মাতৃভাষা আন্দোলন স্বজাত্যবোধের উৎসপ্ররোহ

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী | বুধবার , ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ at ১০:৫১ পূর্বাহ্ণ

এটি সর্বজনবিদিত যে, প্রায় তিন হাজার বছর বাংলা নামক এই জনপদের সুপ্রাচীন সমাজ ইতিহাস শোষণবঞ্চনার জ্ঞাপিত আবরণ। আর্যদ্রাবিড়রাঢ়মৌর্যতুর্কিপাঠানমোগলইংরেজপাকিস্তানসহ বিভিন্ন ভিনদেশী শাসকশোষকের দ্রোণাক্রান্ত যন্ত্রণায় ক্ষুভিত জনগোষ্ঠীর নীরব ক্রন্দন এই অঞ্চলের মাটিকে করেছে অশ্রুউর্বর। নিস্পন্দ পর্যাবৃত্ত কালক্রমে বহির্মুখ ঔপনিবেশিক লুন্ঠন ও দেশভাগান্তর সামরিকবেসামরিক আমলাতন্ত্রের নিষ্পেষণে বাঙালি জাতি পাকিস্তান নামক সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের নতুন অনীপ্সিত অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ পরিখায় পরাশ্রিত। এর বিরুদ্ধে ত্বরিত প্রতিবাদ ছিল ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালে করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান সংবিধান সভায় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রথম বজ্রকঠিন প্রক্ষিপ্ত প্রস্তাব। আগামী প্রজন্মের হৃদয় গভীরে দীপ্র করার মানসে বিষয়সমূহের পুনরোল্লেখ অনিবার্যভাবে নিবন্ধ উপস্থাপনায় প্রতিফলিত।

বাঙালি জাতির মাতৃভাষা বাংলা। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে বিশাল আত্মত্যাগের মহিমা বাঙালি জাতির জন্য শুধু গৌরবগাঁথা নয়, এটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে গ্রহণ করে সমগ্র বিশ্ব আজ গৌরবদীপ্ত হয়েছে। বাঙালি জাতির জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ, বিকাশ ও প্রসারে এই মাতৃভাষার অবদান শুধু ঐতিহ্য বা কৃষ্টিমন্ডিত নয়, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জাতিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য এই ভাষার অবদান এক অসাধারণ চেতনায় বিশেষ বৈশিষ্ট্যমন্ডিত হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পটভূমিতে দীর্ঘ সংগ্রামের পথপরিক্রমায় ঋদ্ধ প্রাণশক্তিতে পরিপুষ্ট হয়ে মাতৃভাষা বাংলা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের শক্ত ভীত হিসেবে বিবেচিত। একুশের চেতনায় ভাস্বর মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক নীতিসমূহ তথা সংবিধানসম্মত জাতিসত্ত্বার প্রধান চার স্তম্ভ জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে জাতি তাদের সামগ্রিক আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির সনদ হিসেবে গ্রহণ করেছে।

১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রয়াত হওয়ার আগেই ১৯ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসে ঢাকায় ঘোড় দৌড় মাঠে অনুষ্ঠিত সভায় ঘোষণা দিলেন ‘উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে’। পরবর্তী নির্যাতননিপীড়নের প্রেক্ষিতে অহিংস এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক কৌশলের ধারাবাহিকতায় সূচিত হল রক্তস্নাত ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির মাতৃভাষার অধিকার অর্জনে পুণ্যাকাঙ্খা। বাঙালির জাতীয়তাবাদের উম্মেষে দ্রোহ ও আলো প্রজ্জ্বলনের বিজনন। প্রচিত হল গণতান্ত্রিকঅসাম্প্রদায়িকমানবিক ও শোষণমুক্ত সমাজরাষ্ট্র বিনির্মাণের লক্ষ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং চূড়ান্তভাবে সংঘটিত ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত লালসবুজের পতাকাখচিত বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন মাতৃভূমি।

১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ প্রথম রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হয়। একই দিন রাষ্ট্রভাষার দাবিতে প্রথম হরতাল কর্মসূচীতে পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে প্রতি বছর ১১ই মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরই আলোকে ১৯৪৯, ১৯৫০ ও ১৯৫১ সালে ক্রমান্বয়ে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ বারের মত রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হয়। উল্লেখ্য যে; ১১ই মার্চের আন্দোলন ঢাকাসহ পূর্ব বাংলার সব জেলাতেই জাগরণ সৃষ্টি করে। বঙ্গবন্ধু বলেছেন “আমি ফরিদপুর, যশোর হয়ে দৌলতপুর, খুলনা ও বরিশালে ছাত্রসভা করে ঐ তারিখের তিন দিন পূর্বে ঢাকায় ফিরে এলাম। দৌলতপুরে মুসলিম সমর্থক ছাত্ররা আমার সভায় গোলমাল করার চেষ্টা করলে খুব মারপিট হয়, কয়েকজন জখমও হয়। এরা সভা ভাঙতে পারে নাই, আমি শেষ পর্যন্ত বক্তৃতা করলাম। এ সময় জনাব আবদুস সবুর খান আমাদের সমর্থন করছিলেন”।

মূলতঃ পাকিস্তান সৃষ্টির পর প্রথম এই হরতাল কর্মসূচি এক নতুন মাত্রিকতায় এ দেশের জনগণের আন্দোলনঅনুভূতিকে শুধু উজ্জ্বীবিত করেনি, এমন এক অত্যুজ্জ্বল অধ্যায় নির্মাণ করেছে যাতে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ১৫ই মার্চ রাষ্ট্রভাষা চুক্তি করতে বাধ্য হয়। হরতালের দিন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় শতকরা প্রায় নব্বই ভাগ শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে ইডেন বিল্ডিং, জেনারেল পোস্ট অফিস ও অন্যান্য জায়গায় পিকেটিং করার দায়িত্ব বন্টন করে দেয়া হয়। সচিবালয়ে পিকেটিং করা কালে প্রথম গেইটে বঙ্গবন্ধু, শামসুল আলম, অলি আহাদ, দ্বিতীয় গেটে কাজী গোলাম মাহবুব, খালেক নওয়াজ, শওকত আলী প্রমূখ পিকেটিং করেন। অন্যসব স্থানে একই রকম পিকেটিং পরিচালনা করেন অধ্যাপক আবুল কাশেম ও মির্জা মাজহারুল ইসলামসহ প্রমুখ। এ সময় বঙ্গবন্ধুসহ পিকেটিং ও বিক্ষোভে অংশ নেয়া প্রায় সকল নেতাকর্মী গ্রেফতার হন।

পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহবায়ক নাঈমুদ্দীন আহমদ এক বিবৃতিতে দাবী করেন যে, হরতাল চলাকালীন সময়ে মুসলিম লীগের ভাড়াটিয়া গুন্ডা বাহিনীর হাতে প্রায় আঠার জন গুরুতর এবং প্রায় দুইশত জন আহত হন। এ সময়ে নয়শত জনের মত নেতাকর্মীকে জেলবন্দী করা হয়। বঙ্গবন্ধুর বর্ণনামতে ‘যে ওয়ার্ডে আমাদের রাখা হয়েছিল, তার নাম চার নম্বর ওয়ার্ড। তিনতলা দালান। দেওয়ালের বাইরেই মুসলিম গার্লস স্কুল। যে পাঁচ দিন আমরা জেলে ছিলাম সকাল দশটায় মেয়েরা স্কুলের ছাদে উঠে স্লোগান দিতে শুরু করত, আর চারটায় শেষ করত। ছোট্ট ছোট্ট মেয়েরা একটু ক্লান্তও হত না। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘বন্দি ভাইদের মুক্তি চাই’, ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’নানা ধরণের স্লোগান। এই সময় শামসুল হক সাহেবকে আমি বললাম, “হক সাহেব ঐ দেখুন, আমাদের বোনেরা বেরিয়ে এসেছে। আর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করে পারবে না।” হক সাহেব আমাকে বললেন, “তুমি ঠিকই বলেছ, মুজিব।”

১৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে বিখ্যাত আমতলায় অনুষ্ঠিত সভায় সংগ্রাম পরিষদের সাথে স্বাক্ষরিত আপোষ চুক্তির সকল শর্ত অনুমোদিত হয়। জেলে বন্দী অবস্থায় অনশন শুরু করে বঙ্গবন্ধু মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার যে আমরণ পণ করেছিলেন, শত দুঃখ দুর্দশাজেলে পুলিশ কর্তৃক জবরদস্তিমূলক নাকে নল দিয়ে পেটে খাবার ঢুকানের যে কঠিন যন্ত্রণার কথা বঙ্গবন্ধু বর্ণনা করেছেন তা কিন্তু যে কোন দেশপ্রেমিক মানুষকে না কাঁদিয়ে ছাড়তে পারে না। আজ বাংলা ভাষা স্বাধীন বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা অর্জন করেছে। এর পিছনে কত রক্ত এবং শহীদের আত্মত্যাগ তা বঙ্গবন্ধুর আবেগতাড়িত বর্ণনা থেকে বুঝা যায়। যেহেতু একমাত্র বাঙালি জাতি মাতৃভাষার অধিকার রক্ষায় সমগ্র বিশ্বে প্রাণ বিসর্জনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করল যার ধারাবাহিকতায় বাঙালী জাতিয়তাবাদের উম্মেষ, দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন মাতৃভূমি। এটিই স্বীকৃত হয়েছে বিশ্ব দরবারে। এজন্যই মহান একুশে ফেব্রুয়ারি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আমাদের জাতীয় জীবনে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ও অবিস্মরণীয়।

১৯৫৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি আইন পরিষদের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খসড়া শাসনতন্ত্রের অন্তর্গত জাতীয় ভাষা সংক্রান্ত প্রশ্নে তাঁর বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন যে, ‘পূর্ববঙ্গে আমরা সারকারি ভাষা বলতে রাষ্ট্রীয় ভাষা বুঝি না। কাজেই খসড়া শাসনতন্ত্রে রাষ্টের ভাষা সম্পর্কে যেসব শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে তা কুমতলবে করা হয়েছে। পাকিস্তনের জনগণের শতকরা ৫৬ ভাগ লোকই বাংলা ভাষায় কথা বলে, এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন রাষ্ট্রীয় ভাষার প্রশ্নে কোনো ধোঁকাবাজি করা যাবে না। পূর্ববঙ্গের জনগণের দাবি এই যে, বাংলাও রাষ্ট্রীয় ভাষা হোক।’

১৯৭০ সালের ৩১ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেন– “শিল্পী, সাহিত্যিক এবং কবিদের জনসাধারণের আশাআকাঙ্খা অবশ্যই প্রতিফলিত করতে হবে। তাঁরা তাদের মানুষ, মাতৃভূমি ও সংস্কৃতির জন্যে শিল্পচর্চা করবেন। জনগণের স্বার্থে এবং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে নতুন করে গড়ে তোলার জন্যে সাহিত্যিকদের প্রাণ খুলে আত্মনিয়োগ করার জন্যে আমি আবেদন জানাচ্ছি। আমি তাঁদের আশ্বাস দিচ্ছি, কবি এবং সাহিত্যিকবৃন্দের সৃষ্টিশীল বিকাশের যে কোন অন্তরায় আমি এবং আমার দল প্রতিহত করবে।”

সমকালীন সময়ের জোরালো দাবি তরুণ প্রজন্মের হৃদয় গভীরে বঙ্গবন্ধুসহ সকল আন্দোলন সংগ্রামে শহীদানদের আত্মত্যাগ ও আত্মোসর্গের গৌরবগাথা পরিপূর্ণভাবে প্রোথিত করা। তারা যেন অনুধাবন করতে সক্ষম হয় কেন কী ভাবে আমাদের এই মাতৃভাষা আন্দোলন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। নির্মাণ করেছে তাদের জন্য এক সোনালী স্বপ্নের। এ স্বপ্ন হচ্ছে পরিবর্তনের স্বপ্ন, আধুনিকতা, নান্দনিকতা, অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবিকতায় ঋদ্ধ বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণের স্বপ্ন। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের নির্ভীক ও মেধাবী কারিগর দেশের তারুণ্যের উচ্ছাসে ভরা বর্তমান প্রজন্ম যারা নতুন সহযাত্রীর জন্য তৈরি করবে জ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর এক উন্নত বাংলাদেশ। দেশ ও জাতির এটুকুই আজকের দিনের প্রত্যাশা।

লেখক: শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাংলা ভাষার গৌরবময় এগিয়ে চলা
পরবর্তী নিবন্ধমোস্তফা হাকিম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের পুরস্কার বিতরণ