রাতের ট্রেনে ব্যাংকক থেকে চ্যাংমাই

শরণার্থী, নারীবাদ এবং একজন নারী ভ্রমণকারীর গল্প

রূপা দত্ত | শনিবার , ৪ জুন, ২০২২ at ৫:২৪ পূর্বাহ্ণ

সকালে চ্যাং মাইয়ের টিকেট কাটতে স্টেশানে গিয়ে দেখি, রাতের টিকেট বিক্রি শুরু করেনি। স্টেশানের ভেতরে গিয়ে বসে বসে মানুষ দেখতে লাগলাম। স্থানীয় যারা ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছে, তাদের দেখলেই ধারণা করা যায় বেশীরভাগ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভাল না। আবার অন্যভাবে বলতে গেলে, সমাজের খেঁটে খাওয়া শ্রেণির মানুষ সব। আর আছে নানান দেশের পর্যটক। থাইল্যান্ডে ডোমেস্টিক বিমান খরচ তুলনামূলক বেশ কম আর প্রায় সব বড় বড় শহরেই বিমান চলাচল আছে। দূরপাল্লার ভ্রমণের জন্য ট্রেনের ব্যবহার নিতান্ত বাধ্য না হলে কেউ করে না, আর এই নিতান্ত বাধ্য শ্রেণি হল নিম্নবিত্ত থেকে নিম্ন মধ্যবিত্ত। ট্রেনে করে চ্যাংমাই যাবো শুনে এক সহকর্মী নিরুৎসাহ দিয়েছিল ট্রেন খুব আস্তে চলে বলে। কিন্তু, বিভিন্ন ভ্রমণ সংক্রান্ত ব্লগে ব্যাংকক থেকে চ্যাংমাই ট্রেন ভ্রমণের ভূয়সী প্রশংসা করেছে স্বল্প খরচের এডভেঞ্চার প্রিয় ভ্রমণকারীরা। ট্রেন প্রসঙ্গে কথা উঠতেই, আমার সেই থাই সহকর্মী সরকারের দুর্নীতি নিয়ে রাগ আর হতাশা ঝাড়ছিল। সে বলছিল, ব্যাংকক শহরের মেট্রো রেল আর সাবওয়ের উন্নতির জন্য সরকার অর্থ বরাদ্দ দিলেও, আমলা আর নেতাদের দুর্নীতির কারণে সেই উন্নতি সাধারণ জনগণ কখন চোখে দেখবে তা অনিশ্চিত। আর পর্যটন বান্ধব করার জন্য বিমান খাতে এত বেশি মনোযোগ দেয়া হয়েছে যে, ট্রেনের কথা কারো মনেই নাই।

আমি রাতের টিকেট কেটে ফিরে এলাম। দুটো ব্যাকপ্যাকে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে নিলাম। বড় ব্যাগ সামনে আর ছোট ব্যাগ পেছনে নিলে হাঁটার আসুবিধা হবে না। পশ্চিমা ভ্রমণকারীদের কাছে শুনেছি তাদের মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ভ্রমণ করার গল্প। কিন্তু, নিজেও যে এভাবে ভ্রমণে বের হতে পারব, কয়মাস আগেও সেটা ভাবিনি। একটা লেখায় পড়েছিলাম লম্বা ভ্রমণে বের হওয়ার আগে কীভাবে ব্যাগের ওজন কমাতে হবে। গুছানো ব্যাগের সব জিনিস নামিয়ে আবার চেক করতে হবে আসলেই কি সব প্রয়োজন আছে? এ পদ্ধতিতে, বেশ কিছু জামা কাপড়, স্যান্ডেল কমাতে পারলাম। একটা ছোট তাঁবু আর স্লিপিং ব্যাগ নিয়েছি সাথে, যদি প্রয়োজন হয় তাহলে যাতে বিপদে পড়তে না হয়। ব্যাংককের পুরানো জিনিসের বাজার ঘুরে এক জোড়া পাহাড়ে চড়ার জুতা কিনেছিলাম, সেটাও সাথে নিয়ে নিলাম। এর মাঝে পাশের দেশ ক্যাম্বডিয়া এবং লাওসের ভিসা নিয়ে নিয়েছিলাম, আর মালেশিয়ার ভিসা নিয়েছিলাম আরও আগে। ভ্রমণকারীরা সাধারণত এইসব দেশে ল্যান্ড বর্ডার পার হয়েই যায়, কিন্তু বাংলাদেশীরা কেবল বিমানে করেই যেতে পারবে। বাংলাদেশ থেকে এত মানুষ এইসব বর্ডার দিয়ে এক দেশ থেকে আরেক দেশে অবৈধভাবে গেছে যে, স্থলপথে সব বাংলাদেশীদের ভ্রমণই নিষিদ্ধ করে দিয়েছে দেশগুলো। অফিসের কাজে আমাকে মাসে অন্তত একবার হলেও মালেয়েশিয়ার সীমান্তে যেতে হত, সহকর্মীরা মালয়েশিয়া ঘুরে আসার পরিকল্পনা করত, আবার আমার মত বাংলাদেশী সহকর্মীদের কথা ভেবে পরিকল্পনা বাতিল করে দিল।

বিকেল করে স্টেশানে চলে গেলাম। যেকোনো স্টেশান আমার ভালো লাগে। কত মানুষ কত গন্তব্যে ছুটে যাচ্ছে কতরকম কাজে! এত সব মানুষের কত শত গল্প ছড়িয়ে আছে চারদিকে! ট্রেনে আমার সামনের সিটে বসেছেন দুইজন বয়স্ক নারী। ওদের পরনে থাইল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী থামি। কোন অনুষ্ঠানের বাইরে, এই প্রথম কোন নারীকে দেখলাম থামি পরতে। আমার পাশেও বসেছে একজন নারী। দুলে দুলে ট্রেন চলতে শুরু করল বাংলাদেশের ট্রেনের মত। একজায়গায় ট্রেন চলছে একটা বাজারের ভেতর দিয়ে, ঠিক যেমনটা আমাদের দেশে হয়, রেল লাইনের পাশের বাজার তারপর আস্তে আস্তে শহর ছড়িয়ে বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ। একটা স্টেশানে ট্রেন থামল, সম্ভবত হুয়াহীন স্টেশান। ট্রেন থামতেই ফেরিওয়ালা উঠে এলো এটা সেটা বিক্রি করতে। সবাই রাতের খাবার খেয়ে নিচ্ছে। আমিও এক প্লেট নুডুলস খেয়ে নিলাম। এখানকার মানুষ পর্যটক দেখতে দেখতে, ওদের পর্যটকদের নিয়ে কোন কৌতূহল কাজ করে না। আবার ইংরেজি খুব কম মানুষ জানে বলে কথোপকথনের সুযোগও কম। আমি সাথে রাখা বই খুলে বসি। একসময় যখন ঢাকাচট্টগ্রাম ট্রেনে করে যাওয়াআসা করতাম, তখন সাথে রাখতাম সেবা প্রকাশনীর বই। কিশোরীবেলায় সাথে থাকতো তিন গোয়েন্দা, কলেজে পড়ার সময় ওয়েস্টার্ন, সেবা রোমান্টিক আবার সবার সামনে পড়া যেত না কেউ হালকা ভাববে বলে, আর একটু বড় হবার পর মাসুদ রানা। বয়সের সাথে অবশ্য মাসুদ রানা পড়ার কোন সম্পর্ক নেই। আমার পরিবারে কি বই পড়ছি তা নিয়ে কারো মাথা ব্যথা ছিল না। অনেক বন্ধুদের কাছে শুনতাম ওদের ঘরের বড়রা পড়ার বইয়ের বাইরে অন্য বই পড়া পছন্দ করে না। তবে আমার বন্ধু কপাল ভালো, সব বন্ধুরাই বই পড়ত, ফলে সবার বই মিলে অনেক বই হয়ে যেত। আর সেবার বই তো ভাড়াই নেয়া যেত সপ্তাহ হিসেবে। এতবছর পরে কেমন নস্টালজিয়া পেয়ে বসেছিল। রাতের দিকে বিছানা করে দিয়ে গেল। আমার সিট উপরের ব্যাঙ্কে। উপরে উঠে রীতিমত থতমত খেয়ে গেলাম। ধোয়া বিছানার চাদর, বালিশের কাভার, সাথে কম্বল। সব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। মনে হল চলন্ত কোন হোস্টেলে আছি। পাশে আবার পর্দা দিয়ে প্রাইভেসি রক্ষা করা হয়েছে।

সকালে ঘুম ভাঙল নাস্তা খাওয়ার ডাক শুনে। ট্রেনের ভেতরে গরম গরম খাবার। নিচের সিটে নেমে এলাম। ট্রেনের কর্মচারীরা বিছানা গুছিয়ে চাদর, বালিশের কাভার, কম্বল সব নিয়ে গেল। বাইরে তাকাতেই মাথা ঘুরে যাওয়ার অবস্থা। পাহাড়ি পথ ধরে ছুটে চলেছে ট্রেন। যতই দেখছি, মুগ্ধতা আর ফুরাচ্ছে না। একটা জায়গায় ট্রেনটা প্রায় ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যায়, জানালা দিয়ে অর্ধবৃত্তাকার ট্রেনটাকে দেখা যায়। ট্রেন ছুটছে তো ছুটছেই। এক জায়গায় সরু টানেলের ভেতর দিয়ে ছুটে চলছে। টানেলে ঢুকতেই সব অন্ধকার। টানেলের শুরু যেখানে, সেখানে পাহাড়ের কোনায় একটা ছোট্ট মন্দিরমতো। গুগল করে জানলাম এই মন্দিরে পাহাড়ের দেবতার পূজা করা হয়। এক স্টেশানে ট্রেন কিছুক্ষণ থামল কি একটা সমস্যার জন্য। মানুষজনও নেমে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করছে। এই অঞ্চলে আবার বিচ্ছিন্নতাবাদী কিছু দল আছে। থাইল্যান্ডের দক্ষিণে যেমন মালয় মুসলিমরা আলাদা হয়ে যেতে চায়, তেমনি, উত্তরে কিছু পাহাড়ি গোষ্ঠীও আলাদা রাজ্য গড়তে চায়। তবে, পূর্বের চেয়ে অনেক কমেছে। তথাপিও কখন কখনো চোরাগুপ্তা হামলা হয়। তাই, কিছু হলে মানুষ একটু ভয় পায়। বেশ কিছুক্ষণ পর জানা গেল, পুলিশের হাত থেকে দুইজন বিচ্ছিন্নতাবাদী পালিয়েছিল, তারা এইদিকেই এসেছে, ওদের খোঁজে পুলিশ তল্লাশি করছে, তাই সাময়িকভাবে ট্রেন চলাচল বন্ধ রেখেছে। প্রায় আধা ঘণ্টা চল্লিশ মিনিট পর ট্রেন চলা শুরু করল।

একটু বেলা করে এসে পৌঁছালাম চ্যাংমাই রেল স্টেশানে। স্পাইসিরোডের সদস্যরা যেখানে উঠেছে, ট্যাক্সি ঠিক করলাম ওদের সাথে যোগ দিতে।

নোটএই ভ্রমণগল্প ২০১৭ সালের। বর্তমানের পরিস্থিতির সাথে পার্থক্য থাকতে পারে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে প্রয়োজনীয় সংযোজন যুদ্ধ ও নারী
পরবর্তী নিবন্ধহালিশহরে মোহাম্মদীয়া দরবারের ওরশ