বন্ধুদের আড্ডায়, চায়ের টেবিলে, চলতি পথে নারীবাদ এবং নারী–স্বাধীনতা বিষয়ক যে সব কথা প্রায়শই শুনতে পাওয়া যায়, সমাজের উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্ন–মধ্যবিত্ত সব পরিমণ্ডলেও সেই আশঙ্কাটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়…নারী স্বাধীনতা নামে নারীরা স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠছেন। আসলেই কি বাস্তবতাটা এমন?
আমাদের প্রতিদিনের সামাজিক জীবন যাপনে আমরা যেভাবে ‘স্বাধীনতা’, ‘অধিকার’ আর ‘স্বেচ্ছাচারিতা’ শব্দগুলোর অর্থকে বুঝে থাকি বা ব্যবহার করে থাকি, তা নিয়েই এই লেখাটি। যেমনটি বলছিলাম, সমাজের নানা স্তরে বিভিন্ন আড্ডায় আমরা দেখতে পাব, নারীর স্বাধীনতার অধিকার কখন, কীভাবে নারীর স্বেচ্ছাচারিতা হয়ে উঠবে, তা নিয়ে তরুণরা, বিশেষত পুরুষ তরুণরা বেশ চিন্তিত।
তাঁদের ভয়, মেয়েদের অধিকার স্বীকার করে নিলে মেয়েরা যা খুশি তা–ই করতে শুরু করবে। তবে এই ভয়টা ঠিক কিসের ভয় তা আবার বুঝিয়ে বলাও মুশকিল। মেয়েরা নিজেদের খুশিমতো কাজ করলে কেনো তারা চিন্তিত হয়ে সেটাও খুব স্পষ্ট নয়।
কয়েকটি দৃশ্যপটকে ঘিরে আলোচনাটি এগিয়ে নিতে চাই। বিভিন্ন বয়সী পুরুষদের মধ্যে এমন একটি ভাবনা আছে, নারী এবং পুরুষের মধ্যে যদি সমতাই বিরাজ থাকবে, ঘুরিয়ে বললে বৈষম্য যদি না–ই থাকে, তা হলে যানবাহনে কেন মেয়েদের জন্যে সংরক্ষিত বসার আসন থাকবে? কেনই বা নারী সংরক্ষিত যানবাহন? অনেকেই বলেছেন, নারীরা অনেক সময়েই নারী–নির্যাতন বিরোধী আইনগুলির অন্যায় প্রয়োগ করে থাকেন পুরুষদের ‘ফাঁসানো’র জন্য।
বিদেশি নারীবাদ যে নারীদের উল্টোপাল্টা বুদ্ধি দিচ্ছে, সেই কথাটিও নির্দ্বিধায় বলে থাকেন অনেকেই। আবার অনেকেই বলেন যে তাঁরা নারী–স্বাধীনতার বিপক্ষে নন, নারীর উপার্জন করার অধিকারের বা শিক্ষার অধিকারের প্রশ্নে তাদের সায় আছে। কিন্তু, ওই যে, ভয়টা যে ঠিক কিসের সেটা তারাও খুব ভাল করে জানেন না।
এই ভয় বা আতঙ্ক আদতে এক ধরনের নারী–বিদ্বেষ, যা আমাদের দৈনন্দিন যাপনের মধ্যে এমনই ভাবে জড়িয়ে আছে যে আঙুল তুলে দেখিয়ে না দিলে তাকে বুঝতে পারা মুশকিল। অনেক সময় যারা এই বিদ্বেষ কথায়–কাজে ব্যবহার করছেন, তারা খুব সচেতনভাবে বিদ্বেষ প্রকাশ করার জন্য করছেন, এমনও নয়।
নারী–বিদ্বেষ বিষয়টি এতই ‘স্বাভাবিক’ যে নারীদের চাকরি–বাকরি করার বদলে বা কোনোমতে একটা চাকরি করে ঘর–বাহির দুটোই সামলানোর বিষয়টি চোখে লাগে না, যেন নারীদের কোনোমতে একটি চাকরি করাই স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিকতার বাইরে গেলেই নারী স্বেচ্ছাচারী। কিন্তু কেন?
প্রথমত, নারীর স্ব–ইচ্ছা নিয়ে ভয়টা নতুন নয়। তাকে একটা গণ্ডির মধ্যে স্বাধীনতা দেওয়া গেলেও সেটি যেন কখনোই পৌরুষের শ্রেষ্ঠত্বকে ছাপিয়ে না যায়, সেই প্রবণতা ঊনবিংশ শতক থেকে চলেছে।
যখনই কথা উঠেছে নারীর নিজের ভাগ্য নিজে গড়ে নেওয়ার অধিকারের, তখনই সমাজ জুড়ে ‘গেল গেল’ রব উঠেছে। নারীশিক্ষার অধিকার মেনেও, কোন বিষয় নারীর উপযোগী, তা নিয়ে বিতর্ক হয়েছে দেশে–বিদেশে। সেই শিক্ষাকে ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগের ক্ষেত্রে, নারীর শ্রমের মূল্য নির্ধারণ করতে গিয়েও তার মর্যাদা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আর প্রত্যেকবারই যে জুজুকে সামনে রেখে আমাদেরকে ভয় দেখানো হয়েছে তা হল, নারীর স্বেচ্ছাচারিতার ভয়।
দ্বিতীয়ত, নারীর স্ব–ইচ্ছা যদি তাঁর দেহ এবং তাঁর বুদ্ধি দু’টিকেই নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে, তা হলে দুইয়ের মধ্যে বৈপরীত্য স্থাপন করার কৌশল ব্যর্থ হয়ে যায়। নারীর দেহই নারীর সবচেয়ে বড় শত্রু, এই ধারণার বাইরে বেরিয়ে নারীরা যদি দেহের স্বাধীনতাকে মনের স্বাধীনতার মতোই গুরুত্বপূর্ণ আর প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন, তা হলে পুরুষের প্রশ্নহীন অধিকারে টান পড়ে।
তৃতীয়ত, এই পিতৃতান্ত্রিক পৌরুষের ধারণার মধ্যে, তার দৈনন্দিন উদযাপনের মধ্যে যেটি প্রধান স্থান অধিকার করে আছে তা হল, পিতৃতান্ত্রিক পুরুষ–প্রধান পরিবার ব্যবস্থা। মনে রাখতে হবে যে, পরিবার একটি যৌথ ব্যাপার, তার ব্যবস্থাপনায় কেবল ব্যক্তি পুরুষ নয়, ব্যক্তি নারীও অংশীদার। পারিবারিক হিংসা সেই কারণেই এক অকথিত নীরবতার চুক্তির আড়ালে চাপা পড়তে থাকে।
এখন এই গুলিয়ে–যাওয়া বাস্তবতাকে সহজ কথায়, সাদা–কালোয় উপস্থাপনার কঠিন কাজটাই নারীবাদকে করতে হয়। আর করতে হয় বলেই নারীর পদে পদে বাধা, নারীকে দুর্নামে ডোবানোর পাঁয়তারা চলমান।