি নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নির্যাতিতদের শারীরিক ও মানসিক সমস্যাগুলো সহ বিভিন্ন সামাজিক জটিলতাও তুলে এনেছেন এই গবেষণায়। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে নির্যাতিত নারীদের প্রতি দায়িত্ব পালনে আমাদের ব্যর্থতার বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করেছেন চমৎকারভাবে। কত ত্যাগ আর কী অপরিসীম দুর্দশার মধ্য দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা এসেছে তারই মর্মন্তুদ ডকুমেন্টেশন ‘যুদ্ধ ও নারী’ বইটি। প্রাণ বাঁচানোর জন্য এক বিশাল জনগোষ্ঠী ভীত সন্ত্রস্ত হতবিহ্বল হয়ে যে যেদিকে পারে পালিয়ে গেছে। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগই ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। তারা সহায় সম্বল, ঘরবাড়ি ছেড়ে শত শত মাইল অতিক্রম করে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে সীমান্ত অতিক্রম করতে বাধ্য হন। পেছনে পড়ে থাকে প্রিয় স্বদেশ, প্রিয় সংসার, চলাচল অক্ষম স্বজন। এই অনিশ্চিত দীর্ঘ যাত্রার পথে পথে অনেকেই আবার সন্তানসন্ততি বৃদ্ধ মাবাবা ও নিকট আত্মীয়দের হারিয়ে ফেলে। পৃষ্ঠা ৩৮ থেকে – ‘শরণার্থী নারীদের দুর্বিষহ পথের চিত্র পাওয়া যায় চট্টগ্রামের বেগম মুশতারী শফীর সাক্ষাৎকার থেকে। এপ্রিলের শেষের দিকে পাকিরা তাঁর স্বামীকে ধরে নিয়ে গেলে ছোট ছোট সাতটি ছেলেমেয়ে নিয়ে তিনি বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান। সীমাহীন কষ্ট ও যন্ত্রণা দগ্ধ পথ পেরিয়ে একসময় তিনি সীমান্তে গিয়ে পৌঁছান। সীমান্তরেখার ওপর বাচ্চাদের পার করার দুঃসহ বর্ণনা দেন এভাবে– ‘হাজার হাজার শরণার্থী পায়ে হেঁটে এগিয়ে চলেছে । আমার এক মেয়ের তখন একশ তিন জ্বর, এক ছেলের ডায়রিয়া। ওষুধপত্রের কোন ব্যবস্থা নেই। কি যে দুরবস্থা! এমন সময় আবার গুলির শব্দ! মাথার উপর দিয়ে সাঁই সাঁই করে ছুটে যাচ্ছে গুলি। আমরা একবার এদিক আরেকবার ওদিকে দৌড়াচ্ছি। আমার অসুস্থ দুই বাচ্চার জন্য দশ টাকা করে দুটো লোক ঠিক করা হলো লোক দুটি তাদের নিয়ে চললো। এভাবে যেতে যেতে সন্ধ্যার সময় আমরা বর্ডারে গিয়ে পৌঁছালাম। ওপারে একটা বাড়ি দেখতে পেলাম। সেখান থেকে লোকজন ‘আইয়ে মাইজী, আইয়ে বলে ডাকছিল। যেখান থেকে পার হতে হবে সেই জায়গাটা একটু দূরে। মাঝখানে একটা ছোট খালের মতো। ঐ লোকদের মাথাপিছু দশ টাকা করে দিলে পার করে দিচ্ছে। এপার থেকে বাচ্চাদের ছুড়ে দিচ্ছে ওপারের বিএসএফ এর সদস্যরা ধরে নিচ্ছে। আমার এক একটা বাচ্চা ওরা এভাবে ছুড়ে দিচ্ছিলো আর মনে হচ্ছিল আমার কলিজাটা বুঝি ছিঁড়ে গেলো। বাচ্চারা সবাই পার হয়ে গেলে আমার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেলো। মনে হলো এখন যদি কোন বিপদ হয় আমি যদি ওপারে যেতে না পারি তাহলে ওদের কি হবে! তারপর আমি কোমরে কাপড় জড়িয়ে খালের পানিকাদা ভেঙে কীভাবে যে পেরিয়ে গেলাম বলতে পারব না। পার হয়েই আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।’

এছাড়াও আছে ক্ষতিগ্রস্তা ও ভুক্তভোগী নারীদের হৃদয় বিদারক জবানবন্দি। পাকিস্তানী সেনারা সকল পৈশাচিকতার মাত্রা ছাড়ায়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে কমপক্ষে দশ হাজারের বেশি বই বের হয়েছে। এর অতি ক্ষুদ্র অংশ রয়েছে ইংরেজিতে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে আমরা সেইরকম গুরুত্বের সাথে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে পারিনি পঞ্চাশ বছরেও।

. এম এ হাসান একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী একাধারে মানবাধিকার কর্মীও। ’৭১এর গণহত্যা, নারী নির্যাতন ও বর্বরতার ডকুমেন্টেশন ‘যুদ্ধ অপরাধ গণহত্যা’ ও বিচারের অন্বেষণ ও ‘যুদ্ধ ও নারী’ তাঁর দুটি শ্রেষ্ঠ রচনা। ২০১৬ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন। যুদ্ধ ও নারী অসাধারণ একটা বই। ৭১এর নয় মাসের যে ভয়ংকর তথ্যচিত্র পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন পাঠক নতুন করে মুক্তিযুদ্ধকে অনুভব করবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসুফি মিজানকে নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটির সংবর্ধনা
পরবর্তী নিবন্ধরাতের ট্রেনে ব্যাংকক থেকে চ্যাংমাই