মরুর বুকে ফুটবলের বিশ্বযুদ্ধ

কাতার-ইকুয়েডরের ম্যাচ দিয়ে আজ পর্দা উঠছে বিশ্বকাপের ২২তম আসরের

ক্রীড়া প্রতিবেদক | রবিবার , ২০ নভেম্বর, ২০২২ at ৭:০৬ পূর্বাহ্ণ

মাত্র ১১ হাজার ৪৩৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের দেশ কাতার। আয়তনে চট্টগ্রামের তিনভাগের একভাগ। মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র হলেও আর্থিক দিক থেকে বিশ্বের অনেক দেশকে পেছনে ফেলে নিজেদের আধিপত্য দেখিয়ে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের তেল সমৃদ্ধ দেশটি। বিশ্বের বিশাল বিশাল দেশ যেখানে বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনের সাহস করে না সেখানে কাতার শুধু সাহসই দেখায়নি বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়ে বিশ্বকাপ আয়োজনের মধ্য দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করতে যাচ্ছে। আজ যখন ২২তম বিশ্বকাপ ফুটবলের পর্দা উঠবে তখন কাতারের নামটি উঠে যাবে ইতিহাসের পাতায়। কারণ এত ছোট একটি দেশ হিসেবে বিশ্বকাপ আয়োজনে যে রেকর্ড গড়েছে কাতার। ২০০২ সালে এশিয়াতে প্রথম বিশ্বকাপের আয়োজন হয়েছিল। তাও জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া দুই দেশ মিলে। কিন্তু কাতার যেন দেখিয়ে দিল ইচ্ছা, অদম্য সাহস, সঠিক নেতৃত্ব থাকলে যেকোনো কিছু সম্ভব।

স্বাগতিক কাতার এবং লাতিন আমেরিকার দেশ ইকুয়েডরের মধ্যকার ম্যাচ দিয়ে আজ বিশ্বকাপের পর্দা উঠবে আল-খোরের আল-বায়াত স্টেডিয়ামে। এই ম্যাচে মাঠে নামার মধ্য দিয়ে ফুটবল দল হিসেবে কাতারও নাম লেখাবে ইতিহাসে। কারণ এর আগে কখনোই বিশ্বকাপ খেলতে পারেনি তারা। এবার স্বাগতিক হওয়ার সুবাধে কোনোরকম বাছাই পর্ব খেলা ছাড়া বিশ্বকাপে খেলছে দেশটি।

২০০৯ সালে বিশ্বকাপ আয়োজকের বিডিং পদ্ধতি শুরু পর ২০১৮ এবং ২০২২ সালের বিশ্বকাপ ভাগ করে দেওয়া হয় ইউরোপ এবং নন ইউরোপের মধ্যে। ২০১৮ সালের বিশ্বকাপের দায়িত্ব পায় রাশিয়া। ২০২২ সালের নন ইউরোপের আয়োজকের জন্য বিড করে অস্ট্রেলিয়া, জাপান, কাতার, দক্ষিণ কোরিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র। ২০১০ সালের ২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় ২০২২ বিশ্বকাপ আয়োজকের জন্য ভোটিং। প্রথম রাউন্ডে ১ ভোট পেয়ে বাদ পড়ে অস্ট্রেলিয়া। দ্বিতীয় রাউন্ডে দুই ভোট পাওয়া জাপান বাদ পড়ে। তৃতীয় রাউন্ডে পাঁচ ভোট পেয়ে বাদ পড়ে দক্ষিণ কোরিয়া। চতুর্থ রাউন্ডের ভোটে কাতার পায় ১৪ ভোট আর যুক্তরাষ্ট্র পায় ৮ ভোট। আর তাতেই ২০২২ বিশ্বকাপের আয়োজকের দায়িত্ব পেয়ে ইতিহাস রচনা করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি। পরের বছরই খবর আসে কাতার বিশ্বকাপের আয়োজক হতে ঘুষ দিয়েছে। পরে অনেক জল ঘোলা হয়েছে এ নিয়ে। যার পরিণতিতে তৎকালীন ফিফা সভাপতি সেফ ব্ল্যাটারসহ বেশ কয়েকজন ফিফা কর্মকর্তার শাস্তি হয়। বিতর্কের শুরু সেই থেকে। এরপর বিশ্বকাপের স্টেডিয়ামসহ নানা স্থাপনা তৈরি করতে গিয়ে শ্রমিক নিহত হওয়াসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠে কাতারের বিরুদ্ধে। তবে কাতার সে সবকে ভ্রুক্ষেপ না করে চালিয়ে যায় তাদের কার্যক্রম।

বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচাইতে বড় বাজেট নিয়ে হাজির হয় কাতার। এবারের বিশ্বকাপ আয়োজনে কাতার খরচ করেছে ১৭,৬৮,১৮৯ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। যা ১৯৯৪ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সাতটি ফুটবল বিশ্বকাপে সব মিলিয়ে যা খরচ হয়েছে তার চার গুণেরও বেশি। বিশ্বকাপের প্রাইজমানিতে কাতার বইয়ে দিচ্ছে টাকার বন্যা। যেখানে চ্যাম্পিয়নরা পাবে ৪০৪ কোটি টাকারও বেশি। আর রানার্সআপ দল পাবে প্রায় ২৯০ কোটি টাকা। আয়োজক হওয়া থেকে শুরু করে আয়োজন। আর পুরস্কার সবকিছুতে খরচের রেকর্ড গড়া কাতার বিশ্বকাপকে ঘিরে বিতর্কের যেন শেষ নেই শুরুর দিন পর্যন্ত। স্বল্প পোশাকে স্টেডিয়ামে যাওয়া যাবে না, সমকামিতা নিষিদ্ধ, অবৈধ দৈহিক সম্পর্ক গড়া যাবে না, বিয়ার নিয়ে মাঠে যাওয়া যাবে না- এমন সব সিদ্ধান্তে বিভিন্ন দেশের দর্শক বিশেষ করে ইউরোপ এবং আমেরিকার দর্শকদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। তবে এসব যেন থোড়াই কেয়ার করছে কাতার।

তবে নানা অভিযোগ, আলোচনা, সমালোচনা, অঘটন আর শংকাকে পেছনে ফেলে আজ উৎসবে মেতে উঠতে যাচ্ছে পুরো ফুটবল বিশ্ব। সারা বিশ্বের ফুটবল প্রেমীদের চোখ আজ থেকে থাকবে মরুর দেশ কাতারের দিকে। বিশ্বকাপের ৯২ বছরের ইতিহাসে সবচাইতে আলোচিত, আধুনিক এবং প্রযুক্তি সমৃদ্ধ বিশ্বকাপ আয়োজিত হতে যাচ্ছে কাতারে। বিশ্বকাপকে কাতার যেমন নিয়ে যাচ্ছে অনন্য উচ্চতায় তেমনি বিশ্বকাপের কারণে কাতার পৌঁছে যাচ্ছে আরো উচ্চতায়। আজ আলো ঝলমলে বর্ণিল উৎসব আর আতশ বাজির আলোকচ্ছটায় বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বকাপের শুরুর ধ্বনি। আগামী একমাসের ফুটবল মহাযুদ্ধ চলবে মরুর বুকে। ৩২ দল, ৬৪ ম্যাচ, একটি ট্রফির জন্য চলবে প্রাণপণ লড়াই। যা শেষ হবে আগামী ১৮ ডিসেম্বর ফাইনালের মধ্য দিয়ে। মেসি, রোনালদো, সুয়ারেজ, মদ্রিচ, বেনজেমার মত অনেক তারকা যেমন হারিয়ে যাবে তেমনি এই বিশ্বকাপ থেকে জন্ম নেবে আরো কত নতুন তারকা। আর এটাই যে বিশ্বকাপের চিরাচরিত নিয়ম।
মরুর বুকে উত্তপ্ত লু হাওয়ার মাঝে বিশ্বকাপ আয়োজন নিয়ে কম সমালোচনা হয়নি। তাই তো জুন-জুলাইয়ের বিশ্বকাপকে নিয়ে যাওয়া হয় নভেম্বর-ডিসেম্বরে।

সেখানেও কাতার দেখাল আরেক জাদু। সবগুলো স্টেডিয়ামেই সংযুক্ত করা হয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। যা বিশ্বকাপে নতুন সংযোজন। বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথমবারের মত সবগুলো স্টেডিয়ামই মাত্র দশ কিলোমিটারের দূরত্বে। বিশ্বকাপ উপলক্ষে ছোট্ট দেশটিকে সাজানো হয়েছে একেবারে ছবির মত করে। গড়ে তোলা হয়েছে নতুন শহর।

বিশ্বকাপের জন্য নির্মাণ করা ৮টি স্টেডিয়ামের মধ্যে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে আরব সংস্কৃতি। সে সাথে স্থাপত্যকলার দারুন নিদর্শন। কোনো স্টেডিয়াম টুপির মত, কোনটি আরবের নৌকার মত, কোনটি আবার ধারণ করে আছে আরবের অন্য কোনো ঐতিহ্যকে। আবার কোনো স্টেডিয়াম নির্মাণ করা হয়েছে এমনভাবে যাতে বিশ্বকাপ শেষেই তা অন্যত্র সরিয়ে ফেলা যায়। গড়ে তোলা হয়েছে হাজার হোটেল, রিসোর্ট এবং ভাসমান হোটেল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ফুটবল ভক্তদের তুষ্টির জন্য আয়োজনের যেন কমতি রাখেনি কাতার কর্তৃপক্ষ।

এ তো গেল মাঠের বাইরের বিষয়। মাঠের লড়াইয়ে এসেছে প্রযুক্তির নানা ছোঁয়া। বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বাধুনিক সব প্রযুক্তি ব্যবহার হবে মাঠের খেলায়। প্রথমবারের মত বিশ্বকাপে ম্যাচ চালাবেন মহিলা রেফারি। তাও একজন কিংবা দুইজন নয়। ছয়জন নারী রেফারি ম্যাচ চালাবেন বিশ্বকাপে। সব মিলিয়ে আলোচনা, সমালোচনা, ঝড়, ঝঞ্ছাকে ছাপিয়ে আজ ফুটবলের নতুন জয়গান যেন ছড়িয়ে পড়বে মরুর দেশ কাতার থেকে। কারণ এটা যে ফুটবলের মহাযুদ্ধ। যে যুদ্ধে বিজয়ী কেবলই একজন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকারা থাকবেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে
পরবর্তী নিবন্ধহাওয়া ভবনের সবচেয়ে বড় চোরের হাতে দেশ তুলে দেয়া যাবে না