বাংলা ভাষার গৌরবময় এগিয়ে চলা

এস.এম.ওমর ফারুক | বুধবার , ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ at ১০:৫১ পূর্বাহ্ণ

পৃথিবীর প্রতিটি জাতির কিছু গৌরবময় ইতিহাস ও অহংকার এর বিষয় থাকে। যেটি ঐ জাতিকে অন্য জাতি বা রাষ্ট্র থেকে স্বাতন্ত্র মর্যদাবোধ নিয়ে এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখে। আমাদেরবাংলাদেশের এমন একটি গৌরবময় ইতিহাস হল ১৯৫২খ্রি. এর মহান ভাষা আন্দোলন এবং আমাদের অহংকার হল আমাদের বাংলা ভাষা। পৃথিবীতে বহু জাতি গোষ্ঠী তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষা রক্ষার জন্য জীবনক্ষয়ী সংগ্রাম করলেও সফলতার শীর্ষে আমরা। উপমহাদেশেই তামিল ভাষার জন্য ১৯৬৫ খ্রি. এর ফেব্রুয়ারিতে জীবন হারিয়েছেন ১৫০ জন। পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে আমাদের পূর্ব পুরুষদের সফল ভাষা আন্দোলন আমাদেরকে পরবর্তীতে প্রতিটি সংগ্রামে প্রেরণা যুগিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছে স্বাধীনসার্বভৌম বাংলাদেশ। বাংলা ভাষা আজ আমাদের জাতীয় ঐক্য ও জাতীয় অহংকার এর প্রতীক। বর্তমান পৃথিবীর ৬০০০(ছয় হাজার) এর বেশি ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষার স্থান ৫ম। বাংলা ভাষার কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ১০৫ বছর আগে। পৃথিবীর বহু দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলছে, সাহিত্য রচনা করছেন। অতএব বাংলা ভাষা আমাদের অহংকার এবং ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন যেমন আর্ন্তজাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে তেমনি এদেশের প্রতিটি সেক্টরকে এগিয়ে নিতে এ ভাষা প্রেমের স্বাজত্যবোধ প্রেরণা জুগিয়ে যাবে।

আজকের লেখায় আমরা বিশ্বময় বাংলা ভাষার অগ্রযাত্রা তুলে ধরতে চাই। আমরা জানি স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে গ্রহণ করার যৌক্তিক ও জোরালো দাবি প্রত্যাখ্যাত না হলে আজকে বাংলা ভাষা হতো বিশ্বময় চর্চিত অন্যতম প্রধান ভাষা। অন্যদিকে পাকিস্তানীদের চক্রান্ত সফল হলে এবং আমাদের ভাষা আন্দোলন ব্যর্থ হলে বাংলা ভাষা পড়ত অস্থিত্বের সংকটে। সে যা হোক, বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও জাপানে বাংলা ভাষা চর্চা ছিল। স্বাধীনতার পর মস্কোর (রাশিয়া) প্রগতি প্রকাশনার উদ্যোগ বাংলা ভাষায় বই প্রকাশ ও বিপণন শুরু হয়।

বাংলাদেশের বাইরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা, আসাম, বিহারসহ আরও কয়েকটি প্রদেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম বাংলা ভাষা। সুখের বিষয় হল, বাংলাদেশের বাইরে সবচেয়ে অধিক বাংলা ভাষার ব্যবহার হচ্ছে ইউরোপ ও আমেরিকায়। এই দুই মহাদেশের বহু রাষ্ট্রে রয়েছে বাংলা ভাষায় পত্র পত্রিকা, বেতার ও টেলিভিশন সমপ্রচার কেন্দ্র এবং নজরুলরবীন্দ্র সেন্টার। ইংল্যান্ড এর ইস্ট লন্ডন, ম্যানচেষ্টার ও বার্মিংহামে অসংখ্য মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। সেখানকার স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলা ভাষা লেখা, চর্চা করা ও গবেষণা করার সুযোগ রয়েছে। যুক্তরাজ্যে বাংলা ভাষাকে গবেষণার বিষয় করেছেন এমন ক’জন গবেষক হলেনজে ডি এন্ডারসন, টি ডব্লিও ক্লার্ক, জন বোল্টন, উইলিয়াম রাদিচে, হানারুথ থমসন প্রমুখ। বলাবাহুল্য, তাঁদের কারোরই মাতৃভাষা বাংলা নয়। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অদিতি লাহিড়ি বাংলা রুপতত্ত্ব ও ধ্বনিতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেছেন কয়েক দশক ধরে।

অনুরুপভাবে লক্ষ্য করা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপকভাবে বাংলা ভাষার চর্চা ও গবেষণা হচ্ছে। ইউ এস এ তে কমপক্ষে দশটি বিশ্ববিদ্যালয় ও এশীয় গবেষণা কেন্দ্রে বাংলা ভাষার চর্চা হচ্ছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল নিউইর্য়ক বিশ্ববিদ্যালয়, ইথাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়, মিনেসোটা, ফ্লোরিডা, মেরিল্যান্ড, ক্যার্লিফেনিয়া, ভার্জিনিয়া, উইলকিনসন, হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি। মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার অর্থ প্রকাশে মনস্তত্ত্বের ভূমিকা নিয়ে কাজ করছেন জাস্টিন আলফানসো চাকোন। ওয়াশিংটনে বাংলা অপশব্দ নিয়ে গবেষণা করছেন রাশাদ আহমেদ। নিউইয়র্কে নজরুল সাহিত্য নিয়ে কাজ করেন মারিয়া হেলেন। বাংলা ভাষা শিক্ষাদানের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রে গবেষণা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, লালন, চর্যাপদ ও মধ্যযুগের সাহিত্য নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি বংশদ্বূত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সালামউদদৌলা খান গবেষণা করেছেন বাংলা ধ্বনিবিজ্ঞান নিয়ে। আমেরিকার নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস ও লস অ্যাঞ্জেলেস এ গড়ে উঠেছে বাঙালি পাড়া। চর্চা হয় বাংলা সংস্কৃতি। উত্তর আমেরিকায় দুই বছর পর পর নিয়মিত নজরুল সম্মেলন হচ্ছে। ফ্লোরিডায় নিয়মিত বাঙালিদের মিলন উৎসবে বাংলা ভাষার চর্চা ও সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।

ইউরোপ মহাদেশের ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, বেলজিয়াম, ফিনল্যান্ড, পোল্যান্ড ও চেক প্রজাতন্ত্রে বাংলা ভাষার চর্চা ও গবেষণা চলছে। ফ্রান্সের প্যারিসে অবস্তিত প্রাচ্যভাষা ও সংস্কৃতি ইন্সটিটিউটে মি. ফ্রান্স ভট্রাচার্য্য প্রায় তিন দশক ধরে বাংলা ভাষায় শিক্ষা দিয়েছন। এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে পাঠদান করেছেন মাহমুদ শাহ কোরেশী, শিশির ভট্টাচার্য্য প্রমুখ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ফরাসী ভাষায় অনুবাদ করেছেন মি. ফ্রান্স ভট্টাচার্য্য। জার্মানীর হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবাসী কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, মার্টিন কেম্পসন প্রমুখের হাত ধরে বাংলা চর্চার সূচনা হয়েছে বহু আগেই। জার্মানীতে বাংলা ভাষায় বেতার সমপ্রচারও শুরু হয়েছে বহুবছর পূর্বে। ইতালিতে বিপুল বাঙালি যেমন বসবাস করছে তেমনি তারা চর্চা করছেন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি। সেদেশে বাংলা ভাষা নিয়ে কাজ করছেন অধ্যাপক মারামারা। পোল্যান্ডে অধ্যাপক এলভিয়েতা ওয়োল্টার, বেলজিয়ামে ফাদার দাতিয়েন, নরওয়েতে অধ্যাপক জিলিয়ান রামচান্দ, নেদারল্যান্ডসে ভিক্টর ভ্যান বিজার্ট, উইলিয়াম ভ্যানদার প্রমুখ পন্ডিত বাংলাভাষা নিয়ে গবেষণা ও অনুবাদ সাহিত্য রচনা করেছেন। ডেনমার্কের অলবো বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা বিষয়ে কাজ করার জন্য একটি বেঙ্গল স্টাডি সেন্টার খোলা হয়েছে।

আমেরিকার মত কানাডাতেও রয়েছে বিপুল বাঙালির বসবাস। তারা নিয়মিত বাংলা ভাষা ও বাংলা সংস্কৃতি চর্চা করছেন। মন্ট্রিয়ল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাজেন্দ্র সিংহের তত্ত্বাবধানে বাংলা শব্দ গঠন বিষয়ে গবেষণা হয়েছে সেই ২০০৭খ্রিষ্টাব্দে। কানাডার টরেন্টো ও মন্ট্রিয়ল থেকে নিয়মিত ভাবেই বেশ কয়েকটি বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়ে থাকে। কানাডার বেশ ক’টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয় বাংলা। টরোন্টো থেকে ইকবাল হাসান প্রকাশ করেন বাংলা জার্নাল নামে একটি সাময়িকী।

এশিয়া মহাদেশে ভারত ছাড়াও জাপান, চীন কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, মায়ানমার, ইন্দোনেশিয়াসহ বহুদেশে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণা ও লেখালেখি চলছে। জাপানে প্রায় ৭১ বছর আগে মি. কাজুয়ো আজুমা বাংলা ভাষার চর্চা শুরু করেছিলেন। রবীন্দ্র প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি প্রায় সারা জীবনই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চা করে কাটিয়েছেন। কেই শিরাই, অধ্যাপক নারা, কাজুহিরো ওয়াতানাবে, কিউকা নিওয়া প্রমুখ গবেষক জাপান ফাউন্ডেশন ও টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণা ও শিক্ষকতা করেছেন। জাপানের রেডিও ‘এনএইচকে’তেও নিয়মিত বাংলা অনুষ্ঠান সমপ্রচার হচ্ছে।

বাংলা ভাষা চর্চায় চীনও বেশ এগিয়ে। বহুবছর যাবৎ চীনের রেডিও বেইজিং থেকে বাংলা ভাষায় নিয়মিত সমপ্রচার চলছে। চীন থেকে প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু বাংলা অনুবাদকর্ম। বর্তমানে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যের কারণে সেদেশে বাংলা শেখার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে। চীনের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয়েছে বাংলা ভাষার ওপর গবেষণা। বাংলা ভাষার কোর্স চালু করেছে বহু চীনা বিশ্ববিদ্যালয়। সমপ্রতি বেইজিং ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজ চালু করেছে বাংলা বিষয়ে স্নাতক সম্মান কোর্স। মধ্যপ্রাচ্যের সাথে বাঙালিদের যোগাযোগ বহুবছর পূর্ব থেকে। বর্তমানে মধ্যেপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ১ কোটিরও বেশি বাঙালি সে সব দেশে বাংলা ভাষার প্রসারে ও চর্চায় ভূমিকা রেখে চলেছেন। কোন কোন দেশে বাংলা ভাষায় পড়ানোর জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বের হচ্ছে বাংলা পত্র পত্রিকা। দক্ষিণ আফ্রিকাসহ আফ্রিকা মহাদেশের বহু দেশে রয়েছে লক্ষ লক্ষ বাংলা ভাষাবাসী। আফ্রিকার দেশ সিয়েরা লিওন বাংলা ভাষাকে দ্বিতীয় ভাষার মর্যাদা দিয়েছে। সব মিলিয়ে বিশ্বময় প্রায় ৪০(চল্লিশ) কোটি মানুষের মনের ভাব প্রকাশের ভাষা আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার, আমাদের বাংলা ভাষা।

লেখক :অধ্যাপক, ও প্রাবন্ধিক, প্রধান উপদেষ্টা, রাজনীতি বিজ্ঞান অনুশীলন কেন্দ্র, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রজাপতি মন পাখা মেলে
পরবর্তী নিবন্ধমাতৃভাষা আন্দোলন স্বজাত্যবোধের উৎসপ্ররোহ