লাল সূর্য

অনিন্দ্য আনিস | বুধবার , ১ মে, ২০২৪ at ৬:৪১ পূর্বাহ্ণ

ভোরের আলো উদিত হওয়ার আগেই সব গোছানো প্রায় শেষ। এবার গন্তব্যের দিকে যাত্রার পালা। মাবাবা, বউদি, ছোটবোন, নিষ্পাপ ভাইঝি অরুনা, ভাইপো উদয়সহ শেষবারের মতো সবাই যখন আঙিনায় দাঁড়িয়ে এক দীর্ঘশ্বাস ভিটামাটির বৃপরস প্রাণভরে নিচ্ছিলাম। তখনই বুটের শব্দে রাস্তা ভারী হয়ে গেল। উদয় ভাইপোটা তখনও আঙিনায় বসে মনের মাধুরি দিয়ে একটা মানচিত্র আঁকিবুকি করে সেখানে পরিবারের সবার নাম লিখছে।

তার ছোটকাকা কালীপদ বসে আছে। এরই মধ্যে বুটের শব্দ ক্রমে ক্রমে বাড়ির গলিপথে আসতে শুরু করল। গলিপথে শুয়ে থাকা দীর্ঘদিনের বিশ্বাসী কুকুরটা আচমকা ঘেউঘেউ করতে লাগল। পাকিস্তানিদের প্রথম সাক্ষাৎ হয় কুকুরটার সাথে।

হঠাৎ গুলির শব্দ। ভিতরটায় একটা প্রাণী মারা গেল। ক্রমে বিশ্রী আওয়াজে গড়গড় করে ১০১২জন মিলিটারী গৃহে প্রবেশ করল। তখনও কালীপদ বসে। বাড়ির আঙিনায় ডুকার আগেই মাবাবা, বউদি, অরুনা যার যার ঘরে লুকিয়ে গেল। কিন্তু উদয় আঙিনায় নিস্তব্ধ হয়ে মানচিত্র এঁকেই যাচ্ছে।

মিলিটারী মানচিত্র দেখতে পেয়ে দুজন ওই মানচিত্র দুদিক দিয়ে টেনে দু’ভাগ করে ফেলল। কষ্টসিক্ত কণ্ঠে উদয় বলল, ‘এই মানচিত্রেই লেখা আছে আমার নাম উদয়। একদিন এই ভূখণ্ডে নতুন করে একটা দেশ উদয় হবে। এই রক্তে উদয় হবে স্বাধীনতার লাল সূর্য। কতকিছু ঘটে যাওয়ার পরেও কালীপদ আড়ালে বসে ছিল। অসহায় কালীপদ প্রাণ বাঁচাতে কোনো উপায় না পেয়ে আস্তে আস্তে ঘন ঝোপের আড়ালে মধ্যে ডুকে গেল। মাথাটা হাল্কা বাহির করে কালীপদ আড়াল থেকে দেখছিল। কিছুক্ষণ পরে উদয়ের দাদুভাইকে ঘর থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে একটা বকুল গাছের সাথে বেঁধে ফেলল। এর পরপরই দাদীমাকেও বেঁধে ফেলল ।

তারপর চলল বড় ঘরের দিকে, সেখান থেকে বউদিকে আর বোনকে ধরে আনল। তাদের উপর চলল অমানবিক অত্যাচার। এই দৃশ্য দেখে মাবাবা বকুল গাছের ডগায় উল্টো করে মাথা খুঁড়ে মরার পাঁয়তারা করছিল। কিন্তু কথায় আছে না, অভাগা যেদিকে যায় সেদিকে নদী শুকিয়ে যায়। ঠিক এমনিভাবে তারা আর মরতে পারল না। শুরু হলো বিশ্রী ভাষায় গালাগালি। কিন্তু কী হবে এতে, জানোয়াররা তো আর এইসব বুঝে না। পশুরা কি আর এতসব বুঝে! যদি বুঝত তাহলে প্রকাশ্যে এভাবে অত্যাচার কখনো করত না। জানোয়াররা কখনো কুকুরের মতো আবার কখনো আষাঢ়ের ঝড়ের মতো মেতে উঠেছিল। একসময় জানোয়াররা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পশুরা কি আর ক্লান্ত হয়?

হয় না। তাই তারা অত্যাচারের পর অত্যাচার চালাতে লাগল। এরই মধ্যে রক্তে রক্তাক্ত হলো বাড়ির আঙিনা। জানোয়ারগুলো উল্লাসে মেতে উঠল। বন্দুকের গুলিতে ক্ষতবিক্ষত করে দিলো বউদি আর অরুনাকে। কত আদরের পায়রাগুলি মারা গেলো। তা কালীপদদা চেয়ে চেয়ে দেখছে।

স্বাধীনতার শুরুর ইতিহাস। স্বাধীনতা প্রাপ্তির নিঃস্বার্থ নিবেদন। সব কোলাহল শেষ হলো। ওরাও চলে গেল। সমস্ত গায়ের ময়লা কালীপদ বাড়ির পাশের ডুবায় ধুয়ে পরিষ্কার করে বাড়িতে ফিরে এল। এবার প্রচণ্ড শব্দে বলতে লাগলউদয়! উদয়! সবই তো এখন অস্ত গেল । কালীপদ নির্বাক।

একটা কথাও বলেনি কারো সাথে। মনে ক্ষোভ নিয়ে, যুদ্ধে নেমে পড়ল। অবশেষে নয়মাস যুদ্ধ করে দেশ করল স্বাধীন। মুহাম্মদ বাশাক মলারগীকে বললেন, ‘দাদা চলুন এবার বাড়ি ফিরে যাই। সহযোদ্ধা মুহাম্মদ বাশাক মলারগী দেখেন কালীপদের দুচোখে ওর মাবাবা, বউদি, বোন অরুনা, উদয় সচ্ছ জলে ছলছল করছে। সহযোদ্ধা কালীপদকে বুকে নিয়ে বললেন, ‘কালীপদ তুই আমাদের বাংলাদেশ।

যাবাড়ি ফিরে যা। অবশেষে কালীপদ বাড়িতে গেল। প্রথমে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ডাকল, উদয়! উদয়! ভাইপো আমার দেখ, তোর স্বাধীনতার লাল সূর্য বাংলার আকাশে হেসেছে। এই দেখ তোর আঁকা মানচিত্র আজ বাংলাদেশ নামে উদয় হয়েছে। সেই থেকে এই বাংলাদেশের এক যোদ্ধা হিসেবে কালীপদ ভূষিত হয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রিমিয়ার ভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের সাহিত্য সেমিনার
পরবর্তী নিবন্ধআমি শ্রমিক চাষী