স্বপ্ন দেখতে জানলে, স্বপ্নকে লালন করলে সে–স্বপ্ন আর স্বপ্ন থাকে না একদিন তা বাস্তবে এসে ধরা দেয়, দেবেই। এমন এক স্বপ্ন নিয়ে কাজ করে গেছেন এদেশের স্বনামধন্য এক নারী, রুবি গজনবী। প্রাকৃতিক রং নিয়ে, কারুশিল্প নিয়ে আজীবন কাজ করে গেছেন তিনি। এদেশে প্রাকৃতিক রংকে শিল্পের এক দারুণ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পথিকৃৎ হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টায় কারুশিল্পে প্রাকৃতিক রং–এর ব্যবহার অন্য এক মাত্রা যোগ করেছে।
১৯৩৫ সালে ফরিদপুরে জন্মগ্রহণকারী রুবি গজনবীর জীবনের অনেকখানি সময় কেটেছে কলকাতায়। শিক্ষাজীবনের প্রারম্ভিক পর্যায় সেখানেই কেটেছে। বিখ্যাত লরেটো স্কুলের ছাত্রী রুবী গজনবীর পরিবার দেশভাগের পর বাংলাদেশে চলে আসেন এবং পরবর্তীতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেন।
তিনি প্রথম প্রাকৃতিক রং–কে এদেশের মানুষের কাছে পরিচিত করে তোলেন। কারুশিল্পকে এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নিয়ে যেতে কাজ শুরু করেন। এক্ষেত্রে ভারতের সমাজকর্মী কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায়ের কাজ তাঁকে উদ্বুদ্ধ করে।
১৯৮২ সালে প্রাকৃতিক রং নিয়ে তিনি একটি প্রকল্প চালু করেন। প্রাথমিক ভাবে ছয়টি রং নিয়ে তিনি কাজ করেন যাতে পরবর্তীতে আরও অনেক রং যুক্ত হয়। ধারাবাহিকভাবে রং নিয়ে কাজ করার জন্য তিনি ‘অরণ্য ক্রাফটস’ নামে নিজের প্রতিষ্ঠান শুরু করে ১৯৯০ সালে। এটা ছিল তাঁর স্বপ্নের এক যাত্রার শুরু। কারুশিল্পকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার জন্য ‘অরণ্য ক্রাফটস’ নিরলস কাজ করে যায়।
সাথে কারুশিল্পী এবং কারুশিল্পের উন্নয়নের লক্ষ্যে সর্বজন শ্রদ্ধেয় পটুয়া কামরুল হাসান সহ বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন। অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি যার নির্বাহী হিসেবে কাজ করে গেছেন।
কারুশিল্প পরিষদের নির্বাহী হিসেবে দায়িত্বপালনকালীন সময়ে রুবি গজনবী জামদানী শিল্পকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্মানসূচক অবস্থানে নেয়ার প্রভূত প্রচেষ্টা করেন এবং এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৮তে আয়োজন করেন জামদানী উৎসবের।
জামদানী শিল্পের আঁতুরঘর সোনারগাঁও ‘ওয়ার্ল্ড ক্রাফট সিটি’র মর্যাদা অর্জন করে তাঁর প্রচেষ্টায়। জামদানী শিল্পকে ভৌগোলিক সীমানা পেরিয়ে বিশ্বের কোণায় কোণায় পরিচিত করতে কারুশিল্প পরিষদের নির্বাহী রুবি গজনবী বিশেষ অবদান স্মরণীয় হয়ে রবে। ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে জামদানীর অন্তর্ভুক্তি রুবি গজনবীর অবদান।
বাংলাদেশের নারীদের কর্মক্ষেত্রের পরিসর বরাবরই ছিল অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তা হিসেবে নারীদের কর্মক্ষেত্রে নতুন দুয়ার উন্মুক্ত করতে রুবি গজনবী পথ দেখিয়ে গেছেন। সমাজ কাঠামোর বিবিধ বাধাকে তর্জনী দেখিয়ে নিজের জমানো টাকায় খুলেছেন তাঁর স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান ‘অরণ্য ক্রাফটস’। নিজের দৃঢ় মনোবল, পরিবারের মানসিক সহায়তায় রুবি গজনবী পেরেছিলেন স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে, কখনোই তিনি স্বপ্ন দেখা বন্ধ করেননি।
প্রাকৃতিক রং পরিবেশ রক্ষায় এক বিশেষ ভূমিকা রাখে। কেমিক্যাল রং এর প্রভাবে আমাদের জলাশয়গুলোর জলজীবন কী করুণ অবস্থায় পতিত তা নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা আর সাভারের তুরাগ নদী জীবন্ত উদাহরণ।
এই দূষণের প্রভাব প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে মানব শরীরে পড়ছে। অথচ প্রাকৃতিক রং–এর ব্যবহার এই দূষণ থেকে মুক্তি দিতে পারে। রুবি গজনবী ঠিক এই জায়গায় কাজ করে গেছেন একজন পরিবেশযোদ্ধা হিসেবে। বর্তমানের পরিবেশ দূষণের ভয়াবহ এক দুর্যোগকালীন সময়ে রুবি গজনবীর মতো যোদ্ধাদের প্রয়োজন। তাঁর প্রচেষ্টার কাজগুলো অনুপ্রাণিত করুক ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে।
ওয়ার্ল্ড ক্রফটস কাউন্সিলের সম্মানিত সদস্য এবং এশিয়া–প্যাসিফিক অঞ্চলের জাতীয় রঞ্জক কর্মসূচির চেয়ারপারসন রুবি গজনবী ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ট্রাস্টি ছিলেন। এছাড়াও বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের একজন সম্মানিত সদস্যও ছিলেন তিনি। নকশা ও রঙ্গিন নামে তাঁর রয়েছে দুটো বই যেগুলো মূলত তাঁর কাজের ভালোবাসার যে জায়গা তাকে ঘিরেই।
একজন মানুষ রং, নকশা, কারুশিল্পকে ভালোবেসে, তার উন্নয়নে কাজ করে গেছেন একটা জীবন এবং একটা লক্ষ্যকে সামনে রেখে নিয়ে এসেছেন সাফল্য, স্বপ্নকে করেছেন সার্থক। ১৪ জানুয়ারি ২০২৩ ঢাকায় এই গুণীজন আটাশি বছর বয়সে মারা যান, পেছনে রেখে যান আলোকিত এক জীবন।